অনুলিখন : মীর গোলাম মোস্তফা
প্রকাশ : ১২ মার্চ ২০২৩ ১২:৩৮ পিএম
বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল জন্ম : ১ এপ্রিল ১৯৫৪ স্থায়ী ঠিকানা : যুদ্ধের সময় ৪ নম্বর হরিকিশোর রায় রোড, ময়মনসিংহ বর্তমান : ২৫০ বলাশপুর আবাসন মুক্তিযোদ্ধা পল্লী ময়মনসিংহ সাব সেক্টর : ঢালু কমান্ডার : লে. তাহের আহমেদ, বীর প্রতীক সেক্টর : ১১ সেক্টর কমান্ডার : মেজর (পরে লে. কর্নেল) আবু তাহের, বীর উত্তম
ভারতের উত্তর-পূর্ব মেঘালয় রাজ্যের দক্ষিণে সীমান্তবর্তী বাংলাদেশসংলগ্ন আদিবাসী গারো কৃষকদের গ্রাম যশীপাড়া। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতীয় ও বাংলাদেশের যোদ্ধাদের সমন্বয়ে এখানেই গড়ে উঠেছিল যৌথ বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প। ত্রয়োদশ রাজপুত রেজিমেন্ট ও মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাশেম কোম্পানির এফএফওএমএফ সমন্বয়ে ১৩৪ জনের একটি শক্তিশালী দল। এই দলটি গড়ে ওঠার পেছেনে আছে দুঃখজনক গল্প।
২৫ মে, ৩১ বেলুচ ও ৩৪ পাঞ্জাব (পাকিস্তান) যৌথভাবে ভারতের অভ্যন্তরে হানা দেয়। নালিতাবাড়ী থানার সীমান্তবর্তী গ্রাম নাকুগাঁও হয়ে ভারতের বারেঙ্গাপাড়া থানার ঢালু পুরাতন বাজারে বাংলাদেশের শরণার্থী ও ভারতের সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। হত্যা করে আরও ৯ জন বিএসএফকে। এই দলটিই ২৫ জুলাই সীমান্তের খুব কাছের গ্রাম সোহাগপুরে ১৮৭ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। এখানেও বেশ কয়েকজন আদিবাসী গারো প্রাণ হারায়। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে চায় ত্রয়োদশ রাজপুত রেজিমেন্ট, সঙ্গে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল।
বড় যুদ্ধ, এ যুদ্ধ প্রতিশোধের যুদ্ধ। সেই লক্ষ্যে ২৮ অক্টোবর রাত ১২টা যশীপাড়া থেকে ৭ জনের একটি দল সামরিক লরিতে করে ৭/৮ কিলোমিটার পূর্বদিকে সীমান্ত সড়ক ধরে যাত্রাকোণায় আসেন। এখানে ছোট্ট নদী, গারো ভাষায় এই নদীর নাম ‘শেওয়াল’। পুল পার হয়ে ১১২১ নং সীমান্ত পিলার অতিক্রম করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ৭ জনের দল। ৬ জন ভারতীয় ও আমাদের কমান্ডার আবুল হাশেম।
এই রেকিতে ভারতীয়রা মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে গাইডারদের সঙ্গে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। ক্যাম্পের ব্যারাক হাউস, লঙ্গরখানা, পাঞ্জাখানা, মেহমানখানা, টাট্টিখানাসহ ব্যাংকারের অবস্থান ইত্যাদি দেখে নিতে অসুবিধা হয় নাই।
৩ নভেম্বর ১৯৭১। কোম্পানি কমান্ডার আবুল হাশেম ক্যাম্পের সামনে গারো প্রধান ডুবাজুরী গ্রাম থেকে ব্যারিলাইট পিস্তল দিয়ে ফায়ার ওপেন করবেন। রাতের অন্ধকারে ছোট্ট প্যারাস্যুটের রশির সংযোগস্থলে হাজার পাওয়ারের জ্বলন্ত বাতি। ওপরে বাতাসে ভেসে আছে। সাদা আলোতে ক্যাম্প স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেই সুযোগে ১১২১ নং পিলারের কাছে ভারতীয় এইচএমজির গানার ফায়ার ওপেন রাখবে ১০ মিনিট।
পাকবাহিনী সামনের আক্রমণ দেখে ওইদিকে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। আর সেই সুযোগে ক্যাম্পের পেছনের বাংকার গুলো দখল করে নেবে একদল আত্মঘাতী মুক্তিযোদ্ধা।
ল্যান্সনায়েক মেসবাহ ও ল্যান্সনায়েক ওজিউল্লাহ ক্যাম্পের পেছনে পূর্ব-দক্ষিণ কোণের বাংকার । মাঝখানে ল্যান্সনায়েক সফিউদ্দিন ও নুরুল ইসলাম। পশ্চিম-দক্ষিণের বাংকার দখল করবে গণযোদ্ধা ইদ্রিস ও মুজাহিদ শামসুল হক। সঙ্গে আরও আছেন আব্দুস সালাম, আদিবাসী গারো লুকাশ সাংমা ও হজরত মারাক এবং আলী হোসেন।
আমরা ৩ জন মাথা নিচু করে শেওয়াল নদীর ওপাড়ে পূর্ব-দক্ষিণের বাংকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। পালের পেছনে শাহ্। শাহের পেছনে পাল। আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের দেশ, আমাদের পতাকা, হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-বৌদ্ধর জীবনের বিনিময়ে অর্জিত ফসল। ভারতীয়দের প্রাণ বিসর্জনও এখানে তাৎপর্যপূর্ণ।
ক্যাম্পে তারা সংখ্যায় হবে ৬০ থেকে ৭০ জন। বাইরে আরও ৩০ থেকে ৩৫ জন রাজাকার। ১০ মিনিটে যুদ্ধটি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই যুদ্ধ চলল ভোর ৬টা পর্যন্ত।
এখানে শহীদ হন ল্যান্সনায়েক ওজিউল্লাহ, গণযোদ্ধা মো. ইদ্রিস, মো. আলাউদ্দিন, মো. শাজাহান আলী বাদশা ও শ্রী রঞ্জিৎ গুপ্ত।
কমান্ডার আব্দুর রবের সঙ্গে ক্যাম্পের পূর্ব-উত্তরে নদীর ওপাড়ের বাংকারে আক্রমণ করতে গিয়ে একপর্যায়ে শত্রুর গুলিতে প্রাণ হারান। তাদের সঙ্গে আরও ছিলেন আলফা প্লাটুনের প্লাটুন কমান্ডার, ভাষাশহীদ আব্দুল জব্বারের একমাত্র ছেলে নুরুল ইসলাম বাদল। গাইডার মো. আক্তার হোসেন সরকার। সরিষাবাড়ীর মো. শওকত আলী এই যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। এই অপারেশনে আরও প্রাণ দেন ২১ জন ভারতীয় সৈনিক।
এলএমজি পোস্ট ছেড়ে পাকসেনারা জীবন বাঁচাতে ক্যাম্পের সামনে বর্ডার রোডের উত্তরদিকে পজিশনে যায়। যাওয়ার সময় অন্ধকারে ভারতীয়দের সঙ্গে শুরু হয় হাতাহাতি। তখনও অধিকাংশ পাকসেনা জীবিত। ওদের খতম করে যৌথ বাহিনী বেশ সাহসী হয়ে ক্যাম্পে ঢুকে পড়ে। আবার শুরু হয় হাতাহাতি যুদ্ধ। এভাবেই সমাপ্তি ঘটে তেলিখালী যুদ্ধ।
৭১ উইং রেঞ্জারের ২২ বছর বয়সি পশ্চিম পাকিস্তানের জিলান ডিস্ট্রিকের আব্দুর রহিম আত্মসমর্পণ করে। বাদবাকি পাকিস্তানি সেনারা নিহত হয়। ৩ নভেম্বর থেকে যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত এই ক্যাম্পটি যৌথ বাহিনীর দখলে ছিল।
এই যুদ্ধে সর্বমোট ২৯ জন শহীদ হন। প্রতিবছর ৩ নভেম্বর তেলিখালী যুদ্ধদিবস পালিত হয়ে থাকে। দুঃখের বিষয় হলো, স্মৃতিফলকে আজও গণযোদ্ধা ইদ্রিসসহ ২১ জন ভারতীয় সৈনিকের নাম ওঠে নাই, যা সত্যিই দুঃখজনক একটি বিষয়।
অনুলিখন : মীর গোলাম মোস্তফা, ময়মনসিংহ প্রতিবেদক