× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সাক্ষাৎকার

বীরাঙ্গনাদের পরিপূর্ণ কোনো তালিকা নেই- সুরমা জাহিদ

লোপা মমতাজ

প্রকাশ : ২০ মার্চ ২০২৩ ১২:৫৮ পিএম

আপডেট : ২০ মার্চ ২০২৩ ১৬:০৯ পিএম

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক সুরমা জাহিদ

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক সুরমা জাহিদ

লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। এই অর্জনের পেছনে রয়েছে হাজারো নারীর সম্ভ্রম হারানোর ইতিহাস। যাদের আমরা ‘বীরাঙ্গনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমন ৬০০ বীরাঙ্গনার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের গবেষক সুরমা জাহিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন লোপা মমতাজ...


লোপা মমতাজ : আপনি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরে প্রায় ৬শ বীরাঙ্গনার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন। দীর্ঘ সময়ের কাজ। কেন এ বিষয়টি বেছে নিলেন? 

সুরমা জাহিদ : আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে। এই গল্পগুলো শুনে শুনে আমি বড় হয়েছি। সেটা আমার আব্বার মুখে। তো এই গল্প বলতে গিয়ে ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দটি চলে এলে আব্বা চুপ হয়ে যেতেন। তার কাছে জানতে চাইতাম- আব্বা বীরাঙ্গনা কি, এ বিষয় আসলে তুমি কেন চুপ করে থাকো? আব্বা কম সময়ই আমার প্রশ্নের উত্তর দিতেন। মাঝে মাঝে বলতেন- বড় হও, বুঝতে পারবে। তখন থেকেই আসলে মাথায় রয়ে গিয়েছে ‘বীরাঙ্গনা’ কি?- এটা আমাকে জানতে হবে। ঘটনাক্রমে একদিন আমি একজন বীরাঙ্গনার ঘটনা শুনতে পেলাম। এরপর ওই ভদ্রমহিলা যখন চলে যান তখন আমি জানতে পারি, তিনিও বীরাঙ্গনা। এভাবেই আসলে তাদেরকে নিয়ে কাজ করার আগ্রহ জন্মে আমার। এ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি বিষয় আমাকে খুব টানে। শুধু বীরাঙ্গনাই নয়- ‘আমরা যুদ্ধশিশু’ নামেও আমার একটা কাজ রয়েছে। এ ছাড়াও ‘কিশোরীদের দেখা মুক্তিযুদ্ধ’ নামেও বই আছে।

 * কাজটি শুরু করলেন কবে থেকে? 

 ** ১৯৯৭-৯৮ সাল থেকে মূলত এই কাজটি শুরু করি আমি। তখন তো আসলে কেউ প্রকাশ্যে আসতে চাইত না। এ বিষয়ে কোনো তালিকাও ছিল না। আমি অনেকের কাছে গিয়েছি তাদের নাম-ঠিকানার জন্য, কোথাও পাইনি। 

* বীরাঙ্গনা সমগ্রতে অনেক বীরাঙ্গনার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন,  তারা আজ পর্যন্ত যোগ্য সম্মানটুকু পাননি। অনেকে আড়ালে থেকে গিয়েছেন। তাদের খুঁজে পেয়েছেন কীভাবে?

** বীরাঙ্গনাদের নিয়ে ভাবনার সেই সময়গুলোয় একদিন জানতে পারি ড. নীলিমা ইব্রাহিমের একটা বই আছে- ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’। তার কাছেও গিয়েছি বহুবার। তখন বীরাঙ্গনাদের কোনো তালিকা ছিল না বিধায় আমাকে এ বিষয়ে তেমন কোনো সাহায্যও করতে পারেননি। তবুও আমি থেমে থাকিনি। দৈনিক ইত্তেফাকের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রাহাত খানের কাছে যাই। তার কাছে গিয়ে অনুরোধ করি আমাকে সাহায্য করার জন্য। তিনি প্রথমে রাজি ছিলেন না। কিন্তু পরে রাজি হন। তার সাহায্য নিয়ে আমি কয়েকটি জেলা ও উপজেলায় গিয়ে কাজ করি। রাহাত খান অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি আর তাকে এ বিষয়ে বলতে পারিনি।

আমি যখন তথ্য সংগ্রহে যেতাম, আমার তখন থাকার একটা দরকার হতো। আমার স্বামী সরকারি কর্মকর্তা। তিনি বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় বলে রাখতেন আমার থাকার জায়গার জন্য। তখন আমি উপলব্ধি করলাম, এই মানুষগুলোর সহযোগিতা নিয়েও তো কাজ করা সম্ভব। পরবর্তী সময়ে আমি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের সহায়তায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা, চেয়ারম্যান, গণ্যমান্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই কাজগুলো এগিয়ে নিয়েছি।

* গবেষণাধর্মী এ কাজগুলো করতে গিয়ে নিশ্চয়ই অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন।

** প্রতিবন্ধকতা তো ছিল অনেক। নানা সমস্যায়ও পড়েছি। জামালপুরের একজন নারীর কথা যদি বলি- ওনার নাম ছিল সম্ভবত রেশমি, হিন্দু মহিলা। মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ছিল ষোলো বা সতেরো। তাকে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি ক্যাম্পেই আটক ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একজন মুক্তিযোদ্ধা তাকে উদ্ধার করে সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে যান। কারণ তার অবস্থা খুব খারাপ ছিল সে সময়। সুস্থ হয়ে পরিবারের কাছে ফিরে গেলে পরিবার তাকে গ্রহণ করেনি। তখন ওই মুক্তিযোদ্ধা তাকে বিয়ে করেন, সংসার শুরু করেন। এই মানুষটির সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। রেশমি আমাকে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি ছিলেন, তার স্বামীও রাজি। কিন্তু তার বাড়ির কেউ এ বিষয়ে সম্মতি দেয়নি। উনি আমাকে বললেন, আপনি যদি আশপাশে কোথাও থাকতে পারেন- আমরা রাতের বেলায় কথা বলব। আমি তখন জামালপুর শহরে ফিরে আসি। থাকার ব্যবস্থা করি। আমার স্বামী আমার সঙ্গেই ছিল। কুপিবাতি জ্বালিয়ে রাতে কাজ করতাম। তিন দিন এভাবে কাজ করি। কিন্তু তারা টের পেয়ে যায়। তৃতীয় দিন আমাদের থাকার ঘরের দরজায় শিকল দিয়ে তালা মেরে আটকে দেয়। একটু বেলা হওয়ার পর দেখি বাইরে উঠানভর্তি মানুষ। তারা আমাদের অনেক কথা শুনাল, অনেক আজেবাজে কথা বলল। সেখানে উপস্থিত গণ্যমান্যদের অনেক বোঝালাম, কেন আসলে এই কাজটা করছি আমরা। তারপর তারা বলল, ঠিক আছে- তাহলে আপনি আপনার রেকর্ডার আর ক্যামেরা দিয়ে যান আমাদের। আমি ক্যামেরা নিয়ে যাই নাই। রেকর্ডারও ছিল একটা কলমের মতো। অনেক বুদ্ধি করে লুকিয়ে সেটাও নিয়ে আসতে সক্ষম হই। তারা শেষ পর্যন্ত বলেছে- ‘মহিলা তো, তাই গায়ে হাত দিলাম না।’ দুপুর ৩টা পর্যন্ত আটক হয়ে ছিলাম আমরা। 

* এমনও তো হয়েছে অনেক বীরাঙ্গনা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাননি। তাদের কীভাবে রাজি করিয়েছেন?

** হ্যাঁ, এমন ঘটনাও আছে। অনেকে কথা বলতে চায়নি। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে, তাদের ভেতর ঢুকে যেতে হয়েছে আসলে। অনেকে বলেছে, আপনি আমার ঘটনা জানতে পারেন কিন্তু আমার নাম-ঠিকানা ব্যবহার করতে পারবেন না। অনেকে আংশিক কথা বলেছে, পুরো কথা বলেনি। তবে অধিকাংশ বীরাঙ্গনাই খোলামেলা কথাই বলেছে। কিন্তু তারা আবার ঠিকানা গোপন রাখতে চেয়েছে। কারণ শেষ পর্যন্ত তো তিনি নারী। তারা এই বিষয়গুলো সন্তান বা পরিবারের সদস্যদের কাছে প্রকাশ করতে চায়নি। 

* অনেকের সঙ্গে আপনি কথা বলেছেন, তাদের বেদনাগুলো ধারণ করেছেন। কখনও এমন হয়েছি কী, তাদের কথা শুনে আপনি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন, আপনি আর নিতে পারছিলেন না?

** আমি যখন সাক্ষাৎকার নিতাম, বীরাঙ্গনাদের কথা রেকর্ড করতাম তখন এমন অনুভূতি হতো না। কিন্তু যখন লিখতে বসতাম তখন তাদের কথা আমাকে গ্রাস করত। অনেকেই আছেন, তাদের ঘটনা যখন লিখতাম- তখন কখন যেন কলম থেমে যেত, নিজের অজান্তেই লেখার খাতা ভিজে যেত চোখের জলে। কমলা নামের একজন আছে- যার কথা লিখে আমি দুই আড়াই মাস আর কলম ধরতে পারিনি। কুমিল্লার ফুলবানু, যুদ্ধের সময় ওনার বয়স তখন দশ কি বারো বছর। সেই বয়সে তার ওপর এত নির্যাতন হয়েছিল যে তার কোমরের জয়েন্ট ডিসপ্লেস হয়ে যায়। এখনও তিনি সোজা হয়ে হাঁটতে পারেন না। গাজীপুরের মমতাজ, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি আট বা নয় মাসের গর্ভবতী ছিলেন। তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর এতটাই নির্যাতন করা হয় যে, তার গর্ভের সন্তানটি মারা যায়। পরবর্তী সময়ে তার ইউটেরাসে পচন ধরে যায়। এ অবস্থায় গ্রামবাসীর কেউই তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। পচন ধরে যখন গন্ধ বের হচ্ছিল তখন আশপাশের কয়েকজন এসে তার স্বামীকে বলল, ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। মমতাজের স্বামীর উত্তর ছিল- ‘পাকিস্তানিরা ছক্কা মেরে গিয়েছে আর আমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব!’ তাকে নিয়ে যায়নি ডাক্তারের কাছে। তখন গ্রামবাসীরা ওই বাচ্চাকে কেটে কেটে বের করে আনে। এরপর তার বাড়িতে খবর দেওয়া হয়। তারা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যায়। চার বছর চিকিৎসার পরেও তিনি সুস্থ হন নাই। বড় বড় কয়েকটা অপারেশন করানো হয়। পেট কেটে তার পায়খানার রাস্তাটা নাভির বাঁ পাশে করে দেওয়া হয়। প্রথমে বুঝিনি, কিন্তু পরে তিনি যখন আমাকে সেটা দেখান তখন আমি স্বাভাবিক থাকতে পারিনি। 

গাজীপুরের কাপাসিয়ার আরেকজনের কথা বলি, তার নাম মনোয়ারা। ওনার বিয়ে হয়েছিল ১৯৭০ সালের মার্চ বা এপ্রিল মাসে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তাকে স্বামীসহ ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায় পাকিস্তানিরা। তাকে বলা হয়, তাদের কথামতো চললে তার স্বামীকে কিছু করবে না। কিন্তু দুই মাস পর পাকিস্তানিরা ওই ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় মনোয়ারার চোখের সামনে তার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করে। পরে তারা যেখানেই ক্যাম্প করত, তাকে সঙ্গে নিয়ে যেত। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আগে তাকে পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়।  সারাদিন ঘরে আটকে রেখে সন্ধ্যায় বিভিন্ন ক্লাবে নিয়ে যাওয়া হতো। এরপর তাকে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তার ভাষ্যমতে, জাহাজে করে তাকে সৌদি আরব, ফ্রান্স, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশে নিয়ে গিয়েছিল ব্যবসায়ীরা। বাণিজ্য শেষে আবার তাদের সঙ্গে চলে আসতেন তিনি। যখন তাকে দিয়ে এ কাজ আর হচ্ছিল না তখন সম্ভবত ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে এক কাপড়ে বের করে দেয়। তিনি হাঁটতে হাঁটতে একটা মাজারে গিয়ে আশ্রয় নেন। ততদিনে তিনি বাংলা বলতে ভুলে গিয়েছেন। মানসিকভাবেও কিছুটা বিপর্যস্ত। তখন স্থানীয় দুইজন মানুষ তাকে সহায়তা করেন। চিকিৎসা শেষে তারা যেকোনোভাবে বছর দুয়েক বাদে তাকে দেশে পাঠান। দেশে ফিরেও তিনি ভয়ে থাকতেন, উর্দুতে কথা বলতেন, বোরকা পরে থাকতেন সব সময়। শরীরজুড়ে নানা ধরনের উল্কি আঁকা। নিজ পরিবারের কাছে ফিরে এলেও থাকতেন পলিথিন দিয়ে ঘেরা একটা ঘরের মধ্যে। 

খাগড়াছড়ির এক মারমা সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর বীরাঙ্গনার কথা বলি। যুদ্ধের সময় ওনার বয়স ছিল ১৭ বছর। বিয়ে হয়েছিল এক বছর। তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর নির্যাতনের ফলে যখন তার শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়, তখন একজন পাকিস্তানি মেজর তাকে নিয়ে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। একদিন তিনি ওই মেজরকে অনুরোধ করলেন, আমাকে যত খুশি ধর্ষণ করো তুমি, কিন্তু আমার এলাকা থেকে আর কোনো নারীকে তুমি এখানে এনে নষ্ট করো না। তার এই অনুরোধ মেজর রেখেছিল। এরপর দেশ স্বাধীন হলো, তিনিও মুক্তি পেয়ে শ্বশুরবাড়ি বাড়ি গেলেন। স্বামী কোথায় কেউ বলতে পারে না, সেখানে কেউ তাকে জায়গা দেয়নি। বাবার বাড়ি গেলে এলাকাবাসী তার বাবাকে বলে, এই মেয়েকে এখানে জায়গা দিলে তোমাদের এলাকা থেকে বের করে দেওয়া হবে। তিনি আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, যখন আমি নিজ বাড়িতে যাই, শত শত মানুষ আমাকে দেখতে এসেছিল, যেন আমি চিড়িয়াখানার প্রাণী। আমাকে বের করে দেওয়ার সময় মা এক কোণে দাঁড়িয়ে কান্না করছিল। আমি অনুরোধ করেছিলাম, মাকে একবার ছুঁয়ে দেখতে দাও। কিন্তু তারা তা দেয়নিÑ এরপর তিনি একটা পাহাড়ে চলে যান। সেখানেই বাকি জীবন কাটিয়েছেন।

* কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা কি আছে, যার মাধ্যমে জানা যাবে কতজন নারী বীরাঙ্গনা?

 ** বীরাঙ্গনাদের পরিপূর্ণ কোনো তালিকা নেই। আসলে করা হয়নি কখনও। আমি সমস্ত দেশ ঘুরে এবং বিভিন্ন বইপত্র ঘেঁটে যা মনে হলো, চার লাখেরও বেশি বীরাঙ্গনা আছেন। পিরোজপুরের দিকে প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরেই এমন নির্যাতনের সাক্ষী মানুষ আছেন। কুড়িগ্রাম গিয়ে একটা অভিজ্ঞতা হয়। এই জেলার সদরে বেশ কয়েকজন বীরাঙ্গনা আছেন। তাদের মধ্যে তিন জনের সঙ্গে কথা হয় আমার। একজন নারীকে পেয়েছি, যার মেয়েকে বিয়ের পর পাকিস্তানিরা তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে। এই ঘটনা যখন ওই মেয়ের বাবা জানতে পারে, তখন মেয়েকে ধরে নিয়ে যাওয়ার অপরাধে তার মাকে তালাক দিয়েছিল মেয়েটির বাবা। 

* আমরা ধারণা করি, দেশের বাইরেও এমন নির্যাতিত নারী আছেন। সে রকম কোনো তথ্য কি আপনার কাছে আছে?

 ** আমি যখনই যে দেশে যাই না কেন, এই বিষয় নিয়ে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করি। দক্ষিণ আফ্রিকায় এমন একজনকে পেয়েছিলাম। তিনি প্রথমে ভারতে যান, সেখান থেকে বিভিন্নভাবে আফ্রিকায় যান। ওনার নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তবে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম আমি। আমেরিকার নিউইয়র্কেও একজনের দেখা পেয়েছিলাম। এ ছাড়াও আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের আগরতলা, আসাম, কলকাতায় অনেক বীরাঙ্গনা আছেন। 

* দেশের বাইরে কতজন বীরাঙ্গনা আছেন- এ বিষয়ে কি কোনো পরিপূর্ণ তথ্য আছে আপনার কাছে? 

 ** এ বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। যুদ্ধ শেষে অনেকেই পরিবারসহ সবাই চলে গিয়েছেন। পিরোজপুরে মাসহ তিন মেয়ের কথা জানি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা সবাই নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তারা পুরো পরিবার চলে গিয়েছেন দেশের বাইরে। এমন অনেকেই আছেন। 

* মুক্তিযুদ্ধের ওপর আর কোন বিষয়ে আপনার বই আছে? 

 ** ‘কিশোরীদের দেখা মুক্তিযুদ্ধ’ নামে একটা বই আছে আমার। ১৯৭১ সালে যারা কিশোরী ছিলেন তাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে বইটি। তাদের বর্ণনা নিয়ে এই বইটিও বেশ মর্মান্তিক। এমনও আছে, মা-খালা-দাদি, নানিদের ওপর সংগঠিত নির্যাতন তারা দেখেছে আড়াল থেকে। 

* আরেকটি বই ‘১৯৭১’ নামে। পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের নিয়ে। এই কাজটিও নিশ্চয়ই অনেক কঠিন ছিল।

** গবেষণাধর্মী সব কাজই আসলে কঠিন। ১৯৭১ থেকে ৭৩/৭৪ পর্যন্ত পাকিস্তানে আটকে পড়া মানুষরা কেমন ছিলেন, এ বিষয়ে জানার ইচ্ছা ছিল। বিশেষ করে যারা বন্দিশিবিরে আটক ছিলেন। যুদ্ধের পরপর অনেক বাঙালিকে বিভিন্ন বন্দিশিবির ও জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ওই জায়গাগুলো ছিল খুব দুর্গম। চারদিকে পাহাড় আর কাঁটাতার দেওয়া বেড়া। তার ওপর আবার পাহারাদার। ওই অঞ্চলগুলো ছিল শীতপ্রবণ। প্রচণ্ড শীতের সময় তাদের একটা বা দুটো কম্বল দেওয়া হতো, থাকতে হতো ফ্লোরে। তাদের রেশন, পানি, বিদ্যুৎ এসব সরবরাহ মাঝে মাঝেই বন্ধ করে দেওয়া হতো। খাবারও দেওয়া হতো পরিমাণে কম। পাঁচজনকে দেওয়া হতো তিন জনের সমপরিমাণ খাবার। এভাবে বিভিন্নভাবে কষ্ট দেওয়া হয়েছিল এই মানুষদের। 

* আপনার কাজের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন। নির্মোহভাবেই কাজ করেছেন, কোনো কিছু পাওয়ার আশায় নিশ্চয়ই নয়। তবুও এই প্রাপ্তিতে কেমন লেগেছে আপনার? 

** শ্রমসাধ্য এই কাজের পর সরকারের তরফ থেকে এমন স্বীকৃতি পেয়ে আনন্দিত তো বটেই, গর্বিতও। কারণ, আমার কাজ সম্পর্কে তারা জেনেছে, তারা মনে রেখেছে। এ জন্য আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। 

* গবষণাধর্মী এই কাজগুলো করতে গিয়ে কাদের বা কোন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা পেয়েছেন?

** প্রথমেই বলি কোনো প্রতিষ্ঠান আমাকে সহযোগিতা করেনি। যখন প্রথম শুরু করি তখন কোনো ব্যক্তিও আমাকে সহযোগিতা করেনি। আমার বাবার মুখে শোনা যুদ্ধের কথাগুলো আমি লালন করে নিজের ভেতর তাড়া অনুভব করেছিলাম। এরপর আমার পরিবারও যখন নানাভাবে বাধা দিয়ে আমাকে মানাতে পারেনি, তখন সর্বাগ্রে এগিয়ে এসেছিলেন আমার স্বামী। তার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। যদিও প্রথমে তিনিও এগিয়ে আসেননি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি এত পরিমাণে সাহায্য করেছিলেন যে, তাকে ছাড়া এই কাজ একার পক্ষে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না। 

* এত কাজের পর, অর্জনের পর- কোনো অতৃপ্তি আছে কি?

** এই মানুষগুলো অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। কিন্তু তারা কখনও কোনো স্বীকৃতি পায়নি। এখন অনেকেই অকপটে নিজেদের কথাগুলো বলেন। কিন্তু আমি যখন কাজগুলো করেছি, তখন তারা অনেকটাই অন্ধকারে ছিলেন। আসলে অতৃপ্তি নিয়ে এখনও ভাবিনি। কারণ আমি এখনও কাজ করেই যাচ্ছি। এখনও নতুন কোনো বীরাঙ্গনার সন্ধান পেলে তাদের কাছে যাচ্ছি, কথা বলছি। আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা যদি বলেন, আমি বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে চাই ১৯৭১ সালে আমার দেশের নারীদের ওপর চলা নির্যাতনের কথাগুলো। 

* তথ্য সংগ্রহের কাজগুলো শুরু করার সময় আপনি কারও সহযোগিতা পাননি। কিন্তু আপনি ভেঙে পড়েননি। এ বিষয়ে অনেক মেয়েই এখন কাজ করতে আসছে। তাদের উদ্দেশে আপনার কী বলার আছে?

 ** আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, নিজের ভেতরে যে তাড়া আছে, সেটা অনুভব করতে হবে। আমি যেমন দু-একজনের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে আমাকে আরও জানতে হবে, আরও জানতে হবে। সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী আমি কাজ করবÑ এই চিন্তা কিন্তু প্রথমে আমার ছিল না। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে আমি এতটা কষ্ট পেয়েছিলাম যে, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমি ভাবতাম, এটা কী করে সম্ভব! তাদের যে কষ্ট সেটা আমাকে গ্রাস করত। তারাও আমাকে বলতে পেরে নিজেকে হালকা করেছে। কয়েকজন বলেছে, আজ তুমি আমার কথা শুনতে এসেছো। একটা সময় আমি বলতে চেয়েছি, কিন্তু কেউ শুনতে চায় নাই আমার কথা।

* আপনাকে ধন্যবাদ সময় দেওয়ার জন্য।

** আপনাকেও ধন্যবাদ।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: protidinerbangladesh.pb@gmail.com

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: pbad2022@gmail.com

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: pbonlinead@gmail.com

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: pbcirculation@gmail.com

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা