মিলটন রহমান
প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৪:৪০ পিএম
বিভিন্ন ভাষার মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হলে সেসব ভাষার চর্চা এবং প্রসারের একটি পথ তৈরি হয়। আমার ভাষায় কীভাবে অন্য ভাষার মানুষের সঙ্গে কথা বলব, এমন একটি ধারণা বা দ্বিধা আমাদের মধ্যে কাজ করে।
এ দ্বিধা এবং ধারণা থেকে বের হওয়ার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে সাহিত্যচর্চায় এ ক্ষেত্রটি তৈরি হয়েছে বলে মনে করি। ব্রিটেনে এ বিষয়টি ভীষণ উপভোগ করি। যখন বাংলায় কবিতা পাঠ করার আমন্ত্রণ পেতাম, দ্বিধা ছিল কীভাবে অন্য ভাষার দর্শক-শ্রোতাদের সামনে বাংলা ভাষায় লেখা কবিতা বা গল্প পাঠ করব! সে দ্বিধা ঝেড়ে ফেলতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। বিলেতের মূলধারার কয়েকটি অনুষ্ঠানে কবিতা-গল্প পাঠ করে দেখলাম সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছে এবং অনুষ্ঠান শেষে মন্তব্যও করছে। সে যে কী আনন্দের, তা অনুষ্ঠানে উপস্থিতিরাই বলতে পারবেন।
আমরা ইংরেজি কিংবা অন্য ভাষার কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেলে কবিতা কিংবা গল্পের মূল বাংলায় এবং ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে যাই। প্রথমে বাংলা পাঠ করি, পরে ইংরেজি অনুবাদ। পাঠ শুরু করার আগে সংক্ষিপ্ত ভূমিকা দিই ইংরেজিতে। পাঠ শেষে কেউ কেউ বলেন, ‘তোমার বাংলা পাঠ ভালো লেগেছে।’ আমার বিস্ময়ের শেষ থাকত না, তিনি কীভাবে বুঝলেন! আমরা তো জানিই বিশ্বসাহিত্যের অন্তর্গত ভাষা এক। তা হচ্ছে ভাব ও প্রকাশ। বাংলা ভাষায় কবিতা পাঠের সময় পাঠকের মুখাবয়বে যে অভিব্যক্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা-ই সাহিত্যের অন্তর্গত ভাষা। এ ভাষাই একজন শ্রোতা বা দর্শককে ভিন্ন ভাষা বুঝতে সহায়তা করে। আমরা যেভাবে সহায়ক ভাষা হিসেবে ইংরেজির আশ্রয় নিই। এর মধ্য দিয়ে একটি বিষয় মনে হয়েছে, একটি ভাষার জন্য অন্য একটি ভাষা হারিয়ে যায় না, বরং দীর্ঘ স্থায়িত্ব পায়।
আরেকটি বিষয়ের অবতারণা করতে চাই। তা হচ্ছে অনুবাদ। বিলেতে আমরা মূলধারার কবিদের সঙ্গে অনুবাদকর্ম করি। কখনও কখনও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অনুবাদের কাজ করি। তখনও কবিতা অনুবাদ করার সময় বাংলাকেই প্রাধান্য দিই। প্রথমে কবিতার একটি লাইন থেকে একটি শব্দ নিই। সেই শব্দের বিভিন্ন অর্থ দাঁড় করাই। ইংরেজ অনুবাদক বন্ধুর কাজ হলো জুতসই শব্দটি বেছে নেওয়া। এভাবে একটি বিশ্বস্ত অনুবাদ তৈরি হয়। এখানেও ভাষার শক্তি এক হয়ে নতুন একটি গতি সঞ্চার করে কাব্যভাষায়। এটাই হচ্ছে ভাষার শক্তি।
কারও কারও ধারণা, অনাবাসে যারা থাকেন তাদের পক্ষে বাংলা ভাষা বা সাহিত্য চর্চা দুরূহ। তা মোটেই নয়। ব্রিটেনে এখন প্রায় ৮ লাখ বাংলাদেশির বাস। রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বিপুলসংখ্যক মানুষ। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় রয়েছে বিপুল গতি। এরা নিজেদের অনুষ্ঠান বাংলা ভাষায়ই করে। কোনো কোনো সংগঠনকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অনুদানও দেয়। ব্রিটেনে বসে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার জন্য এ দেশের সরকারের যে পৃষ্ঠপোষকতা, তা আমাদের দেশেও নেই। এ ছাড়া কমিউনিটির বিভিন্ন সংগঠন রয়েছে, যারা বাংলা স্কুল পরিচালনা করে। কোনো কোনো সংগঠন গানের স্কুল পরিচালনা করে। ফলে নতুন প্রজন্মের কিছু শিল্পীকে এখন বিলেতের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করতে দেখি। তাদের গান শুনে মনে হয়, ব্রিটেনে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা ক্রমান্বয়ে বেগবান হচ্ছে।
ব্রিটেনে বাংলা ভাষা চর্চায় প্রতিবন্ধকতা নেই, বরং রয়েছে সম্ভাবনা। দেশটির সরকারও চায় বিভিন্ন ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে। পৃথিবীর প্রায় ৩০০ ভাষার মানুষ বসবাস করে ব্রিটেনে। প্রতিটি ভাষাই সমান গুরুত্বে টিকিয়ে রেখেছে অনাবাসী কমিউনিটিকে। বাংলা ভাষা তার মধ্যে অন্যতম।
লেখক : কবি, কথাসাহিত্যিক, গবেষক ও সাংবাদিক, লন্ডন