× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

আদিবাসী ভাষা ও সাহিত্য

মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা

প্রকাশ : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১২:৫৮ পিএম

আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৩:০০ পিএম

চিত্রকর্ম: প্রতীক্ষা-৩৯	শিল্পী: কনক চাঁপা চাকমা

চিত্রকর্ম: প্রতীক্ষা-৩৯ শিল্পী: কনক চাঁপা চাকমা

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর অনেক মানুষের বসবাস। ভাষা ও সংস্কৃতির ভিন্নতায় স্বকীয়তা রয়েছে সবার। তাদের সেই ভাষা হুমকির মুখে থাকলেও অনেক ভাষা এগিয়ে যাচ্ছে, হচ্ছে সাহিত্য চর্চায়ও। বাংলাদেশে এইসব ভাষায় সাহিত্য চর্চার সমস্যা ও সম্ভাবনার সন্ধানের প্রয়াস থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রাক্কালে এই লেখা...


২০১৯ সালটি ছিল ‘আদিবাসী ভাষাবর্ষ’। জাতিসংঘ বিশ্বের বিপন্নপ্রায় আদিবাসী ভাষাসমূহের পুনরুজ্জীবন, সুরক্ষা, বিকাশ ও প্রসারে বিশ্বের জাতিরাষ্ট্রগুলোর মনোযোগ আকর্ষণের উদ্দেশ্যে ২০১৯-কে আদিবাসী ভাষাবর্ষ হিসেবে ঘোষণা করে। পৃথিবীব্যাপী বিলুপ্তপ্রায় আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এবং সেই সঙ্গে ভাষাগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক সৃষ্টি, সমঝোতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘ ২০১৯ সালকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষাবর্ষ হিসেবে ঘোষণা করে। ‘আন্তর্জাতিক বর্ষ’ ঘোষণা জাতিসংঘের সংহতি ও সহযোগিতামূলক একটি কাঠামো। বছরটিকে একটা নির্ধারিত বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য উৎসর্গ করা হয়। জাতিসংঘ যখন ‘আন্তর্জাতিক বর্ষ’ হিসেবে কোনো বিশেষ বছরকে ঘোষণা করে, তখন সে বিষয়কে ঘিরে সেই বছরটিতে নানা উদযাপনের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। প্রতিপাদ্য সেই বিষয়কে বৈশ্বিক ভাবনা এবং বিশ্বের সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশ্বের আদিবাসী জাতিসমূহ তাদের নিজ নিজ দেশে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উভয় দিক দিয়ে পশ্চাৎপদ অবস্থানে রয়েছে। এই পশ্চাৎপদ ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, ভাষাগত ও ঐতিহ্যগত নানা দিক দিয়ে সংগঠিত হয়ে থাকে। অথচ সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের পাদপ্রদীপ থেকে আড়ালে থাকা এই আদিবাসী জাতিসমূহ কেবল পরিবেশ ও প্রতিবেশের অভিভাবকই নয়, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের বৈচিত্র্যের ঐক্যতানকে সমৃদ্ধ করে, ক্ষেত্রবিশেষে সংশ্লিষ্ট দেশের জ্ঞানব্যবস্থা চর্চা ও বাচনিক যোগাযোগব্যবস্থাকে প্রতিনিধিত্ব করে। জাতীয় উন্নয়ন, শান্তি স্থাপন ও জাতি গঠনে তাদের এই অবদান অধিকাংশ দেশেই স্বীকৃতির অন্তরালে থেকে যায়। কোনো কোনো প্রগতিশীল রাষ্ট্র আবার এসব অকৃত্রিম সংস্কৃতি সুরক্ষায় নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। ভাষাবর্ষের কার্যক্রম চলাকালেই ২০১৯ সালেই ২০২২ থেকে ২০৩২ সময়কালকে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা দশক’ ঘোষণা করা হয়। এই দশককে ঘিরে বিশ্বের বিভিন্ন আদিবাসী জাতিসত্তা আবারও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে, নতুন উদ্যমে জেগে উঠবে তাদের ভাষা, সম্প্রসারিত হবে তাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতি। 

ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০-এর সংশোধনী তফসিল অনুসারে বাংলাদেশে ৫০টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা প্রায় ৩৮টি ভাষায় কথা বলে। ২০১৮ সালে সম্পাদিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের নৃভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা অনুসারে দেশে প্রায় ৪১টি ভাষা রয়েছে, যার মধ্য থেকে বাংলা, ইংরেজি ও উর্দু ভাষা বাদ দিলে ৩৮টিই দেশের বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা। এই সমীক্ষা অনুসারে দেশের ১৪টি ভাষা বিপন্নতার শেষ সীমায় অবস্থান করছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এবং এই ইনস্টিটিউটের অধীনে সম্পাদিত নৃভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার দলনেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সৌরভ সিকদারের বরাত দিয়ে ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে সময়ের আলো পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়Ñ এসব বিপন্ন ভাষাগুলোর মধ্যে রেংমিটচা ভাষা ৪০ জন, কডা ভাষায় ৬০০-৭০০ জন, কন্দ ভাষায় ৬০০-৭০০ জন, লুসাই ভাষায় ৯৫৯ জন, খাড়িয়া ভাষায় ১ হাজার জন, সৌরা ভাষায় ১ হাজার জন, লালেং বা পাত্র ভাষায় ২ হাজার ৩৩ জন, পাংখোয়া ভাষায় ২ হাজার ২৭৪ জন, চাক ভাষায় ২ হাজার ৮৩৫, কোল ভাষায় ২ হাজার ৮৪৩ জন, খুমি ভাষায় ৩ হাজার ৩৬৯ জন, খিয়াং ভাষায় ৩ হাজার ৮৯৯ জন, মালতো ভাষায় ৮ হাজার জন ও মুন্ডারি ভাষায় ৩৮ হাজার ২১২ জন ভাষিক জনসংখ্যা রয়েছে ( দেখুন : বিপন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা; এম মামুন হোসেন, সময়ের আলো, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২)। অন্যদিকে ‘লহড়া’ নামের জয়পুরহাট ও রাজশাহী অঞ্চলের একটি ভাষায় মাত্র ২১৫ জন মানুষ কথা বলেন। তবে বিপন্নতার এই মাত্রা বর্তমানে আরও অধিক ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছে। ইনস্টিটিউটের সমীক্ষার কাল ছিল ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত। সমীক্ষাকালে গবেষকরা ৪০ জন রেংমিটচা ভাষীর সন্ধান পান। গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে বিডিনিউজ২৪ ডট কমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রেংমিটচা ভাষা গবেষক ইয়াংঙান বলেন, ‘২০১৩ সালেও কয়েকটি পাড়ায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ২২ জন রেংমিটচা ভাষাভাষীর লোক পাওয়া গিয়েছিল। আট বছরের ব্যবধানে ২০২১ সালে এসে সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ছয় জনে। বাকিরা মারা গেছেন।’ ( দেখুন : bangla.bdnews24.com ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২)। উল্লেখ্য, এই ছয়জন রেংমিটচাভাষী মানুষের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি হলেন লক ম্রো, যাঁর বয়স এ বছর ৫৬ হবে। 

বাংলাদেশের যেসব আদিবাসী জাতিসত্তার নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে সেগুলোর মধ্যে চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, রাখাইন, মৈতৈ মণিপুরী, সাঁওতাল, ম্রো ইত্যাদি অন্যতম। গারো, খাসি, বম, খুমি, পাংখোয়া, লুসাই, ককবরক, সাঁওতাল (আংশিক) ইত্যাদি ভাষা লেখা হয় আত্তীকৃত রোমান বর্ণমালায়। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, কোল, হাজং, সাঁওতাল (আংশিক), মুন্ডা, সাদরিসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভাষা লেখার জন্য ব্যবহার করা হয় বাংলা বর্ণমালা। 

বাংলাদেশের আদিবাসী সাহিত্যচর্চায় অবিমিশ্র চিত্র দৃশ্যমান। এখানে মৌখিক সাহিত্যের প্রবল উপস্থিতি যেমন সহজে চোখে পড়ে, তেমনি আধুনিক সাহিত্যচর্চা তথা যাপিত জীবনে চর্চিত নানা অনুষঙ্গের গণ্ডি ছাড়িয়ে উত্তর-ঔপনিবেশিক সমন্বয়বাদিতা চর্চার প্রবণতা কিংবা ঐতিহ্যগত ও পরম্পরাগত সাহিত্যের ধারার শেকল ভাঙার মানবিক সৃজনশীলতার সংযোগ ও সমীকরণের অদম্য প্রচেষ্টার দৃষ্টান্তও তেমন কম নয়। অধিকার সচেতনতার জোয়ার পর্বের ফলে আদিবাসী সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে রয়েছে রাজনৈতিক চেতনার প্রয়াস। রয়েছে জাতি-ভাষা-সংস্কৃতি-জীবিকা-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের অনুষঙ্গ হতে উৎসারিত বর্ণাঢ্য সাহিত্যকর্ম। 

আদিবাসীদের সাহিত্যচর্চা মৌখিকভাবেই বেশি প্রচলিত হলেও কালের বিবর্তনে আধুনিক সব অনুষঙ্গ বিকাশ লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে আদিবাসীদের সাহিত্যধারাও বিকশিত হতে থাকে। প্রকৃতির সঙ্গে আদিবাসী জীবনধারার সংশ্লিষ্টতা অতি ঘনিষ্ঠ। এখানে মানুষ আর প্রকৃতি চলে নিয়ত মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। তাই ধর্মীয় অনুষ্ঠান, আচার-উপাচার, গৃহকর্ম, চাষাবাদ, স্রষ্টার স্তুতি, শক্তি বন্দনা, তান্ত্রিক চর্চা, জন্ম- মৃত্যু, বিবাহ সবকিছুকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে নৃত্য-গীত, পালাগান, লোকগান, লোকছড়া, লোককাহিনি ও লোকসাহিত্য। এসব লোকসাহিত্যের ধারাই আদিবাসী সাহিত্যের সূতিকাগার। চাষাবাদ করতে গিয়ে, যূথবদ্ধভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করতে গিয়ে, কিংবা ঘাটে জল আনতে বা স্নান করতে গিয়ে মুখে মুখে রচিত হয়েছে নানা কাহিনি, ছড়া, গান, নীতিবাক্য ও গীতিকবিতা। যুবক-যুবতীর হেঁয়ালি বাক্যালাপ কিংবা প্রেম-বিরহের ফলশ্রুতিতেও সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য লোকগীতি, লোকগাঁথা ও অমর কাহিনি। সেই সঙ্গে পরিবেশ ও প্রতিবেশের অনুষঙ্গ গাছগাছালি কিংবা প্রকৃতির সন্তান পশুপাখিকে নিয়েও রচিত হয়েছে কালজয়ী নানা কাহিনি, নীতিকথা ও রূপকথা।

বাংলাদেশের সবচেয়ে অগ্রসর আদিবাসী ভাষা হলো চাঙমা বা চাকমা। জনসংখ্যা ও শিক্ষাদীক্ষায় অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠী হতে অগ্রসর হওয়ায় বাংলাদেশের চাকমা জনগোষ্ঠীর সাহিত্য অন্যদের তুলনায় কিছুটা অগ্রসর। চাকমা সাহিত্যের আদিরূপের মধ্যে বারোমাসী উপাখ্যান অন্যতম। মঙ্গলকাব্যের বারোমাসী বিবরণের আদলে মুখে মুখে রচিত এসব বারোমাসীর মধ্যে সান্দবি বারোমাসী, কির্বাবি বারোমাসী, মেয়াবি বারোমাসী, তান্যাবি বারোমাসী, কালেশ্বরি বারোমাসী, মা-বাবঃ বারোমাসী ইত্যাদির নাম উল্লেখ করার মতো। চাকমা লোকসাহিত্যের জনপ্রিয় পালাগুলোর মধ্যে প্রেমধর্মী পালাগান রাধামন-ধনপুদি পালা, চাটিগাং ছাড়া পালা, লক্ষ্মী পালা, নরধন-নরপুদি পালা, সনাধন-পানপুদি পালা, কুগীকাবা পালা, তান্যাবি পালা অন্যতম। চাকমা চারণশিল্পী গেংখুলি শিল্পীরা রাত জেগে পরিবেশন করে এসব পালাগান। আর্থিক প্রাপ্তির চেয়ে মানসিক তৃপ্তির জন্যেই চাকমা চারণ কবিরা এসব পালা পরিবেশন করে থাকেন।

চাকমা সাহিত্যের ক্রমবিকাশকে প্রয়াত কবি সুহৃদ চাকমা কাল বিবেচনায় তিন যুগে বিভাজন করেছেন। তার ‘চাকমা সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ’ প্রবন্ধে তিনি ১৩০০ হতে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ সময়কালকে চাকমা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ, ১৬০০ হতে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ সময়কালকে মধ্য যুগ এবং ১৯০০ সাল হতে শুরু হয়েছে আধুনিক যুগ। সদ্য প্রয়াত নাট্যব্যক্তিত্ব ড. আফসার আহমদ চাকমা সাহিত্য বিকাশের ধারাকে আবার চারটি যুগে বিভাজন করেছেন। তিনি কবি সুহৃদ চাকমার যুগবিভাজনের সঙ্গে আরও ৩০০ বছরের ব্যাপ্তি যোগ করে ১১০০ হতে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ সময়কালকে প্রাচীন যুগ, ১৩০০ হতে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দকে আদি মধ্যযুগ, ১৬০০ হতে ১৯০০ সালকে অন্ত্যমধ্যযুগ এবং ১৯০০ সাল হতে বর্তমান সময়কালকে আধুনিক যুগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় চাকমা ভাষার সাহিত্য স্বতন্ত্র ভাষারীতি বিনির্মাণ ও জাতিসত্তার অস্তিত্বের সংগ্রাম, যাপিত জীবন হতে আহরণ করে মৌখিক সাহিত্যের বিকাশ, মৌখিক সাহিত্য হতে লিখিত সাহিত্যের দিকে ভ্রমণ, প্রাচীন পালা, গীতিকাব্য, উভগীদ, গেংখুলি হতে লিখিত সাহিত্যচর্চা বিকশিত হয়েছে। চাকমা সাহিত্যের অন্ত্যমধ্যযুগে সৃষ্টি হয় লিখিত সাহিত্যের অমর সৃষ্টি সাধক কবি শিবচরণের ‘গোজেন লামা’। এরপর চাকমা সাহিত্য নিজস্ব রীতি, রূপ, আদল নিয়ে সদম্ভে এগিয়ে যেতে থাকে। বিংশ শতাব্দীতে এসে চাকমা সাহিত্যের ডালপালার বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। ফিরিং চান্দের ‘আলঝি মিলের কবিতা’ আলোড়ন তোলে চাকমা সৃজনশীল চর্চার আসরে। চাকমা রানী বিনীতা রায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হয় বিশ্বকবির দেওয়ার নাম ‘গৈরিকা’ পত্রিকার। যার হাত ধরে পথচলা শুরু হয় শিল্পী চুনীলাল দেওয়ানের মতো তাবৎ আধুনিক চাকমা কবিদের।

