× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

অভিযান মেরা পর্বতশৃঙ্গ

জাফর সাদেক

প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৩ ১৩:২৯ পিএম

আপডেট : ১৬ মার্চ ২০২৩ ২০:২৯ পিএম

মেরা পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ করতে দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়

মেরা পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ করতে দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়

মেরা পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ করেছেন বাংলাদেশি পর্বতারোহী জাফর সাদেক

মেরা পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ করেছেন বাংলাদেশি পর্বতারোহী জাফর সাদেক

দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে  ৬৪৭৬ মিটার (২১২৪৭ ফুট) উচ্চতায় মেরা পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ করেছেন বাংলাদেশি এক পর্বতারোহী। রোমাঞ্চকর সেই অভিযানের গল্প জানিয়েছেন অভিযাত্রী জাফর সাদেক 

নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দর থেকে হেপিকপ্টারে চড়ে এক ঘণ্টার মধ্যে লুকলা বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম। চার সিটের হেলিকপ্টারে দুজন আমেরিকান আমার সহযাত্রী। আমাদের গন্তব্য ছিল আলাদা। লুকলায় নেমে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মেরা পর্বতশৃঙ্গে আরোহণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে এলাম। নেপালের সাগরমাতা উদ্যানের পূর্বাঞ্চলে দেড় হাজার বর্গকিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে মাকালু বরুণ সংরক্ষিত উদ্যানের সৃষ্টি। উদ্যানে সর্বোচ্চ বিন্দু পৃথিবীর পঞ্চম উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ মাকালু, যার উচ্চতা ৮৪৬৩ মিটার আর নিম্নতম বিন্দু অরুণ নদীর উপত্যকা, যার পাদদেশে বসবাস করে শেরপা, রাই, গুরুং, তামাং, মাগার, নেওয়ার, ব্রাহমিন এবং ছেত্রি সম্প্রদায়ের মানুষ। মেরা পর্বত এই উদ্যানেরই একটি শৃঙ্গ।

লুকলা থেকে প্রথম দিনের গন্তব্য ছিল ‘চুতেঙ্গা’, যার উচ্চতা ৩৫০০ মিটার। রেইন ফরেস্টের ভেতর দিয়ে কখনও বা পাথরের বোল্ডার, সাসপেনশন ব্রিজ পাড়ি দিয়ে দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটে চুতেঙ্গার একটা লজে আশ্রয় নিই। লজ বলতে পাথরের আড়ালে টিনের ছাউনি, কাপড় আর প্লাস্টিকের বস্তা দিয়ে তৈরি তিন কামরার একটি ঝুপড়ি। ফলে রুমের ভিতর হু হু করে বাতাস প্রবেশ করে। দুপুরের পর থেকে রোদের তেজ কমে যায় বলে ধুম করে তীব্র ঠান্ডা নেমে আসে। এলাকাটা একদম নির্জন। আশপাশে কোনো মানুষ থাকে না। বিকালের দিকে কোরিয়ান একজন অভিযাত্রী এলো। তার সঙ্গে গল্প করতে করতে সন্ধ্যা নেমে এলো। রাত্রি আটটায় ডিনার করে ঘুমাতে গেলাম। পরদিন দুপুর খারকিতেং গিয়ে তুষারের কবলে পড়েছি।  

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি চারপাশ বরফের চাদরে মোড়ানো। আজকে পুরো পথটাই মোরেন অঞ্চল। প্রথমে ৮শ মিটার চড়াই পেরিয়ে তার পর ৫শ মিটার নেমে যেতে হবে। লজ থেকে বেরিয়ে সোজা উপরে উঠে এলাম। তুষারপাতের ফলে চলার পথ পিচ্ছিল হয়ে গেছে। একটু অসাবধান হলেই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এভাবে ৮শ মিটার পারি দিয়ে যাত্রা লা পাসে পৌঁছে গেলাম। যাত্রা লা পাস দুটো অঞ্চলের সীমানা। একপাশে সাগরমাতা উদ্যান, অন্য পাশে মাকালু বরুণ সংরক্ষিত উদ্যান। এর উচ্চতা ৪৮০০ মিটার। যাত্রা লা পাস থেকে ৫শ মিটার নেমে তুলি খারকা পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেল। তুলি খারকা থেকে মোরেন অঞ্চল পেরিয়ে মাকালু বরুণ সংরক্ষিত উদ্যানের ভেতর প্রবেশ করলাম।

আজকের পথ পুরোটাই ঝিকঝাক করে নিচের দিকে নেমে গেছে। বনে নানা প্রজাতির রডোডেনড্রন, গুল্ম, বাঁশ আর পাইন গাছের সারি। বনের শেষ প্রান্ত থেকে বরুণ নদীর তীরঘেঁষা উপত্যকা পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম কোটে। এখান থেকে সব অভিযাত্রীর নির্দিষ্ট ফির বিনিময়ে মাকালু বরুণ ন্যাশনাল পার্কে প্রবেশের অনুমতি নিতে হয়ে। নেপাল সরকারের বন ও আবহাওয়া মন্ত্রণালয়ের জাতীয় উদ্যান ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ এই অনুমতি প্রদান করে। কোটেতে তাদের অফিস আছে। সার্ক সদস্য দেশের জন্য এই ফির পরিমাণ ১৫০০ রুপি। কোটের উচ্চতা ৩৫৫০ মিটার। এর পাশ দিয়ে বরুণ নদী বয়ে চলেছে। দুই পাশে উঁচু পর্বতের সারি। তার মাঝে এই উপত্যকার সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে।

কোটে থেকে থাগনাকের দিকে যাওয়ার ভূমিধ্স এলাকা পারি দিতে হয়। এই পথটুকু অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। পাহাড়ের ওপর থেকে ছোট ছোট নুড়িপাথর অনবরত খসে পড়ছে বরুণ নদীতে। কোথাও-বা বড় ধরনের ভূমিধসের কারণে নদীর গতিপ্রবাহ পরিবর্তন হয়ে গেছে। চারদিকে বড় বড় পাথরের বোল্ডার। মাঝপথে পাহাড়ের বাঁকে একটা পুরোনো মনেস্ট্রি দেখতে পেলাম। এই মনেস্ট্রিতে বৌদ্ধধর্মীয় রীতিতে পূজার্চনা হয়। মনেস্ট্রি পার হয়ে কিছুদূর পথ অতিক্রম করার পর থাগনাক দেখতে পেলাম। থাগনাক থেকে খারে আসার পথটুকু মোরেন অঞ্চল। চারপাশে তুষারাবৃত্ত শৃঙ্গ উঁকি দিয়ে আছে। এই জায়গাটা মেরা পর্বতশৃঙ্গে বেসক্যাম্প হিসেবে পরিচিত। এ যেন অভিযাত্রীদের এক মিলনমেলা। আমার অভিযানের সহযোগী হিসেবে ছিল 8K Expedition Company। তাদের সঙ্গে চুক্তি মোতাবেক খারে এসে আমি আমার ক্লাইম্বিং শেরপার সঙ্গে বসে পরবর্তী করণীয় ঠিক করলাম।

আমার পরিকল্পনা ছিল খারেতে এক রাত থেকে পরের দিন দুপুরের আহারের পর মেরা বেসক্যাম্পে চলে যাব। কিন্তু আমার শেরপার পরামর্শে এবং অন্যান্য অভিযাত্রীর সঙ্গে কথা বলে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হলো। ২৮ অক্টোবর সকালে উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে খারে থেকে ৩শ মিটার উচ্চতায় আরোহণ করলাম। লাঞ্চের পর আইস বুট, ক্রাম্পন, হারনেস, এসেন্ডিংসহ ক্লাম্বিং গিয়ারের মাধ্যমে পাশের একটা পাহাড়ে ক্লাইম্বিং প্রস্তুতি ঝালিয়ে নিয়েছি। দুই দিন খারেতে কাটিয়ে অনুকূল আবহাওয়ার প্রতীক্ষায় আছি।

অবশেষে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত! ২৯ অক্টোবর সকাল আটটায় মেরা হাইক্যাম্পের দিকে যাত্রা শুরু হলো। সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে ক্রাম্পন পয়েন্টে পৌঁছে ট্র্যাকিং জুতা খুলে আমাকে আইসবুট পরিয়ে দেওয়া হলো। কোমরে হার্নেসের বেল্টের সঙ্গে রুপআপ করে আমার ক্লাইম্বিং শেরপা এগিয়ে যাচ্ছে। আমি উঠে দাঁড়াতে গিয়ে মনে হলো কেউ যেন আমার দুই পায়ে পাথর বেঁধে দিয়েছে। স্টেপ দিতে গিয়ে মনে হলো আমি পড়ে যাচ্ছি। একটি শিশু প্রথম হাঁটা শিখতে গিয়ে যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, আমার বর্তমান অবস্থা তাই হয়েছে। এভাবে কিছু পথ আরোহণের পর আইসবুট আর ক্রাম্পনের সঙ্গে ভালোমতো বোঝাপড়া হয়েছে। 

দলে দলে অভিযাত্রীরা এগিয়ে চলছে। মেরা লা নামক একটা জায়গায় এসে জলযোগে প্যাক করা লাঞ্চ করে আশপাশ পরখ করছি। দূর থেকে এভারেস্ট, মাকালু আর বরুণুৎসের চূড়া দেখা যায়। তুষারাবৃত পর্বতশৃঙ্গে আমি হাঁটছি। এ যেন এক স্বপ্নের মতো। দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে হাইক্যাম্পে পৌঁছে গেলাম। আজকের আবহাওয়াটা চমৎকার। তবে বিকালের দিকে ঠান্ডার তীব্রতার সঙ্গে বাতাসের গতিবেগ বাড়ছে। সন্ধ্যায় নুডলস সুপের সঙ্গে কফি দেওয়া হলো। কিন্তু আমি খেতে পারছিলাম না। স্পিপিং ব্যাগের ভেতর ঢুকে শরীর উষ্ঞ রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। বাতাসের তীব্রতায় মনে হচ্ছে তাঁবুসহ আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। 

রাত ১২টা ৩০ মিনিটে ওটস আর কফি পান করে সামিটের প্রস্তুতি নিয়েছি। কয়েকটি দল ইতোমধ্যে বেরিয়ে গেছে। ২টা ৩৫ মিনিটে আমি তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলাম। মাথার ওপর হেডল্যাম্পের মিটিমিটি আলো। দলে দলে পর্বতারোহীদের এগিয়ে যাওয়ার সময় তাদের ক্রাম্পনের টুংটাং শব্দ শোনা যাচ্ছে। বাতাসের শো শো আওয়াজ। মাঝে মধ্যে বরফের কণা এসে চোখেমুখে আঘাত করছে। বরফে আইসএক্স গেঁথে উপুড় হয়ে দুই হাত দিয়ে চোখমুখ ঢেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছি। আঁধার ভেদ করে ধীরে ধীরে চারপাশ আলোকিত হয়ে গেল। কাঞ্চনজঙ্ঘা পাশ ঘেঁষে সূর্যোদয়ের সময় পর্বতের চূড়াগুলো রক্তিম আকার ধারণ করেছে। আমার চোখের সামনে পৃথিবীর পাঁচটি আট হাজার মিটারের চূড়া। এভারেস্ট, লুৎসে, মাকালু, চো ইউ, কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে আমাদাবলাম, পুমরি, নুপসে, বরুণোৎসের প্যানারুমা দৃশ্য। এই সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।

পর্বতচূড়ায় লাল-সবুজ পতাকা হাতে লেখক 

সকাল আটটার দিকে আমি মেরা পর্বতের ঢালে এসে রুকস্যাক থেকে লাল-সবুজের পতাকা হাতে মেরা পর্বতশৃঙ্গের দিকে এগিয়ে গেলাম। ৩০ অক্টোবর নেপালের স্থানীয় সময় সকাল ৮ টা ১৭ মিনিটে বহু আকাঙ্ক্ষিত মেরা পর্বতশৃঙ্গের চূড়ায় আরোহণ করি। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন চূড়ায় এসে আমার হাতের পতাকা দেখে হেলো বাংলাদেশ বলে অভিনন্দন জানাল। যেকোনো পর্যায়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়। আজকের এই সুন্দর মুহূর্ত অনেক সাধনায় পাওয়া।

বহুদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে আমি ৬৪৭৬ মিটার (২১২৪৭ ফুট) উচ্চতায় মেরা পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ করতে সক্ষম হয়েছি। আমার ক্লাইম্বিং শেরপা এই সুন্দর মুহূর্তগুলো ফটাফট ক্যামেরাবন্দি করে দিয়েছেন। বিশ মিনিট পর্বতশৃঙ্গের চূড়ায় কাটিয়ে বেসক্যাম্পে ফিরে এলাম। মেরা পর্বতশৃঙ্গ জয়ের স্মারক হিসেবে বেসক্যাম্পের লজে জাতীয় পতাকা ঝুলিয়ে ফিরতে পথ ধরার সময় মনে হলো প্রতিটি প্রত্যাবর্তনই একটি নতুন অভিযানের শুভসূচনা। হয়তো আজকের এই অভিজ্ঞতা পরবর্তী অভিযানের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।

ছবি : লেখক 


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা