আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াড
তানভীর তানিম
প্রকাশ : ৩০ জানুয়ারি ২০২৩ ১৬:২৭ পিএম
থাইল্যান্ডের ফুকেট শহরে এবার ছিল আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডের ২৪তম আসর। রোবট ইন মুভির চ্যালেঞ্জ গ্রুপ থেকে একমাত্র স্বর্ণপদকটি জেতে বাংলাদেশ। স্বর্ণজয়ী তিন শিক্ষার্থীকে নিয়ে লিখেছেন তানভীর তানিম
একটা সময় রোবট ছিল মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। রোবট বানানো তো দূরের কথা, এর নিয়ন্ত্রণ-কার্যপ্রণালি নিয়েও গোলকধাঁধার অন্ত ছিল না। সে যুগ অনেক আগেই ফুরিয়েছে। বাংলাদেশে এখন শুধু রোবট তৈরিই হয় না; রোবট নিয়ে রীতিমতো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা হয়। যেখানে প্রতিবছরই নতুন করে নিজের জাত চেনাচ্ছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে যাত্রা শুরু ২০১৮ সালে। ফিলিপাইনের ম্যানিলায় অনুষ্ঠিত সে আয়োজনে প্রথমবার অংশ নিয়েই স্বর্ণপদক জয়ের গৌরব অর্জন করে বাংলাদেশি রোবটবিদের দল। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও পঞ্চমবারের মতো রোবট অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়েছিল লাল-সবুজের দল। এবার ছিল আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডের ২৪তম আসর।
থাইল্যান্ডের ফুকেট শহরে এটি অনুষ্ঠিত হয়। এ অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ থেকে ১৪ সদস্যের একটি দল অংশ নেয়। ১২-১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত অলিম্পিয়াডটি অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে সারা বিশ্বের প্রায় দেড় হাজার খুদে রোবটবিজ্ঞানী অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশ থেকে এ অলিম্পিয়াডে অংশ নেয় ১৪ সদস্যের একটি দল। যারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে রোবট অলিম্পিয়াডের বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ নেয় এবং সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ একাধিক পদক লাভ করে। এ পদকগুলোর মধ্যে রয়েছে ১টি স্বর্ণপদক, ২টি রৌপ্য, ২টি ব্রোঞ্জ এবং ৮টি টেকনিক্যাল পদক।
রোবট ইন মুভির চ্যালেঞ্জ গ্রুপ থেকে একমাত্র স্বর্ণপদকটি জেতে বাংলাদেশ। এ গ্রুপের প্রতিযোগীরা হলেন- টিম অ্যাফিসিয়ানাদোসের সদস্য মাইশা সোবহান মুনা, সামিয়া মেহনাজ ও মার্জিয়া আফিফা পৃথিবী। আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে প্রতিযোগিতার জন্য একাধিক ধাপে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়েছে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র রোবটবিজ্ঞানীদের। গত ২৫-২৬ অক্টোবর বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াডের জাতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। সেখানকার রোবট ইন মুভি, ক্রিয়েটিভ ক্যাটাগরি ও ফিজিক্যাল কম্পিউটিং ক্যাটাগরির বিজয়ী সদস্যদের নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক দল নির্বাচনী ক্যাম্প আয়োজিত হয়। সেখানে রোবটিক্স বিষয়ে একাডেমিক ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরে যুক্ত একদল প্রশিক্ষক শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা যাচাই-বাছাই এবং রোবটিক্সের বিভিন্ন বিষয়ে অধিক প্রশিক্ষণ দেন। এরপর শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডের জন্য বাংলাদেশ দল নির্ধারণ করা হয়। সেই দলই এবার থাইল্যান্ডে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে।
আমরা খুবই আনন্দিত এ অর্জনে
আমাদের যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াডের মাধ্যমে, ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে। এসএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরপরই আমি ও আমার দলের সদস্য সামিয়া মেহনাজ একসঙ্গে কাজ করা শুরু করি। আমাদের জার্নিটা মূলত ছয় মাসের একটি ছোট জার্নি ছিল। রোবটিক্স আমাদের কাছে পুরোপুরি নতুন একটা বিষয় ছিল। তাই শিখতেও হয়েছে একদম বেসিক থেকে। প্রথমেই আমরা আরডুইনো-এর বেসিক সম্পর্কে ধারণা নেওয়া শুরু করি। তারপর পর্যায়ক্রমে বাকি সব জরুরি সেন্সর নিয়ে গবেষণা করি। এই গবেষণায় আমাদের সাহায্য করেন আরিফ ভাই, যার অবদান আমাদের সাফল্যের পিছনে অপরিসীম। প্রথমে জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় আমরা তিনটি রোবট তৈরি করে নিয়ে যাই এবং ‘রোবট ইন এ মুভি’ ক্যাটাগরিতে অংশগ্রহণ করি। সেখানে জাতীয় পর্যায়ে সিলভার মেডেল পেয়ে আমাদের মূল যাত্রা শুরু হয়। সর্বশেষ বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াড দ্বারা আয়োজিত দুইদিনের আবাসিক ক্যাম্পে আমরা আমাদের কর্মক্ষমতার প্রমাণ দিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশকে উপস্থাপন করার সুযোগ পাই। যে সুযোগটি করে দেন মেন্টর মিশাল ভাই। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের দলে আরও একজনÑ মার্জিয়া যোগদান করে। মিশাল ভাইয়া মূলত আমাদের তিনজনের কর্মদক্ষতা যাচাই করে দল গঠন করে দেন। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় আমরা আরও তিনটি রোবট তৈরি করি, সেই সঙ্গে রোবটে আরও কিছু বৈশিষ্ট্য যোগ করি। যার ফলে ‘রোবট ইন এ মুভি’ ক্যাটাগরির সাবথিম অনুযায়ী কাজ করতে সুবিধা হয়। আমাদের তিনজনের সহযোগিতা ও কর্মের ধরন ছিল অনেকটাই নির্ভুল। ফলে ২৪তম আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে আমরা সেরাটা দিয়ে দেশের জন্য স্বর্ণপদক আনতে সক্ষম হই।
মাইশা সোবহান, একাদশ শ্রেণি, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ
রোবটিক্সে অবদান রাখতে চাই
রোবটিক্সের প্রতি ছোটকাল থেকেই একটা আগ্রহ কাজ করত আমার। নানাবিধ কারণে কখনও অংশ নেওয়া হয়নি। তবে বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াডের একটি ওয়ার্কশপ হয় জাতীয় পর্বের ৩ মাস আগে। মায়ের কথায় সেখানে আমার যাওয়া। সেই ওয়ার্কশপ থেকে জাতীয় পর্বে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা বেড়ে যায় আমার। বাবা-মায়ের সাহায্য এবং আমার পরিশ্রমের ফলে জাতীয় পর্বে ‘ফিজিক্যাল কম্পিউটিং’ ক্যাটাগরিতে ব্রোঞ্জ পাওয়া হয়। ইন্টারন্যাশনাল দল যাচাই ক্যাম্পে যাওয়ার পর ‘রোবট ইন এ মুভি’ ক্যাটাগরিতে সামিয়া মেহনাজ এবং মাইশা সোবহানের সঙ্গে আমাদের ৩ জনের দল করে দেওয়া হয়। ইন্টারন্যাশনালে যাওয়ার কথা আগে কখনও ভাবিনি। তবে ইন্টারন্যাশনাল রোবট অলিম্পিয়াডে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার যেহেতু সুযোগ পেয়েছিলাম, তাই রোবটগুলোকে আরও বেশি জুতসই করার প্রচেষ্টা ছিল। আমি ২টি ক্যাটাগরিতে অংশ নেই। তাই অনেক সময় মানসিক চাপের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমাদের মেন্টর মিশাল ইসলাম ভাইয়া এবং পরিবারের মানুষজন থেকে পাওয়া সহযোগিতার কারণে আমাদের যাত্রাটা কিছুটা সহজ হয়ে গিয়েছিল। ইন্টারন্যাশনাল রোবট অলিম্পিয়াডে ‘ফিজিক্যাল কম্পিউটিং’-এ আমি ও আমার দলের সদস্য নুসাইবা তাজরিন তানিশা টেকনিক্যাল পদক পাই। এ ছাড়া ‘রোবট ইন এ মুভি’ ক্যাটাগরিতে সামিয়া মেহনাজ এবং মাইশা সোবহানের সঙ্গে স্বর্ণপদক অর্জন করি। রোবটিক্সের ক্ষুদ্র ইচ্ছা থেকে এতদূর যাওয়া আগে কখনও কল্পনা করিনি। দেশের জন্য স্বর্ণপদক আনা, বাবা-মায়ের এবং কাছের মানুষজনের খুশি আমাকে অনুপ্রাণিত করে ভবিষ্যতে রোবোটিক্সে নিজের প্রতিভা বৃদ্ধি করে এবং কিছু একটা অবদান রাখতে।
মার্জিয়া আফিফা পৃথিবী, দশম শ্রেণি, সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ
দেশের প্রতিনিধিত্ব করা গর্বের
আমার রোবটিক্সের যাত্রা শুরু হয় ২০২২ সালে। নানা ধরনের পাঠ্যক্রমবহির্ভূত কার্যক্রম অন্বেষণ করার মাধ্যমে আমার রোবটিক্সের প্রতি আগ্রহ জাগে। এসএসসি পরীক্ষা স্থগিত হওয়ায় আমার কাজিন মাইশা সোবহানের সঙ্গে ঠিক করেছিলাম রোবটিক্স কম্পিটিশনে অংশ নেব। সেই পরিকল্পনা থেকে আমাদের মেন্টর রাশেদুল হক আরিফ ভাইয়ার মাধ্যমে রোবটিক্সের বেসিক জানা হয়। তবে আমরা যে কম্পিটিশনের উদ্দেশ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, সেটি এসএসসি এক্সামের সময় হওয়ায় সেখানে অংশ নেওয়া হয়নি। তবে আমরা এক দিনের মধ্যে লক্ষ্য পরিবর্তন করে ফেলি এবং বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াডে অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা করি। এসএসসি পরীক্ষার পর এক মাসের মধ্যে আমরা বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াডের জাতীয় পর্বের জন্য প্রস্তুতি নেই। এ জন্য আমরা ৩টি রোবট তৈরি করি এবং ‘রোবট ইন এ মুভি’ ক্যাটাগরিতে রৌপ্য পদক পাই। জাতীয় পর্বের পর আবাসিক ক্যাম্পে আমাদের দুই জনের সঙ্গে মার্জিয়া আফিফা পৃথিবী যুক্ত হয়। ইন্টারন্যাশনালে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার একটা নীরব ইচ্ছা সব সময় মনে কাজ করত। সেই সুযোগ পেয়ে এবার রোবটিক্সের প্রতি আমার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। আমরা ইন্টারন্যাশনাল রোবট অলিম্পিয়াডের জন্য রোবটের কাজ বৃদ্ধি করে মোট ৬টি রোবট তৈরি করি। ইন্টারন্যাশনাল রোবট অলিম্পিয়াডে ‘রোবট ইন এ মুভি’তে যে স্বর্ণপদক পাব এটা আশা করিনি। এত কম সময়ে আমার বাবা-মা, ভাই এবং মেন্টরের অপরিসীম সাহায্যের মাধ্যমেই আমাদের পক্ষে এতটুকু করা সম্ভব হয়েছে। আজকের এই অর্জনে আমার মনের ইচ্ছা যেমন পূরণ হয়েছে; ঠিক তেমনই আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে সামনে রোবটিক্স নিয়ে আরও উল্লেখযোগ্য কিছু করতে।
সামিয়া মেহনাজ, একাদশ শ্রেণি, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ
উল্লেখ্য, রোবটিক্সের মেধা অন্বেষণে এই বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করা ১৪ শিক্ষার্থী হলেনÑ উইলিয়াম কেরি একাডেমির জাইমা, নেভি অ্যাংকরেজ স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাহরুজ, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শবনম, সানবিমসের নাশীতাত, উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ওমর, চিটাগাং গ্রামার স্কুল-ঢাকার লাবিব, ওয়াইডব্লিউসিএ উচ্চ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের তানিশা, ভাঙ্গুড়া পাবলিক স্কুলের শিক্ষার্থী হামীম, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মুনা ও মেহনাজ, রাজশাহী কলেজের পুষ্প, সাউথ পয়েন্ট স্কুলের পৃথিবী, মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের মাহির এবং চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের শিক্ষার্থী আবরার শহীদ।