উজ্জল মাহাতো
প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৪:২৮ পিএম
আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৪:৪১ পিএম
পৃথিবী থেকে প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের মুখের ভাষা। এমনও কিছু ভাষা আছে, যা সারা পৃথিবীতে একটি পরিবার জানে, একজন জানে। পৃথিবী ছাড়ছেন শেষ জানা ব্যক্তিও; যা খুবই সংকটের কথা। বাংলাদেশ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে নানান ভাষা ও সংস্কৃতির দেশ।
আমাদের দেশ তাই এত সুন্দর! এত বৈচিত্র্যময়। বাংলাদেশে মোট ৫০টির বেশি ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রয়েছে। প্রতিটি জাতিসত্তার রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। তারা এ ভাষা-সংস্কৃতি বুকে লালন করে যুগের পর যুগ বেঁচে আছে। বর্তমানে এ ভাষা-সংস্কৃতি হুমকির মুখে পড়েছে। পাহাড় ও সমতলের হাতেগোনা দু-একটি বাদে বেশিরভাগ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষা ও সংস্কৃতি প্রায় বিপন্নের পথে। মাহাতোদের কুড়মালি তেমনই একটি ভাষা। সমতলে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিসত্তা মাহাতো। এদের ভাষার নাম কুড়মালি, মোট ৮১টি গোত্র রয়েছে। সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, খুলনাসহ মোট ১৮টি জেলায় কমবেশি এদের বসবাস। তবে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ ও তাড়াশ উপজেলায় বেশিসংখ্যকের আবাস।
কুড়মালি সাহিত্যভান্ডার অনেক তথ্যসমৃদ্ধ। কুড়মালি ভাষায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা ‘বাড়কা হড়’, বাংলায় ‘মহামানব’ কবিতার দু-চার লাইন পড়া যাক-
‘বাইগার নেদিয়াক ধেরিয়ে, টুঙ্গীপাড়া গাঅয়ে জানমালহেক অনা বাড়কা হড়, শেখ মুজিব নামুয়ামে।/ছটুলেই হেলেক ওকঅর, সারদার সারদার ভাভুআ/গেরবিয়েনকেলে ওকর মানুয়ে, হেলেক ঢেইর জাঘুআ।’
আপাতদৃষ্টিতে দেখলে চর্যাপদের কোনো পদের অংশবিশেষ মনে হতে পারে। কিন্তু কুড়মালি তারও হাজার হাজার বছরের প্রাচীন ভাষা; এর শিকড় অনেক বিস্তৃত; অনেক গভীরে। এবার কবিতাটি পড়ে নেওয়া যাক বাংলায়। অনুবাদে বাংলা বর্ণমালায় লেখার ফলে কিছু কিছু শব্দ তার মাধুর্য হারায়।
‘বাইগার নদীর তীরে টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মেন একজন মহামানব শেখ মুজিব নামে। ছোট থেকেই ছিল তার নেতা নেতা ভাব, গরিব দুঃখীর জন্য তার মনে ছিল না জায়গার অভাব।’
বাংলাদেশে মাহাতোদের কুড়মালি ভাষা আজ বিপন্নের পথে। আমাদের বাংলাসহ মোট ৪১টি ভাষার মধ্যে কুড়মালি ভাষা নেই। কুড়মালি ভাষা অনেক তথ্যসমৃদ্ধ। এখানে রয়েছে নিজ ভাষায় অনেক গীত, ঝুমুর, ছড়া, প্রবাদ, গল্প প্রভৃতি; যা এ জনগোষ্ঠীর ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ভাষা-সংস্কৃতি শতাব্দীর পর শতাব্দী বহন করে চলেছে। এ জনগোষ্ঠীর মানুষ এ ভাষা-সংস্কৃতি পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে দৃঢ়ভাবে প্রতিজ্ঞ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সবার সুদৃষ্টি পেলে হয়তো পৃথিবী থেকে এ ভাষা-সংস্কৃতি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে।
লেখক : কুড়মালি ভাষার গবেষক, পরিচালক, কুড়মালি পাঠশালা, ভাষা-সংস্কৃতি শিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্র