× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

রক্তক্ষয়ী সাচনা ক্যাম্প অপারেশন

অনুলিখন : সাইফুল হক মোল্লা দুলু

প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২৩ ১২:৫৪ পিএম

জন্ম : ২ জানুয়ারি ১৯৫৪
জন্মস্থান : গ্রাম-ছিলনী, থানা-ইটনা
জেলা-কিশোরগঞ্জ
সেক্টর : ৫
সেক্টর কমান্ডার : মেজর মীর শওকত আলী
সাব সেক্টর কমান্ডার : মেজর মুসলেহ উদ্দিন
প্লাটুন কমান্ডার : কেএম আফতাব উদ্দিন কোম্পানি কমান্ডার : জগৎজ্যোতি দাস বীর বিক্রম, সিরাজুল ইসলাম বীর বিক্রম ও মতিওয়ার রহমান বীর বিক্রম

জন্ম : ২ জানুয়ারি ১৯৫৪ জন্মস্থান : গ্রাম-ছিলনী, থানা-ইটনা জেলা-কিশোরগঞ্জ সেক্টর : ৫ সেক্টর কমান্ডার : মেজর মীর শওকত আলী সাব সেক্টর কমান্ডার : মেজর মুসলেহ উদ্দিন প্লাটুন কমান্ডার : কেএম আফতাব উদ্দিন কোম্পানি কমান্ডার : জগৎজ্যোতি দাস বীর বিক্রম, সিরাজুল ইসলাম বীর বিক্রম ও মতিওয়ার রহমান বীর বিক্রম

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেই বুঝতে পেরেছিলাম সশস্ত্র লড়াই ছাড়া বাঙালির মুক্তি নেই। তাই সশস্ত্র যোদ্ধা হওয়ার জন্য প্রাণটা আঁকুপাঁকু করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন আমি কেবল মেট্রিক পাস করে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছি। থাকতাম শহরের পুরান থানা এলাকার ইসলামিয়া ছাত্রাবাসে। আমার গ্রামের সিনিয়র ভাই সিরাজুল ইসলামও তখন ওই ছাত্রাবাসের আবাসিক ছাত্র। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সিরাজ ভাইরা তখন নানারকম শলাপরামর্শ করতেন, সেসব আলোচনায় মাঝেমধ্যে আমিও অংশ নিতাম। দেশে তখন টান টান উত্তেজনা। এরই মাঝে মার্চের মাঝামাঝি সময়ে শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি ইটনা উপজেলার ছিলনী গ্রামে চলে আসি। গ্রামে এসে টের পাই শহরের উত্তেজনা হাওরের এই নিঝুম পল্লিকেও স্পর্শ করেছে। খবর পাই, ১৯ এপ্রিল কিশোরগঞ্জ শহর হানাদার পাকিস্তানি সেনাদের দখলে চলে গেছে। প্রথম দিনেই ঘাতক বাহিনী শহরের ৯ জন নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করেছে। এ ছাড়া লুটপাট, বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে দখলদার বাহিনী পুরো শহরে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে।

এপ্রিল মাসের ২০ তারিখে আমরা নিজেদের গ্রামে হানাদার প্রতিরোধ কমিটি গঠন করি। এরই মাঝে দেখতে পেলাম হাওর জনপদের আকাশে দুটি পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান চক্কর দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ওই দুটি বিমান থেকে মিঠামইন উপজেলার চারিগ্রামে বোমা ফেলে। সেই বোমার বিকট শব্দ আমরা আমাদের গ্রাম থেকেই শুনতে পাই। সিরাজুল ভাই বললেন, এসব মিটিংয়ে কোনো কাজ হবে না। আমাদের সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। অন্য চিন্তা বাদ, এখনই আমাদের সীমান্ত পেরিয়ে ওপারে চলে যেতে হবে। ইতোমধ্যে আকাশবাণী কলকাতা থেকে ঘোষণা আসে, পূর্ববাংলার জনসাধারণের সুবিধার জন্য ভারতের সীমান্ত খুলে দেওয়া হয়েছে। আমরা ছিলনী গ্রামের ৭ তরুণ ওইদিনই সিরাজ ভাইয়ের নেতৃত্বে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসি। মাহতাবউদ্দিন, আলী রেজা, নূরুল ইসলাম, মোহাম্মদ ইব্রাহীম, আতাউর রহমান এবং আমি সিরাজ ভাইয়ের দলভুক্ত হয়ে পায়ে হেঁটে মহেশখলার পথে রওনা হই। পথিমধ্যে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হন চারিগ্রামের কেএম আফতাবউদ্দিন এবং লাইমপাশা গ্রামের আশরাফুল ইসলাম। দীর্ঘপথ হেঁটে আমরা ৯ তরুণ ৫ দিন পর ২৬ এপ্রিল বালাট ক্যাম্পে পৌঁছাই। সেই ক্যাম্পে তখন সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন আমাদের হাওর জনপদ থেকে নির্বাচিত তরুণ এমএনএ (বর্তমান রাষ্ট্রপতি) মো. আবদুল হামিদ। আমরা প্রথমেই তার সঙ্গে দেখা করে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা পেলাম। পরে সেখান থেকে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় আরও দূরের ইকো-ওয়ান ট্রেনিং সেন্টারে। সেখানে পেয়ে যাই আমাদের পার্শ্ববর্তী উপজেলার কাকাইলছেও গ্রামের দুর্দান্ত সাহসী তরুণ জগৎজ্যোতি দাসকে। আমরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাই। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা মেজর এসজে বাট আমাদের ৩৬ জনকে একটানা বত্রিশ দিন অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে জগৎজ্যোতি দাসকে কোম্পানি কমান্ডার এবং সিরাজুল ইসলামকে টুআইসির দায়িত্ব দিয়ে আমাদের পুরো টিমকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাহিরপুর উপজেলার টেকেরঘাটে।

আমার মুক্তিযোদ্ধা-জীবনের উল্লেখযোগ্য সম্মুখযুদ্ধ ছিল সুনামগঞ্জ জেলাধীন জামালগঞ্জ থানার ‘সাচনা’ নদীবন্দর এলাকার রক্তক্ষয়ী সম্মুখযুদ্ধ। টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের প্রথম বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ছিলেন মেজর মুসলেহউদ্দীন। তার নির্দেশে আমরা ৮ আগস্ট সাচনা আর্মিক্যাম্প ধ্বংস করার পরিকল্পনা নিয়ে নৌকাযোগে রওনা হই। আমাদের দলের নেতৃত্বে ছিলেন অসম সাহসী বীর যোদ্ধা মো. সিরাজুল ইসলাম। তার নেতৃত্বে আমরা ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শনির হাওরের দীর্ঘ ২৫ মাইল পথ নৌকা বেয়ে অগ্রসর হতে থাকি। প্রায় আট ঘণ্টার নৌকাযাত্রা শেষে গভীর রাতে সাচনা বন্দরের কাছাকাছি এসে স্থির হয়ে যাই। সেখান থেকে যতদূর সম্ভব দখলদার বাহিনীর ক্যাম্প পর্যবেক্ষণ করে দলনেতার নির্দেশে আমরা ক্যাম্প লক্ষ্য করে অতর্কিতে গোলাবর্ষণ শুরু করি। তৎক্ষণাৎ ক্যাম্পে থাকা পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকাররা পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করে। দীর্ঘ প্রায় ৬ ঘণ্টা যুদ্ধ চলতে থাকে। পরে খবর পাই ক্যাম্পে থাকা ৩৬ জন পাকিস্তানি সেনা আমাদের আক্রমণে নিহত হয়েছে। আমারা নৌকা ছেড়ে ডাঙায় উঠে এসে আক্রমণের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দিই। অবশিষ্ট পাকিস্তানি সেনারা কভারিং ফায়ার করতে করতে পেছনের দিকে সরে যায়। তাদের নিক্ষিপ্ত একটি বুলেট এসে আমাদের দলনেতা মো. সিরাজুল ইসলামের চোখের নিচে বিদ্ধ হলে তিনি গুরুতর আহত অবস্থায় গোঙাতে থাকেন। আমরা ক্যাম্পে থাকা ১৩ জন রাজাকারকে বন্দি করে আহত দলনেতা সিরাজ ভাইকে নিয়ে নৌকায় উঠে আসি। আবার দীর্ঘ ২৫ মাইল নৌপথ পাড়ি দিয়ে ফিরে আসি টেকেরঘাট সাব-সেক্টরে। সেখানে সিরাজ ভাইয়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু প্রচুর রক্তক্ষরণ কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছিল না। অবশেষে নিয়ন্ত্রণহীন রক্তক্ষরণের কারণে চিকিৎসারত অবস্থায় শাহাদাৎ বরণ করেন আমাদের দুঃসাহসী দলনেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সিরাজুল ইসলাম। স্বাধীনতার পর অসম সাহসিকতার স্বীকৃতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু সরকার শহীদ সিরাজুল ইসলামকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করে।

এ রকম আরও কিছু সম্মুখযুদ্ধের স্মৃতি আমার রয়েছে। অষ্টগ্রাম উপজেলাকে মুক্ত করার যুদ্ধে আমরা হারিয়েছি আমাদের আরেক সাহসী যোদ্ধা মো. শাহাবউদ্দীনকে। প্রত্যুত্তরে আমাদের হাতেও নিহত হয়েছে অনেক পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার সদস্য। এত ত্যাগ, এত বিসর্জনের মধ্য দিয়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতা ছিলেন বলেই এবং তার অনুপস্থিতিতে আমাদের জাতীয় চার নেতার বিচক্ষণ নেতৃত্ব ছিল বলেই মাত্র ৯ মাসে আমরা অর্জন করেছি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশকে আবার যারা পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নিতে চায় তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে।

অনুলিখন : সাইফুল হক মোল্লা দুলু

মধ্যাঞ্চলীয় ব্যুরো

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা