অনুলিখন : রাজু আহমেদ
প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০২৩ ১৩:১৩ পিএম
৭ মার্চ আমি গ্রামেই ছিলাম। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন এবং তা রেডিওতে সম্প্রচার হবে। আমাদের গ্রামে একটা মাত্র রেডিও ছিল। ভাষণ শুনতে সবাই জড়ো হয়েছি। আমাদের মন খারাপ। রেডিওতে ভাষণ প্রচার হয়নি। তবে পরের দিন ৮ মার্চ সকাল ৭টার খবরের পরপরই রেডিওতে ভাষণটা প্রচার হয়। ওই ভাষণ শুনে অনুপ্রাণিত হই।
আমি তখন পলিটেকনিকের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের সদস্য। সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হই। ২৫ মার্চ রাতের ঘটনা আমরা তাৎক্ষণিক জানতে পারিনি। বগুড়ায় যুদ্ধ হচ্ছে জানতে পেরে ২৬ মার্চ ভোরে আমরা ওই দিকেই যাচ্ছিলাম। সান্তাহারে পৌঁছতেই অবাঙালিদের হাতে আটকা পড়লাম। নওগাঁর ইপিআরের সদস্যরা সান্তাহারে এসে বলল, আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। দেশ স্বাধীন হবে।
আমরা নওগাঁয় ফিরে বন্দুক নিয়ে এলাকায় টহল দিতে থাকি। ২২ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী ট্রেনযোগে সান্তাহার হয়ে নওগাঁ দখল করে। এ সময় তারা নাটোর থেকে নওগাঁ পর্যন্ত রেললাইনের দুই ধারের গ্রামে আগুন দিতে থাকে। আমার নিজের বাড়িও পুড়িয়ে দেয়।
এর পর আমরা মধুপুর ক্যাম্প হয়ে ভারতের মালদায় প্রশিক্ষণের জন্য যাই। সেখানে বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তিনি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে। তিনি আমাদের পরীক্ষা নিলেন। আমরা ১৩ জন নির্বাচিত হই আর্টিলারিতে যোগদানের জন্য।
প্রশিক্ষণ শেষে আমরা ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে রাজশাহী অঞ্চলের ৭নং সেক্টরের সাবসেক্টর ৩-এ যোগদান করি। আমাকে আর্টিলারি বাহিনীর মর্টার প্লাটুনের কমান্ডার হিসেবে নিয়োজিত করা হয় এবং মোবাইল ফায়ার কন্ট্রোলার হিসেবে দায়িত্ব পাই। শুরু হলো সম্মুখযুদ্ধ। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটের আগে ধোবরা আমের বাগানে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প। আমরা সোনামসজিদ এলাকায় ছিলাম।
ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর দখলের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হই। সোনামসজিদের প্রধান সড়ক ধরে প্রথমে শিবগঞ্জ, এরপর রানিহাটি দখল করলাম। ১১ ডিসেম্বর বারোঘরিয়া এলাকায় পৌঁছালাম। ১৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী মহানন্দা নদী পার হয়ে আমাদের দিকে আসার চেষ্টা করে। আমরা তা প্রতিহত করি। ওরা ফিরে যায়। আমরা নদীর এপার থেকে তাদের বাঙ্কার উদ্দেশ্য করে মর্টার শেল ছুড়ি, তা বিফলে যায়। নদীর ওপারেই তাদের বাঙ্কার। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর বললেন, এভাবে আর হবে না। আমাদের ওপারে গিয়ে সরাসরি হামলা করতে হবে। ১৪ ডিসেম্বর ভোরেই আক্রমণ করব।
ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ওয়াকিটকিতে প্রকাশ করতে নিষেধ দিলেন। আমাদের ওয়াকিটকি তখন হ্যাক হতো। সাব সেক্টর ৪-এর (লাল গোলা) মেজর গিয়াসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ক্যাপ্টেন জাগাঙ্গীর ফিরে আসলেন রাতে। রেকি করতে স্থানীয়দের সহযোগিতা নিতে নিষেধ করলেন। আমাদের মর্টারগান সুবিধমতো জায়গায় স্থাপন করতে বললেন। ১১ বছরের আলাউদ্দিন নামের এক স্থানীয় বালক আমাদের পাকবাহিনীর বাঙ্কার দেখিয়ে দিল। ওদের একটি বাঙ্করের নিরাপত্তায় ছিল অপর বাঙ্কার। পাশ দিয়ে পরিখা তৈরি করা ছিল। যার সঙ্গে হাটবাজার ও হাসপাতালের সংযোগ ছিল। এটা ধ্বংস করা ছিল প্রায় দুরূহ কাজ। এলাকা রেকি করে আমরা শত্রুপক্ষের অবস্থান নিশ্চিত হলাম।
১৪ ডিসেম্বর ভোরে ঠিক সময়ে যুদ্ধ শুরু হলো। আমরা মর্টার ছুড়লাম। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর পাকবাহিনীর বাঙ্কারের সম্মুখ থেকে যুদ্ধে অংশ নেন। অতর্কিত আক্রমণে শত্রুপক্ষের অনেকে বাঙ্কার ছেড়ে পালাতে থাকে। মহানন্দা নদীর কাছে ফেরিঘাট ছিল। সেই ফেরিঘাট পর্যন্ত আমরা দখলে নিই। এ সময় হঠাৎ পাকিস্তানি বাহিনী নতুন করে শেল নিক্ষেপ শুরু করে। আমরা শত্রুপক্ষের মর্টার শেল থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে আমরাও শেল ছুড়ছি। শত্রুপক্ষের বেশকিছু মর্টার শেল আমাদের কাছে বিস্ফোরিত হলো। এমন সময় দেখলাম ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ঢলে পড়ছেন। আমি তাকে জাপটে ধরি। ওনার মুখ থেকে নির্গত তাজা রক্তে আমার হাত ভেসে যেতে লাগল। আমাকে উনি অনেক কিছু বলার চেষ্টা করছেন। তার কোনো কথাই স্পষ্ট ছিল না। আমি শুধু চেয়ে রইলাম ওনার মুখের দিকে। দুই চোখের পানি বাঁধ মানল না। উনি যখন মারা যান আমি ওয়াকিটকিতে বলি ‘টাইগার আর নাই’। তার মৃত্যুতে আমরা অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম।
লেফটেন্যান্ট কাইউমের নেতৃত্বে আমরা আবারও আক্রমণ শুরু করলাম। শত্রুপক্ষও সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ শুরু করল। আমরা ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের লাশ সরাতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হই। মহানন্দার পূর্বে একটি মসজিদ আছে, সেখানে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর শহীদ হন। তার লাশ সরিয়ে নিয়ে মহানন্দার পশ্চিমে যেতেই লাশটা আর নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আমরা যেখান থেকে যুদ্ধ শুরু করেছিলাম, সেখানে ফিরে যাই। আমরা ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরকে ফেলে রেখে চলে আসি। এটা আমাদের এখনও তাড়া করে।
তবে আমরা মর্টার শেল নিক্ষেপ অব্যাহত রাখি। এর পর ১৫ ডিসেম্বর সকালে সাব সেক্টর ৪-এর (লাল গোলা) মেজর গিয়াসের নেতৃত্বে তার বাহিনী পূর্বদিক দিয়ে শত্রুপক্ষের এলাকায় ঢুকে পড়ে। সেখানে তারা দেখেন পাক হানাদার বাহিনী পালিয়েছে। আমরা শুনে দ্রুত ছুটে গেলাম বারোঘরিয়া থেকে ফেরিঘাটের কাছে। সেখানে গিয়ে দেখি ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের লাশ ওভাবেই রয়েছে। তার লাশ নদীর এপারে এনে রাখলাম। দেখলাম তার কপালে গুলি লেগে এপার থেকে ওপারে চলে গেছে। পরে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের লাশ সোনামসজিদে দাফন করা হয়। এভাবেই ১৫ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ শত্রুমুক্ত হয়।
অনুলিখন : রাজু আহমেদ
রাজশাহী প্রতিবেদক