সাইফুল ইসলাম
প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৩ ১২:২৫ পিএম
যুদ্ধের সময় আমি পাবনা ইসলামিয়া কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ সকালেও তেমনি বের হয়েছি বাসা থেকে। বিভিন্ন জায়গা ঘুরে আব্দুল হামিদ সড়কের পাশে ছাত্রলীগ অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। এমন সময় সেনাবাহিনীর গাড়ি এসে দাঁড়ায় আমাদের সামনে। রাইফেল তাক করে হম্বিতম্বি করতে থাকে- ‘কারফিউ লাগ গিয়া, হ্যাট যাও, হ্যাট যাও।’ লোকজনও ভয়ে ছোটাছুটি শুরু করে। সাইকেল নিয়ে ঢুকে পড়ি এক গলির মধ্যে। চলে আসি সাধুপাড়ায়। বাসার সবাইকে বলি, শহরে কারফিউ দিয়েছে, আজ কারো যাওয়ার দরকার নেই। বাসা থেকে চলে আসি পূর্ব সাধুপাড়ার মোশারফ হোসেন রুণাইয়ের বাসার সামনে। সেখানে আগেই জড়ো হয়েছে মুন্নাফ, নিমু, লালসহ অনেকেই। সবাই মিলে ইছামতী পার হয়ে গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউটের কাছে চলে আসি। সেখানে পেয়ে যাই রফিকুল ইসলাম বকুল, ইকবাল হোসেনসহ অনেক ছাত্রলীগ নেতাকে। খবর আসে পাবনা আওয়ামী লীগের নেতা আমজাদ হোসেনকে ধরে নিয়ে গেছে। তুলে নিয়ে গেছে ব্যবসায়ী সাইদসহ অনেককে। মাঝে মাঝে বাসায় আসি, চাচা, চাচিমা, চাচাতো ভাই-বোনকে সাবধান করি।
ওরা শহরের রাজপথ টহল দেয়, কিন্তু পুলিশ লাইনে হাত দেয় না অথবা দেওয়ার সাহস পায় না। আমরা বুঝতে পারি যে ওরা ঘোঁট পাকাচ্ছে পুলিশ লাইনকে আত্মসমর্পণ করানোর। পাকসেনাদের অবস্থান সার্কিট হাউসে। তখনও মুক্তি বাহিনী গঠন হয়নি, কিন্তু বোঝা যায় যে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। শহরের মূল রাস্তায় পাকসেনা ঘোরাফেরা করে, আর আমরা ছাত্রলীগ-জনতা শহরতলির অলিগলিতে অবস্থান করি। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখি। সবার শপথ, ভাঙতে হবে কারফিউ। এবারের কারফিউ ভাঙা ছিল ঊনসত্তর থেকে আলাদা। গতবার ছিল আইয়ুব খানকে হটানো, এবার পুরো পাকিস্তানকেই হটিয়ে দেওয়া। ছাত্রলীগ নেতাদের নেতৃত্বে আমরা অবস্থান নেই পুলিশ লাইনের চারপাশের সাধুপাড়া, হাউসপাড়া, আটুয়া, লাইব্রেরিপাড়াসহ বিভিন্ন গ্রামে। ছাত্রলীগ কর্মী-জনতা মিলে স্লোগান তুলি ‘জয় বাংলা’। হাজারো মানুষের কণ্ঠ মিলে তা হয়ে ওঠে লাখো জনতার স্লোগান। পাকসেনারা ব্রিজ পার হওয়ার সাহস পায় না, ফিরে যায় সার্কিট হাউসে। এতে সাহস বাড়ে জনতার। পরের দিন রাতে আবারও বের হয় পাকসেনারা। কিন্তু এবারে দ্বিগুণ লোকের সমাগম। স্লোগান ওঠে গমগম করে। সে রাতেও ফিরে যেতে বাধ্য হয় পাকসেনারা। জনতা বিজয়ের আলো দেখতে পায়। পরের দিন শহরের অলিগলি থেকে গেরিলা কায়দায় ছোট ছোট মিছিল করতে শুরু করি। পাবনার প্রধান সড়ক এমএ হামিদ সড়কের টিঅ্যান্ডটি অফিসে অবস্থান করছে এক প্লাটুন পাকসেনা। সাহসী কয়েকজন গলির ফাঁকফোকর গলে পৌঁছে যায় তার চারপাশে। ইটের আধলা দিয়ে আড়াল থেকে ঢিল ছুড়তে শুরু করে তারা। এতে ভয় পেয়ে পাহারারত পাকসেনারা গেট ছেড়ে ভেতরে চলে যায়। বিজয়ের লগ্ন ফুটে ওঠে জনতার কাছে। দ্বিগুণ উৎসাহে কেউ কেউ ভেতরে ঢিল ছুড়তে শুরু করে, ওরা আরো ভয় পেয়ে যায়, ঘরে গিয়ে দরজা আটকায়। জনতা দেয়াল টপকে ভেতরে যায়। ওদের ঘরের দরজায় দমাদম পড়তে থাকে ইটের আধলা। একসময় ভেঙে যায় দরজাও। ওরা ভয়ে লুকিয়ে যায় চৌকির নিচে। সেখান থেকে জনতা বের করে আনে পাকসেনাদের। গণপিটুনি দেয়, কেড়ে নেয় হাতের অস্ত্র। জনতার দখলে আসে টিঅ্যান্ডটি অফিস। সে যুদ্ধ পাবনার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘টিঅ্যান্ডটি ভবন যুদ্ধ’ নামে বিখ্যাত হয়ে আছে।
পুলিশ সদস্যরা যুক্ত হয় জনতার কাতারে, তাদের অস্ত্রও চলে আসে জনতার হাতে। কারাগার ভেঙে বের করে আনা হয় নেতাদের। জনতা ঘেরাও করে সার্কিট হাউস। বিমানবাহিনীর সহযোগিতায় পাকসেনারা বেরিয়ে পালিয়ে যায় রাজশাহীর দিকে। বাংলাদেশ সরকার গঠনের আগেই পাবনায় বাংলাদেশ সরকারের নামে চালু হয় প্রশাসন, ব্যাংক, বীমা, ডাক বিভাগ।
১১ এপ্রিল পুনরায় পাবনা শহর দখলে নেয় পাকসেনারা। আমি সিরাজগঞ্জ চলে আসি ২০ এপ্রিল। জুন মাসের প্রথম দিকে চলে যাই কুড়িগ্রাম মহকুমার মুক্ত এলাকা রৌমারীতে। ইয়থ ক্যাম্পে বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর সদস্যরা আমাদের প্রশিক্ষণ দেন। এক্সপ্লোসিভ প্রশিক্ষণও করানো হয়। আগস্টের শেষের দিকে গাইবান্ধা মুক্তিযুদ্ধের এক দলপতি এসে জানান, কিছু ব্রিজ-কালভার্ট ভেঙে দিতে এক্সপ্লোসিভ প্রশিক্ষণ পাওয়া মুক্তিযোদ্ধা দরকার। আমি ও বন্ধু হাবিবুর রহমান ওই টিমে গাইবান্ধা চলে যাই। গাইবান্ধা-গোবিন্দগঞ্জ সড়কের দুটি কাঠের ব্রিজ, ওয়াপদা বাঁধ ধ্বংস, দুটি খণ্ডযুদ্ধ, স্বাধীনতাবিরোধী দমনে যুক্ত থাকি। এরপর ফিরে যাই রৌমারী ক্যাম্পে। অক্টোবরের প্রথম দিকে আমাদের শিলিগুড়ির পাথরঘাটায় পাঠানো হয় হায়ার ট্রেনিংয়ে। সেখানে ২১ দিন প্রশিক্ষণ নিই। সেখানে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে গঠন করা হয় তুফানী ব্যাটেলিয়ন। আমাদের চার্লি কোম্পানির কমান্ডার নিযুক্ত হন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর মতিলাল চক্রবর্তী। প্রশিক্ষণ শেষে ওই মাসেই আমাদের নিয়ে আসা হয় পশ্চিম দিনাজপুরের বালুরঘাট সীমান্তে। এখানে সীমান্ত পাহারা, রাতে পাকসেনা ক্যাম্প এড়িয়ে দেশের ভেতরে ঢুকে ওদের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালানোÑ এভাবে চলে পুরো নভেম্বর মাস।
ডিসেম্বরের ৪-৫ তারিখে দিনাজপুরের বিরল সীমান্ত দিয়ে ঢুকে পড়ি বাংলাদেশে। কোথাও টুকটাক যুদ্ধ হয়, অধিকাংশ এলাকাই মুক্ত হয়ে যায় সহজেই। তারপর শুধুই উল্লাস, আনন্দ, মুক্ত দেশে স্বাধীনভাবে নিঃশ্বাস নেওয়ার স্বপ্ন।
লেখক : ছড়াকার ও কথাসাহিত্যিক
আহ্বায়ক, সিরাজগঞ্জের গণহত্যা
অনুসন্ধান কমিটি