চাকমা কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে অশোক কুমার দেওয়ান, বিরাজ মোহন দেওয়ান, সুগত চাকমা ননাধন, ডা. ভগদত্ত খীসা, রাজা দেবাশীষ রায়, ফিরিং চান, চুনীলাল দেওয়ান, সলিল রায়, মুকুন্দ তালুকদার, ফেলাজেয়া চাকমা, বিজয় কেতন চাকমা, শ্যামল তালুকদার, কৃষ্ণ চন্দ্র চাকমা, সুহৃদ চাকমা, দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমা, বারেন্দ্র লাল চাকমা, কবিতা চাকমা, অমর শান্তি চাকমা, তরুণ কুমার চাকমা, বীর কুমার চাকমা, জগৎ জ্যোতি চাকমা, সজীব চাকমা, জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, দীপংকর তালুকদার, ড. সুধীন কুমার চাকমা, সুপ্রিয় তালুকদার, প্রফেসর বোধিসত্ত দেওয়ান, শিশির চাকমা, মৃত্তিকা চাকমা, ঝিমিত ঝিমিত চাকমা, সীমা দেওয়ান, কিশলয় চাকমা, রোনাল্ড চাকমা, পদ্মলোচন চাকমা, নিকোলাই চাকমা, রিপ রিপ চাকমা, মধুমঙ্গল চাকমা, মানস মুকুর চাকমা, সুরেশ চন্দ্র চাকমা, সুসময় চাকমা, আনন্দ মোহন চাকমা, শুভ্র জ্যোতি চাকমা, নিউ হ্যাপি দেওয়ান, আনন্দ বিকাশ চাকমা, আনন্দ জ্যোতি চাকমা, আর্যমিত্র চাকমা, দেব প্রিয় চাকমা, আলোময় চাকমা, কে ভি দেবাশীষ চাকমা, ইনজেব চাকমা, প্রগতি খীসা, অশোক কুমার চাকমা, প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। চাকমা সাহিত্য বিকাশে জুমিয়া ভাষা প্রচার দপ্তর (জুভাপ্রদ), জুম ইসথেটিকস কাউন্সিল (জাক), চাঙমা সাহিত্য বাহ, বনযোগীছড়া কিশোর কিশোরী কল্যাণ সমিতিসহ অনেক সহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নিরলসভাবে অবদান রেখে চলেছে।

মারমা সাহিত্য বিকাশের ধারা গড়ে উঠেছে ধর্মচর্চাকারী বুদ্ধসাধকদের হাত ধরে। আদিকাল থেকেই ‘পী’ নামের তালপাতার মতো দেখতে একটি গাছের পাতায় লিখে মারমা ভাষাবিশারদরা সংগ্রহ করতেন নানা তন্ত্র-মন্ত্র, উপদেশবাণী, নীতিকথা, ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ। পুংব্রাং, কাপ্যা বা কেপ্যা, পাংখুং, চাগায়াং, সাগ্রাং, রদুঃ, লাঙ্গা, সাইংগ্যাই, লুংদি লোকসংগীত, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য মারমা সমাজে প্রচলিত রয়েছেÑ যেগুলোর উপজীব্য বিষয় হলো উপদেশমূলক গান, ধর্মীয় উপাখ্যান, গৌতমবুদ্ধের জীবনী, লোককাহিনি, রূপকথা ইত্যাদি।

উক্য জেন, প্রফেসর মংসানু চৌধুরী, অংসুই মারমা, বীর মুক্তিযোদ্ধা মংসাথোয়াই চৌধুরী, মংসুইচিং চৌধুরী, মংপ্রু চৌধুরী, চিংলামং চৌধুরী, রেপ্রু চাই মারমা বাবু, অংসুই মারমা, মংক্য শোয়েনু নেভী, সাথোয়াই মারমা, অংচাইরী মারমা, চাই সুই হ্লা মারমা, নিংঅং মারমা, মংজবু, মনতোষ মারমা, এস এ প্রু, ক্য শৈ হ্লা, উ চ হ্লা, ক্য শৈ প্রু, চ থুই ফ্রু, ক্য মাং উ প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক প্রতিনিয়ত অবদান রেখে চলেছেন মারমা সাহিত্য বিকাশে। 


আধুনিক মারমা সাহিত্য বিকাশের ধারায় নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করছেন চিংলামং চৌধুরী ও ঞোহ্লামং-এর মতো অগ্রসর লেখক। চিংলামং চৌধুরীর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ সময় সেতু পথে [২০২০] সম্ভবত মারমা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম আধুনিক কাব্যগ্রন্থ। কবি, গীতিকার ও প্রবন্ধকার অংসুই মারমা লিখেছেন চাবাই মগ [২০১৯] ও লুঃম্রাইত (মহৎজীবন) নামক দুটো বই। ঞোহ্লামং লিখেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামে মূল্যবোধ চর্চা [২০২১] ও ভ্যানওয়ালার হাতে বাংলাদেশ [২০২২]।

বাংলাদেশের মনিপুরী সাহিত্য অন্যতম সমৃদ্ধ সাহিত্য। প্রখ্যাত লেখক, গবেষক, কবি এ কে শেরাম তাঁর মনিপুরী সাহিত্য : অনুদঘাটিত এক গোপন ঐশ্বর্য প্রবন্ধে লিখেছেন, “বাংলাদেশে মনিপুরী বসতি স্থাপনের ব্যাপ্তিকাল প্রায় তিন শ’ বছরের হলেও বাংলাদেশের মনিপুরী সাহিত্যচর্চার আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত ১৯৭৫ সালে ‘বাংলাদেশ মনিপুরী সাহিত্য সংসদ’ গঠন ও সংসদের মুখপত্র ‘দীপান্বিতা’ (পরে ‘মৈরা’ নামে প্রকাশিত) প্রকাশের মাধ্যমে।” এছাড়া মিৎকপথোকপা (বর্তমানে ‘ইথিল’ নামে প্রকাশিত), শজিবু, ইপোম ইত্যাদি সাহিত্য সংকলন মনিপুরী সাহিত্য বিকাশে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। এ কে শেরামের কাব্যগ্রন্থ ‘বসন্ত কুন্নিপালগী লৈরাং’, শেরাম নিরঞ্জনের কাব্যগ্রন্থ ‘মঙ মপৈ মরক্তা’, ‘অতোপ্পগী পিরাং’, ‘নাতৈ চাদ্রবা পৃথিবী’ প্রবাদগ্রন্থ ‘ফরংজাই ওয়াখল’, হামোম প্রমোদের কাব্যগ্রন্থ ‘ওয়াখলগী নাচোম’, ‘মনিপুরী দর্পণ’ (সম্পাদিত), সনাতন হামোমের কাব্যগ্রন্থ ‘লৈনম য়াওদ্রিবী লৈরাং’, ‘থওয়ায়গী নুংশিরৈ’, ও ‘মঙ মরক্তা’, মুতুম অপুর ‘এক বসন্তের ভালবাসা’ (সম্পাদিত) ও কাব্যগ্রন্থ ‘লৈরাংগী লৈরোং’, এ কে শেরামের ছোটগল্প গ্রন্থ ‘নোঙ্গৌবী’ ও ‘বাংলাদেশের মনিপুরী কবিতা’ (সম্পাদিত), খোইরোম ইন্দ্রজিতের প্রবাদ সঙ্কলন ‘মচু নাইরবা মঙ’ ও কাব্যগ্রন্থ ‘ইন্নাফি’ ব্ংলাদেশে মনিপুরী সাহিত্যকে প্রতিনিধি করছে গৌরবের সঙ্গে ।

বাংলাদেশে মনিপুরী সাহিত্যচর্চায় আরও যেসব নাম অবশ্য উল্লেখ্য তাঁরা হলেন- থোকচোম সোনামনি সিংহ, থোংখাতাবম নবকিশোর শর্মা, থোকচোম মনিহার সিংহ, শান্ত খুমন, খোইরোম কামিনীকুমার, কারাম নীলবাবু, শেরাম শরৎ, এল পদ্মমনি, এন শ্যামল, এন যোগেশ্বর অপু, নামব্রম শংকর, কন্থৌজম সুরঞ্জিত, থোঙাম সঞ্জয় প্রমুখ। ( দেখুন- মনিপুরী সাহিত্য : অনুদঘাটিত এক গোপন ঐশ্বর্য; এ কে শেরাম; tayabs.wordpress.com)

ত্রিপুরাদের সাহিত্য মৌখিক সাহিত্য থেকে লিখিত সাহিত্যে বিকাশ লাভ করেছে ত্রিপুরা সাধু-সন্ন্যাসীদের হাত ধরে। সমাজে গীতিকাব্য, উপাখ্যান, পালাগান, লোকগীতি ইত্যাদিই ত্রিপুরাদের মাতৃভাষা ককবরকে সাহিত্যচর্চার সূতিকাগার। এই কাহিনিগুলো মূলত গাওয়া হতো বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় পালা-পার্বণে। ব্রিটিশ আমলের শেষ প্রান্তে এসে তৎকালীন ত্রিপুরা মহারাজাদের শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে ত্রিপুরা সাধকশ্রেণি আধ্যাত্মিক সংগীতকে সাধারণ মানুষের মন জয় করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন। সেই সময়েই মূলত শুরু হয় মাতৃভাষায় আধ্যাত্মিক সংগীত প্রচারের মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরির। এই পর্বকে বাংলাদেশের ককবরক সাহিত্য বিকাশের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় যুগ হিসেবে ধরা যায়। বাংলাদেশের ককবরক সাহিত্য বিকাশের ধারাকে চারটি যুগে বিভাজন করা যায়। গীত-উপাখ্যানের যুগ- যা স্মরণাতীত কাল থেকে ১৯০০ সাল পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত, আধ্যাত্মিক সংগীতের যুগ- যা ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত বিস্তৃত, ককবরক সাহিত্যের জোয়ারপর্ব- যার শুরু আশির দশক হতে, সান্তুআ’র যুগ- ৯০ দশক থেকে এই যুগের সূচনা, যার হাত ধরে ককবরক সাহিত্য আধুনিক সাহিত্যে রূপ পরিগ্রহ করেছে। 

ককবরক সাহিত্যের আদিরূপ ছিল মূলত লোকগীতি, পূজা-অর্চনার তন্ত্র-মন্ত্র। গীতিকাব্য ও উপাখ্যানগুলোর মধ্যে পুন্দা তান্নাই, কুচুক হা সিকাম কামানি, খুম কামানি, গাঁ তলিঅ থাঁমানি ইত্যাদি লোকমুখে বহুল প্রচলিত ও নন্দিত। এরপর ত্রিপুরা কবি-সাহিত্যিকরা সংকলন করতে শুরু করেন লোকগাঁথা, আধ্যাত্মিক সংগীত, বৈষ্ণব সংগীত, সাহিত্য সাময়িকী ইত্যাদি। এ সময় ককবরক লিখিত সাহিত্যের ছোট্ট বীজ অঙ্কুরিত হয়ে যেন শাখা-প্রশাখা প্রসারিত করতে শুরু করে। ১৯৩৬ সালে মতান্তরে ১৯৪২ সালে সাধক কবি খুশীকৃষ্ণ ত্রিপুরা ওরফে বলংরাই সাধু ৩৩টি আধ্যাত্মিক গান সংকলন করে প্রকাশ করেন ‘ত্রিপুরা খাকাচাংমা খুম্বারবাই’। এরপর ককবরক সাহিত্যের আকাশে আবির্ভূত হন সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, বরেন ত্রিপুরা, মহেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, ব্রজনাথ রোয়াজা প্রমুখ। পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে সাহিত্য সৃষ্টির এই জোয়ার সহজেই দোলা দিয়ে যায়। নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, প্রভাংশু ত্রিপুরা, লিয়ন ত্রিপুরা, প্রশান্ত ত্রিপুরা, কাবেরী ত্রিপুরা, সুরেন্দ্রনাথ রোয়াজা, প্রশান্ত কুমার ত্রিপুরা, দীনময় রোয়াজা, লাল দেনদাক, চিরঞ্জীব ত্রিপুরা, সুরেশ ত্রিপুরা, মঞ্জুলাল ত্রিপুরাম কুহেলিকা ত্রিপুরাম রঘুনাথ ত্রিপুরা, উল্কা ত্রিপুরা, শ্রাবণী রোয়াজা, দীপক ত্রিপুরা, সুনীতি রঞ্জন ত্রিপুরা, অনিল চন্দ্র ত্রিপুরা, মায়াদেবী ত্রিপুরাম কৃষ্ণ ত্রিপুরা, হিরণ্ময় রোয়াজা। ১৯৯১ সালে ‘সান্তুআ’ নামের একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয় প্রশান্ত ত্রিপুরার সম্পাদনায়। পরে প্রশান্ত ত্রিপুরা ও শক্তিপদ ত্রিপুরা যৌথ সম্পাদনায় ‘সান্তুআ জার্নাল’ নাম ধারণ করে পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে নিয়মিতভাবে। এর মধ্যে এই পত্রিকার সম্পাদনায় সম্পৃক্ত হন নানা কবি-সাহিত্যিক। বর্তমানে নবলেশ্বর দেওয়ান ত্রিপুরার সম্পাদনায় প্রকাশিত হচ্ছে অনিয়মিতভাবে। এই পত্রিকার বদৌলতেই আমরা সালকামৗং ত্রিপুরা, গীতা দেববর্মণ, অপুল ত্রিপুরা, ব্রজ কিশোর ত্রিপুরা, মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা, রত্না বৈষ্ণব, মন্ত্রজয় ত্রিপুরা, বিদ্যুৎ শংকর ত্রিপুরা, খুমুই ত্রিপুরা, হরিপূর্ণ ত্রিপুরা, দয়ানন্দ ত্রিপুরাম প্রতিবা ত্রিপুরাম তর্ক কুমার ত্রিপুরা, তপন ত্রিপুরা, লিপিকা ত্রিপুরা, পিপিকা ত্রিপুরা, বিনয় কুমার ত্রিপুরা, নির্মলা ত্রিপুরা, ফাল্গুনী ত্রিপুরা, সূরযব্রত ত্রিপুরা, নবলেশ্বর ত্রিপুরা, অমল বিকাশ ত্রিপুরা, জগদীশ রোয়াজা, জয় প্রকাশ ত্রিপুরা, সৃজনী ত্রিপুরা, প্রিয়াংকা পুতুল প্রমুখ লেখককে পাই। এ ছাড়াও ত্রিপুরা সাহিত্যিকদের মধ্যে নিজ নামে পরিচিত প্রাবন্ধিক অরুনেন্দু ত্রিপুরা, বিধান ত্রিপুরা, উজ্জ্বল ত্রিপুরা, মুকুল কান্তি ত্রিপুরা, মলয় কিশোর ত্রিপুরা, কবি ও ঔপন্যাসিক বিএল, ত্রিপুরা, রোকেয়া পদক বিজয়ী লেখক শোভা রানী ত্রিপুরা, রঘুনাথ ত্রিপুরা প্রমুখের নাম উল্লেখ না করলে এই আলোচনা পূর্ণাঙ্গতা পাবে না।

ত্রিপুরাদের সাহিত্য বিকাশে বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ কর্তৃক প্রকাশিত পূব-ই রাবাইনি সাল, বিচক, রুয়াং, জরা, তাংজরা, ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরামের বানৌক, বৈসু, হামকরাই, হমাচাং, ওয়াকরাইসহ যাবতীয় সংকলনও নতুন প্রজন্মকে লেখালেখির ক্ষেত্র দিয়ে ককবরক সাহিত্যকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছে।

ম্রো জনগোষ্ঠীর মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত নাম মেনলে ম্রো। মেনলে ম্রো মূলত ৮০ দশকের শুরুতে ক্রামা নামের একটি ধর্ম ও একটি বর্ণমালা প্রবর্তন করে ম্রো জাতিকে একটি নতুন দিশা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে তাঁর প্রবর্তিত বর্ণমালা ও ধর্ম ম্রো জনগোষ্ঠীর মাঝে সম্প্রসারণের চেষ্টা অব্যাহত রাখেন নতুন প্রজন্মের সমাজপতিগণ। ম্রো সাহিত্যে পরিচিত মূখ সিংয়ং ম্রো নিজ মাতৃভাষা ম্রো ও বাংলায় সাহিত্য চর্চা করেন। নতুন প্রজন্মের মধ্যে ইয়াংঙান ম্রো ব্যাকরণ, অভিধান, ভাষা শিক্ষার বই, প্রাচীন লোককাহিনীসহ ম্রো জাতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে ইতোমধ্যে ২৯টি বই প্রকাশ করেছেন। তিনি ম্রো ভাষার পাশাপাশি রেংমিটচা ভাষায়ও সম্প্রতি একটি অভিধান প্রকাশ করেছেন। 

তঞ্চঙ্গ্যা জাতির সাহিত্যের মধ্যে বারোমাস, উভাগীত, পসন্, ধাঁধা, কবিতা, ছড়া অন্যতম। তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যে সাধক শিবচরণের ‘গোসাইন লামা’-কে বিশেষ অবস্থানে আসীন করা হয়। তঞ্চঙ্গ্যা লোকসাহিত্যের মধ্যে জুম কাবা পালা, রাইন্যা বেড়ানা পালা, নাকসু ফুল পারা পালা, ঘিলা পারা পালা, রদংস পালা, বার্কী ধরা পালা, চাদিগাঙ ছড়া পালা, রাধামন ধনপতি পালা, লক্ষ্মী পালা, ধর্ম পালা, রিজার্ভ পালা, অলঙ্গা-অলঙ্গী পালা (রাইন্যা বেড়ানা পালার একটা শাখা), লাঙ্যা-লাঙ্যনী পালা, মেদঙা-মেদঙী পালা, মিয়াধন-মিয়াবী, কুঞ্জধন-কুঞ্জবী, নিলংধন-নিলংবী, কামিতধন-কামিতবী, হিরাধন-হিরাবী,মানিকধন-মানিকবী এবং মেজংবী-মেজংধন ইত্যাদি অন্যতম। তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যিকদের মধ্যে রাজকবি পমলাধন তঞ্চঙ্গ্যা, গোবীনাথ তঞ্চঙ্গ্যা, কবিরত্ন শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, রাজগুরু অগ্রবংশ মহাস্থবির, ক্ষেমাঙ্কর মহাস্থবির, যোগেশ চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, শ্রী বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যাা, রতিকান্ত তঞ্চঙ্গ্যা, লগ্ন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, অ্যাড. দীন নাথ তঞ্চঙ্গ্যা, সুদত্ত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা, ভোলানাথ তঞ্চঙ্গ্যা (বি.এন), পারমিতা তঞ্চঙ্গ্যা, উচ্চতমনি তঞ্চঙ্গ্যা, তাপস তঞ্চঙ্গ্যা, অজয় বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা, ঈশ্বর চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা, কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা, উজ্জ্বল কুমার তঞ্চঙ্গ্যা (মনিচান), দীপঙ্কর তঞ্চঙ্গ্যা, আরিয়াজ্যোতি ভিক্ষু, মিলিন্দ তঞ্চঙ্গ্যা প্রমুখের বিশেষভাবে উল্লেকযোগ্য। তঞ্চঙ্গ্যা সাহিত্যের অমর সৃষ্টিসমূহের মধ্যে কবিরত্ন কার্ত্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যার বুদ্ধ সালামী গাথা মনত ভাবি চেবা (আগস্ট ১৯৮৫), বৌদ্ধশিক্ষা (১৩৪৬); উদয়ন বস্তু বা কৰ্ম্মফল (১৩৬৮); মহাবোধি পালঙ্ক কথা (১৯৮৪); বৌদ্ধ গল্পমালা (১৯৮৭), ধর্ম্মর ঋজ জাতক ইত্যাদি; বীরকুমার তঞ্চঙ্গ্যার তঞ্চঙ্গ্যা রূপকথা, রক্ততিলক (নাটক) ও ভাগ্যরত্ন অন্যতম (www.tanchangyaworld.wordpress.com)।

গারো জাতিসত্তার সাহিত্য সমৃদ্ধ ও বিকশিত সাহিত্য। গারো সাহিত্যের সর্বাধিক জনপ্রিয় কবি মতেন্দ্র মানখিনের কবিতা গ্রন্থ ‘জাতথাংনি জুমাং’ একটি অমর সৃষ্টি। তিনি গারো ভাষায় কালজয়ী ‘বাঙআ জাবুচ্চিম দুখনি সাগাল বালজ্রুয়ে’ গানটির জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তাঁর প্রকাশিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে পাথর চাপা ফুল, কবি ও কবিতা কাহিরি, না প্রেম না বসতি, এইতো জীবন এইতো মাধুরী, হৃদয় বৃত্তান্ত এক কষ্টের নদী, ধূর্তছায়া নষ্টকাল, জাতথাংনি জুমাং (জাতিসত্তার স্বপ্ন)। অন্যতম প্রবীণ কবি সুভাষ জেংচাম লিখেছেন গবেষণা গ্রন্থ বাংলাদেশের গারো সম্প্রদায়, গারোদের সমাজ ও সংস্কৃতি, গারো আইন, গারোদের সাংস্কৃতিক জীবনধারা, বাংলাদেশের গারো অঞ্চলে কাথলিক মিশনারিগণ, গারো অঞ্চলে ক্যাথলিক মিশনারিদের আগমন, পান্থজনের পাঁচালী ইত্যাদি। কবি থিওফিল নকরেকের প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে পাহাড়ি কন্যা (২০১৩), নকরেক আচিক তুমি ধন্য (২০১৪), সত্যের মুখোমুখি (২০১৬), আমি উদ্বাস্তু হতে চাই না (২০২০) গারো সংস্কৃতির জীবনবাদ পর্যালোচনা (২০১৫), গারোদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম : যুগের দাবি (২০১৫), হৃদয়ের ঢেউ তরঙ্গিত (২০১৯), সেরেনজিং (২০১৭), ভালবাসি শুধু তোমাকে (২০১৮), ইউরোপ ভ্রমণ ও সমাজ সংস্কৃতির পরিচয় (২০১৭)। 

জিরকুং শাহু পাহাড়ের কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন কবি। জ্যেষ্ঠ এই বমভাষী কবি রচনা করেছেন বম ভাষা শিক্ষার বই, কবিতা, প্রবন্ধ, প্রবাদ-প্রবচন, গবেষণাধর্মী বহু লেখা। তাঁর লেখা একটি বম কবিতার বাংলা অনুবাদে তিনি লিখেছেন-

বৃষ্টিতে ভেজা ঢেউ খেলানো

গোছা গোছা আমার জুমের ধান

গন্ধে আমার প্রাণ জুড়িয়ে যায়।


দুপুরের শীতল বাতাস প্রাণ ছুঁয়ে যায়

আকাশের বারিধারা ধানের গোছায় এনে দেয় প্রাণ,

সূর্যের আলোয় তিল তিল বেড়ে উঠে ধান।


এসো হে কিষান ভাই ফলাই সোনার ফসল

আসছে বছর ঘরে তুলি দ্বিগুণ ধান

খাঁটি কিষানই পারে তুলতে ভালো ফসল।

জুমের প্রান্তসীমায় ঝিরি ঝরনাতে

চল যাই রাখি তার চারিধার মনোরম

পাহাড়ি ঝিরি ঝরনার নির্মল পানি

থাকে যেন বার মাস।

(Kan lo fangbui/গোছা গোছা জুমের ধান)

বাংলাদেশের আদিবাসী সাহিত্য বিকাশে কার্যকর কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়। দেশের আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশে নেতৃত্ব দেওয়ার সুবিধার্থে জাতীয় পর্যায়ে আদিবাসী ভাষাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা জরুরি। বাংলা একাডেমিতে আদিবাসী ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক একটি স্বতন্ত্র সেল অথবা বিভাগ গঠন করে এই বিভাগ হতে নিয়মিতভাবে আদিবাসীবিষয়ক প্রকাশনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। দেশের বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আদিবাসী ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক বিশেষায়িত বিভাগ বা ইনস্টিটিউট স্থাপন করে একাডেমিক কার্যক্রমে আদিবাসী ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক পঠন-পাঠন ও চর্চার ক্ষেত্র সৃষ্টি করা যায়। আদিবাসী ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক নিয়মিত গবেষণা, আলোচনা ও প্রকাশনার জন্য সরকার হতে সহায়তা প্রদান করা যায়। দেশের বিভিন্ন জেলায় স্থাপিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটকে ক্ষমতায়িত করে আদিবাসী ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক গবেষণা ও প্রকাশনার জন্য পর্যাপ্ত সহায়তা প্রদান করা যায়। এসব উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব হলে দেশের আদিবাসী ভাষা ও সাহিত্য বিকাশের পথ উন্মেচিত হবে। আদিবাসী সাহিত্যের জুম সোনার ফসলে ভরে থাকবে বারো মাস।


লেখক : নির্বাহী পরিচালক, জাবারাং কল্যাণ সমিতি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা জাতীয় পদক ২০২১ প্রাপ্ত গবেষক

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা