সিফাত রাব্বানী
প্রকাশ : ২১ মে ২০২৩ ১২:৫৩ পিএম
জিপিএ ৪.৮৯ পেয়েও প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আমেরিকায় ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে স্নাতকে বৃত্তি পেয়েছেন আমিরুল ইসলাম শুভ
ব্যবসায় শিক্ষা থেকে ভালো ফল ব্যতীত বিদেশে বৃত্তি পাওয়া সহজ নয়। সেই অসাধ্যকে সাধন করে দেখিয়েছেন রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী আমিরুল ইসলাম শুভ। জিপিএ ৪.৮৯ পেয়েও প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে আমেরিকায় ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে স্নাতকে বৃত্তি পেয়েছেন তিনি। তার সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত জানাচ্ছেন সিফাত রাব্বানী
আমিরুল এসেছেন ঢাকায়, তখনই তার সঙ্গে চায়ের আড্ডায় বসলাম ঢাকার পলাশীর মোড়ে। এক সঙ্গে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কথা হলো তার বৃত্তি পাওয়া নিয়ে। সুযোগ পেয়েছেন আমেরিকার গেটিসবার্গ কলেজে ব্যবসায় শিক্ষায় স্নাতক করার। আমিরুল স্বপ্নের শুরুটা হয় একটা অনলাইন মিটিংয়ের মাধ্যমে।
তিনি একদিন তার এক বন্ধু আবিরের সঙ্গে গল্প করছিলেন। কথায় কথায় আবির বলে উঠে যে এইবার নাকি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সিয়াম সাহিদ নুর নাম করে একজন যাচ্ছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মাস্টার্সে?’ আবির উত্তর দিল ‘না, ব্যাচেলরস। তিনি ফুল ফান্ডেড বৃত্তি নিয়ে যাচ্ছেন।’ সেদিনই প্রথম জানতে পেরেছিলেন স্নাতকে বৃত্তি নিয়ে পড়তে যাওয়া যায়। তার পর কিছু ফেসবুক গ্রুপে এড হলেন। দেখলেন আসলে অনেকেই যাচ্ছে বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি নিয়ে। সেখান থেকেই তার এই স্বপ্নের সূচনা ঘটে।
সবারই নিজস্ব ধারায় একটা পরিশ্রমের ঘটনা থাকে। তারও ছিল। নিজেকে এই জায়গায় নেওয়ার পেছনের পরিশ্রম নিয়ে জানালেন, ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছেন মায়ের মুখে যে ‘পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি’। পরিশ্রম করতে কারোরই ভালো লাগে না, তার যে ভালো লাগত সেটাও বলা যাবে না, কিন্তু পরিশ্রম ছাড়া তিনি হয়তো কখনই নিজেকে আজ এই অবস্থানে আনতে পারতেন না বলে স্বীকার করে নিলেন । স্বপ্ন বোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি শুরু করেন কীভাবে স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তর করা যায় সে কাজে। কিন্তু বাসা থেকে অনেক বড় এক বাঁধা- দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া লাগবে।
শুরুতে এমন হয়েছিল যে টেনশনের জন্য টেনশন ছাড়া আর কিছুই মাথায় আসত না। কিন্তু আস্তে আস্তে বোঝা শুরু করলেন যে যদি আসলেই কিছু করতে হয় তাহলে সারাদিন ফেসবুক ঘেঁটে করে কিছুই হবে না। শুরু করলেন রুটিন বানানো। সকালে চেষ্টা করতেন দেশের ভর্তি পরীক্ষার পড়া শেষ করতে এবং বিকাল আর রাতে দেশের বাইরের যাওয়ার প্রস্তুতি পাকাপোক্ত করতেন। দিনের বড় একটা সময় চলে যেত অতিরিক্ত যোগ্যতার দিকে মনোযোগ দিতে। বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করার জন্য লেখা লাগত অনেক রচনা। টানা ৪-৫ ঘণ্টা একটা চিপ্স আর কফি নিয়ে বসতেন কম্পিউটারের সামনে। যাত্রা অবশ্যই সোজা ছিল না, তবু তিনি পেরেছেন তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তর করতে।
তিনি আমেরিকা আর ভারতে আবেদন করেন। ভারতে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় এবং আমেরিকাতে গেটিসবার্গ কলেজে তিনি ফুল ফান্ডেড বৃত্তি পান। আমেরিকার ক্ষেত্রে তার নবম-দশম শ্রেণির একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট লেগেছিল। কলেজ থেকে নিতে হয়েছিল ‘ লেটার অব রেকমেন্ডেশন’ বা সুপারিশপত্র তিনটি। তিনি ৮টা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেন। তাই আট-দশটির মতো রচনা লিখতে হয়েছিল । রচনাগুলো অবশ্যই আমাদের দেশের গতানুগতিক রচনার মতো নয়। এটার কাঠামো অনেক আলাদা। তার পর নিজের প্রোফাইলে পড়াশোনার বাইরে যা কিছু করেছেন তা নিয়ে লেখেন । এসব কিছু নিয়ে আবেদন করেন এবং পরে সাক্ষাৎকার দেন । দেড় মাস পর তারা তাকে রেজাল্ট ইমেইল করে পাঠায়।
কোন ধাপটি সচরাচর চ্যালেঞ্জিং হয়ে থাকে এবং তার ক্ষেত্রে কোনটি হয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই উত্তর এলো, ‘সচরাচর রচনা লেখা বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে থাকে। এটা আমাদের দেশের গতানুগতিক রচনার মতো নয়। নিজেকে উপস্থাপন করতে হয় এখানে এবং এমনভাবে করতে হয় যেন আপনাকে হাজারো লোকের মাঝে খুব সহজে খুঁজে বের করা যায়।’ তার ক্ষেত্রে মনে হয়েছিল তার প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিতেই সমস্যা করবে। কারণ তিনি ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে আবেদন করেন আর তিনি কখনও কাউকে দেখেননি বৃত্তি পেতে এই বিভাগ থেকে। তার থেকে বড় বিষয় তার এসএসসি-তে জিপিএ ৫ ছিল না। তিনি ৪.৮৯ পান। তবে তার কলেজের ফল ভালো ছিল।
ফল ও দক্ষতা নাকি বিশেষ কোন সাফল্য বেশি সহায়তা করেছিল আপনাকে স্কলারশিপ পেতে এটা জানতে চাওয়ার পর পাওয়া গেল গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
আমেরিকায় একজন আবেদনকারীকে ভিন্নভাবে যাচাই করা হয়। তার মানে তারা শুধু ব্যক্তির ফলাফল ও দক্ষতা দেখবে না, বরং একজন মানুষ হিসেবে কেমন সেটাও বিবেচনা করবে। তার ক্ষেত্রে তিনি আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরের কাজের পাশাপাশি ব্যবসায়ের প্রতি ইচ্ছা ও প্রতিভা দেখিয়েছেন এবং তার যাত্রার সফলতা ও বিফলতা সুষ্ঠুভাবে ব্যক্ত করতে পেরেছিলেন সাক্ষাৎকারে। তাই তাকে মনোনয়ন বোর্ডের অফিসাররা পছন্দ করেছেন বৃত্তি প্রদানের জন্য।
তিনি কখনই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না। নিজের ওপর কখনই তেমন বিশ্বাস ছিল না যে এতদূর কিছু করতে পারবেন। কিন্তু তার মাঝে একটা ব্যাপার অনেক কাজ করতÑ‘হার না মানা’। তিনি প্রথমবার বাইরে আবেদন করার পর সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাদ পড়ে যান । কিন্তু হার মেনে নেওয়ার মতো ছেলে কখনই ছিলেন না। আগেই ভেবেছিলেন যে পারবেন না, তাও আবেদন করা হোক। কারণ আবেদন করলে তো সম্মানহানি হচ্ছে না, তো দোষ কী তাতে?
তার এতদূর আসার পেছনে অনেকের অবদান আছে। আল্লাহ পাশে ছিলেন দেখেই এতদূর আসতে পেরেছেন। তার জন্য লাখ লাখ শুকরিয়া জ্ঞাপন করতে ভুল করলেন না। একটু থেমে আবার বললেন, এরপর যদি কেউ থাকে সে হচ্ছে তার বন্ধুরা। আবির, তনয়, সামি, সাবাবা, নেহাল, নাওয়াল আপু, পারিসা, অনুপম, আকিলা, নওশিন, শাহিনুর, অনিল, মির, জুবায়ের। নাম হয়তো বলতে গেলেও শেষ হবে না। এরা তাকে মানসিকভাবে অনেক সাহায্য করেছে। এদের ছাড়া হয়তো তিনি এতদূর আসতে পারতেন না।
ওখানকার পরিবেশে কতটা মানিয়ে নিতে পারবেন এই জিজ্ঞাসায় উত্তর এলো অত্যন্ত দৃঢ় মনোভাবসম্পন্ন। নিজের মধ্যে এমন মানিসকতা নিয়ে এসেছেন যে মানাতে হবে। ভাতের পরিবর্তে ফাস্টফুড, আড্ডা মারার বন্ধু না থাকা সব মানিয়ে নিতে হবে জানালেন।
আমিরুলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা দেশে ফিরে ব্যবসা দাঁড় করানোর চেষ্টা করা। আর এখন চেষ্টা করছেন যারা বাইরে আবেদন করতে যায় তাদের বিনামূল্যে সহায়তা করতে। একটা ফেসবুক পেজ খুলেছেন নিজের নামে সেখানে সাহায্য করে থাকেন।
বর্তমানে নিজের আলাদা একটা পরিচয় পেয়েছেন। সবাই তাকে ‘তিন কোটি টাকার ছেলে’ বলে ডাকে। কিন্তু তার পকেটে এখন একশত টাকা আছে যেটা খুবই দুঃখের বিষয়। সব থেকে বড় যেটা পেয়েছেন তা হচ্ছে সম্মান, যা নিজের বন্ধু বা আত্মীয়দের সামনে। জানালেন তাকে নিয়ে পত্রিকায় যখন এই ফিচার প্রকাশিত হবে তিনি তার মাকে গিয়ে দেখাবেন আর বলবেনÑ ‘সারাদিন ফোন টিপে তোমার ছেলে এগুলো করেছে!’ আম্মুর সামনে এইসব বলা যে কত বড় অর্জন এই বলে কিছুক্ষণ বিনয়ের সঙ্গে হেসে নিলেন।
ব্যক্তি আমিরুলকে নিয়ে ধারণা দেওয়া যাক। তিনি নিজের সম্পর্কে খুব বেশি জানেন না! এটা নাকি তার থেকে তার বন্ধুরা ভালো বলতে পারবে। কিন্তু জীবনে চেষ্টা করেন অন্যের সহযোগিতা করতে এবং তার নানুর কথা অনুসরণ করতে- কথাটি হলো ‘জীবনে কাউকে যেন কষ্ট না দেই বা না ঠকাই’। কিন্তু তিনি ব্যক্তি হিসেবে কুৎসিত এবং আবেগি এক ছেলে এটাও ব্যাখ্যা করলেন। জীবনে অনেক ব্যর্থতার সাক্ষী হয়েছেন। নিজেকে স্টিভেন হি-এর মতো ব্যর্থ মনে হয় কখনও কখনও। কিন্তু যা-ই হোক ‘আলহামদুলিল্লাহ’।
তার সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক আলোচনাও হয়েছে বেশ। বাংলাদেশে একটা সত্য যেটা অনেকেই জানে না যে মানবিক ও বিজ্ঞান বিভাগের তুলনায় ব্যবসায় শিক্ষায় ফল ভালো করা তুলনামূলক কঠিন। এক্ষেত্রে তার জন্য কিছু বিষয় জটিল আবার কিছু সহজ মনে হয়েছে। তার ক্ষেত্রে খুব ভালো লাগার একটি বিষয় হচ্ছে হিসাববিজ্ঞান। শুরুতে এটা খুব কঠিন মনে হতো কিন্তু বোঝার পর অনেক আগ্রহ লাগত অংকগুলো করতে। ফিন্যান্স একটু কঠিন মনে হতো তার কাছে। রেজাল্টও খুব একটা ভালো ছিল না অন্য বিষয়ের তুলনায়।
বাদ দেওয়ার সুযোগ থাকলে মার্কেটিং নিতেন। ব্যবসায় শিক্ষায় যেহেতু ভালো একটা অবস্থানে নিজেকে নিয়ে যেতে পেরেছেন- এক্ষেত্রে অবশ্যই এই বিষয়গুলোর প্রতিটি স্তরে জ্ঞানের সূক্ষ্মতা থাকা জরুরি ছিল এবং তার সেই সূক্ষ্মতা ছিল। নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করতে পেরেছেন। জানালেন, বাইরে পড়তে যাওয়ার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণই ভিন্ন। চেষ্টা করেছেন অনলাইন কোর্স করে কিছু কিছু বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করার। অবশ্যই শুরুতে অনেক সমস্যা হয়েছে ভাষা নিয়ে। কারণ সেখানে শিক্ষকরা ইংরেজি ভাষায় বোঝায়।
আমরা এটা বলে থাকি ব্যবসায় শিক্ষায় যারা পড়াশোনা করে তারা তুলনামূলক স্মার্ট হয়ে থাকে। তার মতে, স্মার্টের বিষয়টা সম্পূর্ণ ব্যক্তিনির্ভর। আমরা নানাভাবে স্মার্টনেস বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করি। কিন্তু বিবিএ পড়া শিক্ষার্থীদের প্রেজেন্টেশনের বিষয় আলাদা থাকে।
দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও কিন্তু ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ সর্বাধুনিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে দেশের সেরা মেধাবীরা পড়ছে। তার এখানে লক্ষ্য ছিল কিনা জানতে চাওয়া হয়। জানালেন, তার দেশে থাকলে বিইউপি-তে পড়ার খুব ইচ্ছা ছিল কিন্তু চান্স পাননি। ঢাবি অনেক ভালো বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু শিক্ষার মান এবং শিক্ষকদের মানের দিক থেকে ঢাবি অনেক পিছিয়ে আছে বলে ব্যক্ত করলেন। যদিও চান্স পাওয়ার পর ভালো লাগার জায়গাটা অনেক বেড়ে যায় নিজের ফ্যাকাল্টির পরিবেশ দেখে, বিশেষ তার বন্ধুদের। তার কাছে মনে হয় বিদেশে ব্যবসায় শিক্ষায় পড়াশোনা করে বাংলাদেশে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া খুব সহজ নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্ভব না কিন্তু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্ভব কিছু ক্ষেত্রে।
ব্যবসায় শিক্ষায় পড়ে অনেকের স্বপ্ন থাকে চার্টাড অ্যাকাউন্টেড হওয়ার। তার ইচ্ছা একটা ব্যবসা দাঁড় করানোর এবং নিজেকে বিশ্বের অন্যতম স্বনামধন্য মানুষ হিসেবে পরিচিতি দেওয়ার।
তার মতো যারা ব্যবসায় শিক্ষা থেকে বৃত্তি পেতে চায় কিংবা সাফল্য পেতে চায়, তাদের উদ্দেশ্যে তার মূল্যবান পরামর্শ হলো : কখনও হার মানা যাবে না লোকে যা-ই বলুক না কেন। আইইএলটিএস কখনও বৃত্তি এনে দেয় না- এটা মাথায় রাখতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের সময় চোখ খোলা রাখতে যেন কোনো সুযোগ হাতছাড়া না হয়। রচনা লিখা শিখতে বলেছেন তিনি। নিজেকে বইয়ের পৃষ্ঠায় আবদ্ধ না রেখে বাইরের জগৎকে কাজে লাগাতে হবে তার মতে। ভালো বন্ধু বানাতে হবে যারা আপনার মতো বা আপনার থেকে ভালো। ফেসবুকের রিসোর্সগুলো সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করলে অনেক কাজে আসবে।