নিজেকে মহাকাশচারী হিসেবে তৈরি করতে রাশিয়ায় কঠোর পরিশ্রম ও সাধনা করছেন বাংলাদেশের তরুণ শাহ জালাল জোনাক। তার লেখা ‘মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’ বইটি প্রথম বাংলা বই হিসেবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন লাইব্রেরিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। আগামীর রকেটম্যানকে নিয়ে লিখেছেন আল আমিন
ছোটবেলার স্বপ্ন- হবেন মহাকাশচারী; যার লেখা বই মহাকাশের লাইব্রেরিতে স্থান করে নিয়েছে ইতোমধ্যে। বলছি রাশিয়ায় রকেট সায়েন্স পড়ুয়া পঞ্চগড়ের জোনাকের কথা। শাহ জালাল জোনাকের জন্ম বাংলাদেশের সর্ব-উত্তরের প্রান্তিক জনপথ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর গ্রামে। তার লেখা ‘মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’ বইটি ইতোমধ্যে মহাকাশ স্টেশনে জায়গা করে নিয়েছে। তার দাবি এটিই প্রথম বাংলা বই, যা মহাকাশ লাইব্রেরিতে স্থান পেয়েছে। জোনাকের বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গৃহিণী মায়ের একমাত্র পুত্রসন্তান জোনাক। জোনাক নামের অর্থ চাঁদের আলো। জোনাক তার পরিবারের জন্য কতটা আলো নিয়ে আসতে পেরেছে তা জানা নেই, তবে সে দেশের জন্য আলো নিয়ে আসতে চায়। এ জন্য সে দিন-রাত কাজ করছে।
শাহ জালাল জোনাকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা গ্রামেই, অত্যন্ত বিনয়ী এই ছেলে গ্রামের ভজনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে প্রাথমিক শেষ করে রাজধানীর উত্তরা রাজউক মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ হতে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে বর্তমানে রাশিয়ান বায়োমান মস্কো স্ট্রেট ইউনিভার্সিটি থেকে রকেট সায়েন্স বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। ছোটবেলা থেকেই রাতের নক্ষত্রখচিত আকাশ তাকে টানত, সেই আগ্রহ থেকেই মহাকাশচারী হতে নিজেকে তৈরি করছেন কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা। পড়াশোনার পাশাপাশি জোনাক লেখালেখি করেন এবং বিভিন্ন কর্মশালায় শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান পাঠে উদ্বুদ্ধ করেন। এ পর্যন্ত তার লেখা প্রকাশিত বই ৭টি। তার লেখা ‘মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’ বইটি গত ১৮ মার্চ, ২০২২ প্রথম বাংলা বই হিসেবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন লাইব্রেরিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। রাশিয়ার মহাকাশচারী ও তৎকালীন মহাকাশ স্টেশন কমান্ডার ওলেগ আর্তেমইয়েভ মহাকাশে গমনের সময় এই বইটি সঙ্গে নিয়ে যান।
বর্তমানে জোনাক রাশিয়ায় কঠোর পরিশ্রম ও সাধনা করছেন নিজেকে মহাকাশচারী হিসেবে তৈরি করতে। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি গ্রহণ করছেন প্রশিক্ষণ। রাশিয়ার বিভিন্ন মহাকাশচারীসহ বিশ্বের অন্যান্য মহাকাশচারীর কাছে নিচ্ছেন নানা দিকনির্দেশনা। তার মতে, বাংলাদেশের সরকার যদি কখনও কোনো মহাকাশচারীকে মহাকাশে পাঠায়, তবে যেন তাকে পাঠাতে পারে। এ জন্য নিজেকে তৈরি করছেন কঠোর সাধনা ও অধ্যাবসায়ে।
এ ছাড়া জোনাক রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘রসকসমস’-এর নিমন্ত্রণে প্রথম বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে কাজাখস্তানে অবস্থিত রাশিয়ার মহাকাশে রকেট উৎক্ষেপণের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং নিরাপত্তা বেষ্টিত স্থান বাইকোনুর কসমোড্রাম পরিদর্শন করার এবং সেখানে থেকে সরাসরি মহাকাশে রকেট উৎক্ষেপণ পর্যবেক্ষণ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সেখান থেকে তিনি রাশিয়ার মহাকাশে রকেট উৎক্ষেপণের সব প্রযুক্তি এবং বিষয়বস্তু নিয়ে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। শুধু তাই নয়, রাশিয়ার মস্কো শহরের অদূরে করোলেভ শহরে অবস্থিত রাশিয়ান ‘মিশন কন্ট্রোল সেন্টার’ যেখান থেকে মহাকাশে যাওয়ার সব রকেট এবং আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয় ও মহাকাশে অবস্থিত মহাকাশচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। সেই ‘মিশন কন্ট্রোল সেন্টার’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানের সবকিছু সে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে হাতে-কলমে জ্ঞান অর্জন করে।
