অনুলিখন : হাসনাত মোবারক
প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০২৩ ১৩:২১ পিএম
পাকিস্তানিদের গণহত্যা শুরুর পর ২৫ মার্চ থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত নওগাঁ শহর মুক্ত ছিল। এ ক্ষেত্রে বড় অবদান ছিল মেজর নজমুল হক, ক্যাপ্টেন গিয়াস এবং আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের। ২২ এপ্রিলের পর অগ্নিসংযোগ এবং গণহত্যা করতে করতে পাকিস্তানিরা নগরবাড়ী ঘাট হয়ে নওগাঁ পৌঁছায়। তখন আমরা প্রথমে খালার গ্রামের বাড়ি জয়পুরের ডাঙারপাড়া মহাদেবপুরে আশ্রয় নেই। সেখানে দিনসাতেক থেকে মনস্থির করি যুদ্ধে যাব। আমার বড় ভাই শহীদ কাজী নুরুনবী ছিলেন এর উদ্যোক্তা। পাকিস্তানিরা আসছে। এমনিও মরব, অমনিও মরব। বড় ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা ভারতে যাই ২৭ বা ২৮ এপ্রিল। ভারতের বালুঘাটের কাছাকাছি নওগাঁর নেতারা বাঙালি যুব ক্যাম্প স্থাপন করেছিলেন।
সেই ক্যাম্পে ছিলেন তৎকালীন নওগাঁর এমএনএ বায়তুল্লাহ সাহেব ও গিয়াসউদ্দিন সরদার সাহেব। আরও ছিলেন নওগাঁর জনপ্রিয় নেতা পোনা ভাই, মোর্শেদ ভাই ও ফুটবলার জাকারিয়া পিন্টু। ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন সর্বেসবা জলিল ভাই (আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী আব্দুল জলিল)। সেখান থেকে মুক্তিবাহিনীকে বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হতো। একদিন আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান আব্দুর রাজ্জাক এলেন। উনি মুজিববাহিনীর রিক্রুটের দায়িত্বে ছিলেন।
রাজ্জাক ভাই আমাদের রিক্রুট করে নিয়ে গেলেন। প্রথমে জলপাইগুড়ির পাঙ্গা ট্রানজিট ক্যাম্প। সেখান থেকে ডেকাটো বিমানে করে প্রথমে বাঘডুকরাত এবং পরে মূর্তি বলে একটা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। জায়গাটা ঘোরতর জঙ্গল। তাঁবু খাটানো। সেখানে প্রশিক্ষণ শুরু হলো। সাপের অত্যাচারে পরে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো। সেটা দেরাদুনের কাছে তান্ডুয়া বলে একটা জায়গায়। ৬/৭ সপ্তাহ প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের আবার পাঙ্গায় নিয়ে আসা হলো। সেখানে কয়েকদিন থেকে বুনিয়াদপুরের ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে আমাদের ধামুইরহাটের উল্টো দিকে ৫ আগস্ট রাতে নামিয়ে দেওয়া হয়। সেদিন আমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করলাম। প্রথম রাতে আমরা ২৭ মাইল পথ হেঁটেছিলাম।
আমরা ঘাঁটি স্থাপন করি নওগাঁর দুবলহাটি বিল অঞ্চলে। এরপর আশ্রয়ের ব্যবস্থা, অস্ত্র সংগ্রহ, লুকিয়ে রাখা, নতুন ছেলেদের প্রশিক্ষণ, ছোট ছোট অপারেশন এবং রাজাকারদের ওপর হামলা করা ছিল আমাদের কাজ। এ ছাড়াও পাকিস্তানিদের জিপ লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়ে মারা, ক্যাম্পে কয়েকটা গুলি ছোড়া, অর্থাৎ ‘হিট অ্যান্ড রান’ টাইপ কাজ ছিল। মুক্তিবাহিনী তখন নওগাঁয় খুব ক্রিয়াশীল। জনসংখ্যা বেশি ছিল তাদের। আমরা তো মুজিববাহিনীর। আমার দল ছিল এগারো জনের। বল্টু ভাই অর্থাৎ খান মো. শহীদুল ইসলামের দলে ছিল তেরো জন। আর দুজন ছিলেন গাইড।
তখন ডিসেম্বর মাস। বাংলাদেশ এবং ভারতের যৌথ কমান্ড যুদ্ধ শুরু করেছে। মুক্তিবাহিনীরা সেপ্টেম্বর থেকেই যথেষ্ট সক্রিয়। পাকিস্তানিরা তখন অনেকখানিই রক্ষণাত্মক। রানীনগর রেলওয়ে স্টেশনে পাকিস্তানিদের একটা ক্যাম্প ছিল। মুক্তিবাহিনীর সিদ্ধান্ত ছিল সেটার ওপর হামলা করতে হবে। আমাদের সহায়তা করতে বলা হলো। মুক্তিবাহিনীর মূল নিয়ন্ত্রণে তখন মোখলেসুর রহমান রাজা ভাই। খবর পেয়ে সম্পূর্ণ দল এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চলে গেলাম রানীনগর। প্রথমে রঞ্জু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। উনি আমাদের সবকিছু বুঝিয়ে দিলেন। পাকিস্তানিরা কোথায় আছে, মুক্তিবাহিনীর অন্যান্য দল কোথায় অবস্থান নিয়েছে এবং আমাদের অবস্থান কোথায় নিলে ভালো হবে ইত্যাদি। আমরা স্টেশনের উল্টো দিকে একটা গুদামঘরে অবস্থান নিলাম।
আক্রমণ শুরুর পর পাকিস্তানির প্রচুর গুলি করছিল। আমরাও তিন দিক থেকে গুলি করছি। তাদের শক্তি ছিল বেশি। আমাদের থ্রি নট থ্রি বোল্ট অ্যাকশনের রাইফেল ও এসএলআর। তাদের কাছে চাইনিজ রাইফেল। আমাদের একটা গুলির বিপরীতে ওরা দশটা গুলি করে। থেমে থেমে গুলি করছি আমরা, পাকিস্তানিরা যেন বের হতে না পারে সেটাই ছিল উদ্দেশ্য। ক্যাম্প দখল নেওয়া বা তাদের হারিয়ে দিতে চাইনি। চেয়েছিলাম একটা সময় যেন তারা সারেন্ডার করে। তা না হলে আমাদের অনেক হতাহত হতো।
একটা মজার ঘটনা বলি, আমরা যুদ্ধ করছি আর আশপাশের গ্রামের লোকজন, এমনকি মহিলারাও বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ দেখছে। যুদ্ধের ভীতিটা তখন গ্রামের মানুষের কেটে গেছে। দুপুর বেলা গ্রামের কিছু লোক আমাদের জন্য খাবার নিয়ে এলো। এটা আমাদের খুব আপ্লুত করেছিল। এটা আমাকে বলতেই হবে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল শক্তিটা ছিল গ্রামের এই সাধারণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী। তারা না খেয়ে আমাদের খাইয়েছেন।
আরেকটা জিনিস বলা উচিত, মুক্তিযুদ্ধে গ্রামের নারীদের অবদান ছিল অনেক। তারা রাত দুইটায় রান্না করে আমাদের খাইয়েছেন। এই নারীরাই সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত এবং নিগৃহীত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের পরে তারা মূল্যায়িত হননি। ব্যক্তিগতভাবে এই মানুষগুলোর অবদান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি।
যাই হোক, যুদ্ধ হচ্ছেÑ ক্রমাগত গোলগুলি হচ্ছে। ওরাও করছে; আমরাও করছি। সন্ধ্যা একটু ঘন হয়ে এলে প্রচণ্ড গুলি শুরু করে পাকিস্তানিরা। প্রায় দশ মিনিট গুলি ছোড়ার পর হঠাৎ সব শান্ত হয়ে গেল। কোনো কথা নয়, শব্দ নয়। আমরা একটু বিস্মিত হলাম। ওদের কী গুলি ফুরিয়ে গেল? নাকি অন্য কিছু! গ্রামের কিছু সাহসী লোক একটু ক্রল করে উঁকি মেরে দেখে যে ক্যাম্প খালি। পরে বুঝতে পারি, প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে আমাদের হতচকিত করে ক্যাম্পের সব সৈন্য রেললাইন ধরে অন্ধকারে নওগাঁর দিকে চলে গেছে। এভাবেই রানীনগর স্টেশন উদ্ধার হয়।
অনুলিখন : হাসনাত মোবারক