জোনাক বলেন, আমি বাইকোনুর কসমোড্রোম যাওয়ার সিকিউরিটি চেকিং গেটের পাশে গিয়েছিলাম। এখান থেকে মহাকাশের দূরত্ব মাত্র ৮ মিনিট! এই কসমোড্রোম থেকেই অনেক মহাকাশচারী রকেটে চড়ে মহাকাশে যায়। আমার রুশ বান্ধবী আন্না বলল, জোনাক এখানে একটি ছবি তোলো, তুমিই প্রথম কোনো বাংলাদেশি যে এই সিকিউরিটি গেট অতিক্রম করে ভিতরে প্রবেশ করছো! আমিও দৌড়ে গিয়ে ছবি তুললাম। পরে খেয়াল করলাম আমার ডানপাশের রকেটের নিচে লেখা- ‘বাইকোনুর-নক্ষত্রের দিকে যাত্রা।’
মহাকাশ যান নিয়ে এক অভিজ্ঞতার গল্প বলতে গিয়ে জোনাক বলেন, সয়ুজ রকেটের একটি অংশ দেখেছিলাম। সত্যিকার অর্থেই এটি এক সময় মহাকাশে মহাকাশচারীদের নিয়ে গিয়ে আবার এখন পৃথিবীতে ফেরত এসেছে। রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি পেলাম এটি দেখে। সয়ুজ রকেটের ওই অংশটির নাম ডিসেন্ট মডিউল। এর ভিতরেই বসে থাকেন মহাকাশচারীরা এবং এটিই রকেটের একমাত্র অংশ, যা মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে ফেরত আসে। এর চারপাশে কালো ছিল। মূলত পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢোকার সময় ঘর্ষণের কারণে এর চারপাশে আগুন লেগে যায়। বলা যায়, মহাকাশচারীরা তখন একটি আগুনের দলার ভিতরে বসে থাকেন। জানালা দিয়ে দেখেন যে বাইরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে! সে সময় প্রায় ৫ মিনিট ৪০ সেকেন্ডের মতো পৃথিবীর গ্রাউন্ড কন্ট্রোল বা মিশন কন্ট্রোলের সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে।
মহাকাশ যান এ নিজের বই ভেসে বেড়ানো দেখার অনুভূতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে জোনাক জানান, কুপোলা হলো আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের একটি মডিউল, যেখান থেকে মহাকাশচারীরা পৃথিবীকে দেখে। প্রত্যেক মহাকাশচারীরই মহাকাশ স্টেশনের এই বিশাল বড় জানালার প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা থাকে। এই জানালার পাশে বসে কেউ গান গায়, কেউ পৃথিবীতে রেখে যাওয়া প্রিয় মানুষদের মুখগুলোর কথা ভেবে তাদের অবসর সময় কাটান। কোনো কোনো মহাকাশচারী মহাকাশ স্টেশনে যাওয়ার পরপরই আগে এই কুপোলাতে গিয়ে পৃথিবীটা দেখে।
মহাকাশ থেকে পৃথিবীর বেশিরভাগ সুন্দর সুন্দর ছবিগুলো তোলা হয়েছেও এই কুপোলা থেকে। আমারও খুব ইচ্ছে মহাকাশচারী হতে পারলে এই কুপোলাতে বসে পৃথিবী দেখব আর প্রিয় মানুষদের কথা ভাবব! ভাবতে খুব অবাক লাগছে যে, বাংলা ভাষার প্রথম বই যা আমার লেখা বা আমার সৃষ্টি এখন ঠিক সে জায়গায়, যে জায়গায় আমি যেতে চাই। ছবিটা দেখার পর আমার চোখে পানি চলে এসেছিল। আমি চোখ মুছছিলাম, ঠিক তখনই মহাকাশ থেকে রাশিয়ান মহাকাশচারী ওলেগ আর্তেমইয়েভ একটা মেসেজ পাঠাল, যার বাংলা অর্থ- ‘মহাকাশে ভেসে বেড়ানোর জন্য প্রস্তুত হও এবং কখনও হাল ছেড়ে দিও না। আমি এখনও সবকিছু বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না। আমি জানি, আমাদের দেশের জন্য এসব কিছুই নতুন। সবাইকে বিষয়গুলোর সঙ্গে অভ্যস্ত করতে বা গুরুত্বটুকু বুঝাতে কিছুটা সময় লাগবে। কীভাবে বলি, এটা আমাদের দেশের জন্য কত বড় অর্জন! সত্যি বলতে, এটা বলতেও আমার একটু অস্বস্তি লাগছে।
মহাকাশ, রকেট এসব শুধু বিজ্ঞান নয়, বরং একটি দেশের নিরাপত্তা, সম্মান ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জোনাক তার দক্ষতা এবং কাজ দিয়ে অর্জন করে নিয়েছে দুর্লভ অনেক বিষয়। জোনাক সামনের দিকে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে পাড়ি জমাক মহাকাশে, দেশের গৌরব ও সম্মান বয়ে আনুক। তা হলেই জোনাককে দেখে জন্ম নেবে হাজারও জোনাক। এই জোনাকরা মিলেই গড়ে তুলবে আলোকিত, সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ।
সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি
প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু
রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯
যোগাযোগ
প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]
বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]
বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯, +৮৮০১৮১৫৫৫২৯৯৭ । ই-মেইল: [email protected]
সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]
2023 Protidiner Bangladesh All Rights Reserved. Developed By Protidiner Bangladesh Team.