প্রতিবছর বিশ্বের সম্ভাবনাময় তরুণ উদ্ভাবক ও উদ্যোক্তাদের তালিকা প্রকাশ করে থাকে মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস। এ তালিকায় পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাময়িকী ফোর্বসের ২০২৩ সালের ‘থার্টি আন্ডার থার্টি’ তালিকার এশিয়া ক্লাসে স্থান করে নিয়েছেন পাঁচ উদ্যোগের সাত বাংলাদেশি তরুণ উদ্যোক্তা। বিস্তারিত জানিয়েছেন ফারহাত মাইশা অর্পা
ফোর্বস ম্যাগাজিন তাদের ‘থার্টি আন্ডার থার্টি’ ক্যাটাগরির অষ্টম বার্ষিক তালিকা প্রকাশ করেছে। গত বৃহস্পতিবার ফোর্বসের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে শীর্ষ এশীয়দের তালিকা। এ তালিকায় স্থান পাওয়া বাংলাদেশের তরুণরা হলেন- আজিজ আরমান, রুবাইয়াত ফারহান ও তাসফিয়া তাসবিন, জাহ্নবী রহমান, আনোয়ার সায়েফ অনিক ও সারাবান তাহুরা এবং দীপ্ত সাহা। প্রতিদিনের বাংলাদেশের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন ।
যাত্রীসেবায় আরমানের যাত্রী ডটকম
ফোর্বসের ‘থার্টি আন্ডার থার্টি’ তালিকার কনজিউমার টেকনোলজি ক্যাটাগরিতে মনোনীত হয়েছেন বাংলাদেশের যানবাহনে প্রযুক্তিসেবা প্রদানকারী কোম্পানি ‘যাত্রী’র প্রতিষ্ঠাতা আজিজ আরমান। ২০১৯ সালের দিকে খন্দকার তাসওয়ার জাহিন ও জিয়াউদ্দিনকে নিয়ে যাত্রী ডটকমের যাত্রা শুরু করেছিলেন আজিজ আরমান। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন গণপরিবহনগুলোতে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সফটওয়্যারভিত্তিক ই-টিকেটিং সেবা চালু করেছিলেন তিনি।
মূলত দেশের গণপরিবহনগুলোতে যাত্রীদের ন্যায্য ভাড়া নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে যাত্রী ডটকম নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। এর বাইরেও ন্যায্যমূল্যে যাত্রীদের গণপরিবহন সেবায় বিভিন্ন সাশ্রয়ীমূল্যের গণপরিবহন ভাড়া দিয়েও সোয়তা করে থাকে। গণপরিবহনে স্বচ্ছতা ও যাত্রীদের ভোগান্তি নিরসনে কাজ করছে যাত্রী ডটকম। রিফ্লেক্ট ভেঞ্চারস, ব্রেইন-টু-ফ্রি ভেঞ্চারস ও এসবিকে টেক ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ২০২১ সালের দিকে ১.২ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পেয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটি। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫.৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পেয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটি।
ফারহান ও তাসফিয়ার মার্কোপলো ডটএআই
রুবাইয়াত ফারহান ও তাসফিয়া তাসবিন কাজ করছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডিজিটাল মার্কেটিং সেবা প্রদান করতে। ডিজিটাল সেবা প্রদানকারী এ প্রতিষ্ঠানটির নাম মার্কোপলো ডটএআই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে সুলভমূল্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্যের প্রচারে কাজ করছে এই প্রতিষ্ঠানটি। মিডিয়া, মার্কেটিং ও বিজ্ঞাপন ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পেয়েছে মার্কোপলো ডটএআই প্রতিষ্ঠানটি। রুবাইয়াত ফারহান অনুভূতি ব্যক্ত করে জানিয়েছেন, ‘এ সম্মাননা আমাকে মনে করিয়ে দেয় অন্যদের মতো গ্র্যাজুয়েশন শেষে গতানুগতিক চাকরি জীবন বেছে না নিয়ে আমার ভিন্ন কিছু করার সিদ্ধান্ত সঠিকই ছিল।খারাপ সময়ে আমি ভেঙে না পড়ে নিজের উপর বিশ্বাস রেখেছিলাম এবং আমি কৃতজ্ঞ, যারা আমাকে পুরোটা সময় সাপোর্ট করে এসেছে।’
অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটির আরেকজন সহপ্রতিষ্ঠাতা তাসফিয়া তাসবিন বলেন, ‘ ফোর্বস ম্যাগাজিনের তালিকায় মনোনয়ন পেয়ে আমি সম্মানিত ও আনন্দিত। যারা আমার পাশে ছিলেন ও সাহস জুগিয়েছেন, সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। এটি কেবলই আমার ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং মার্কোপলো ডটএআই প্রতিষ্ঠা করতে আমি যে পরিশ্রম করেছি, সেটির ফসল। আমার উপর আস্থা রাখার জন্য মার্কোপলো ডটএআইয়ের টিমকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’
মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় জাহ্নবীর রিলাক্সি
সোশ্যাল ইম্প্যাক্ট ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পেয়েছেন জাহ্নবী রহমান। তিনি কাজ করছেন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তরুণদের সুলভমূল্যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতে। রাজশাহী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকাকালে হতাশায় ভুগছিলেন এ শিক্ষার্থী। একদিকে পড়াশোনার চাপ, অন্যদিকে পার্টটাইম কাজের প্রেশার। কিছুতেই পেরে উঠছিলেন না জাহ্নবী। এরপর শরণাপন্ন হয়েছিলেন একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে। বন্ধুরা জানতে পেরে হাসাহাসি করেছিল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খুব বেশি অকপটে আলোচনা বা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তবে মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা একটি মারাত্মক বিষয় এবং এর জন্য প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ পরামর্শ।
সেই ভাবনা থেকে জাহ্নবী শুরু করেন relaxy.com.bd যেখানে মানুষ সংকোচ ভুলে নিজের সমস্যার কথা শেয়ার করতে পারবে। relaxy.com.bd এর কার্যক্রম সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সুলভমূল্যে মানুষ নিজেদের মানসিক সমস্যার কথা শেয়ার করে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, থেরাপি ও মেডিটেশন সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। আমরাই দেশে প্রথম বাংলা মেডিটেশন সেবা নিয়ে এসেছি। গ্রাহকদের সব ধরনের তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রেখে আমরা পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করছি। ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষদের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জার্নিতে relaxy.com.bd সার্বিক পদক্ষেপ-পর্যালোচনা গ্রহণ করে মানসিক স্বাস্থ্য উন্নতি করতে সাহায্য করে।’ প্রাপ্তির অনুভূতি ব্যক্ত করে জাহ্নবী বলেন, ‘এ অনুভূতি একই সঙ্গে আনন্দের ও ভয়ের। কেননা প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব বেড়ে গেছে অনেকাংশে। যেহেতু আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খুব বেশি কথা বলা হয় না, তাই বিষয়টি খুব নাজুক। সবার কাছ থেকে অনেক অনেক শুভ কামনা ও ভালোবাসা পাচ্ছি। চেষ্টা করব দায়িত্ব নিয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়ার।’
তিনি আরো বলেন, ‘আরেকটি মজার বিষয় হলো, আমি নিজেই জানতাম না ফোর্বসের জন্য আমি মনোনয়ন পেয়েছি। হয়তো রিলাক্সির কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী মনোনয়নের জন্য আবেদন করেছিল, তাই ই-মেইল পেয়ে আমি একেবারে চমকে গেছি।’
relaxy.com.bd পথচলা মসৃণ ছিল না জাহ্নবীর জন্য। সাধারণত নারী উদ্যোক্তাদের নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয় কাজ করতে গিয়ে। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারীদের যেকোনো কাজে ছেলেদের চেয়ে দ্বিগুন চ্যালেঞ্জ ফেস করতে হয়। আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ছিল না। এ ছাড়া আমি ও আমার কো-ফাউন্ডার যারা ছিলেন, সবাই স্টুডেন্ট ছিলাম। ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটিতে পড়াশোনার চাপ সামলে কোম্পানি নিয়ে কাজ করা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল আমাদের জন্য। শুরুর দিকে তেমন কোনো সাপোর্ট ছিল না বললেই চলে। এর মাঝেও আমাদের চেষ্টা ছিল, স্ট্রাগল ছিল, মানুষকে সাহায্য করার মনোভাব ছিল। সেই থেকেই আজ এতদূর আসা।’
সায়েফ ও তাহুরার টার্টেল ভেঞ্চার স্টুডিও
তরুণ উদ্যোক্তাদের দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, পরামর্শসহ নেটওয়ার্কিং সুবিধা দিয়ে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে কাজ করছেন আনোয়ার সায়েফ ও সারাবান তাহুরার প্রতিষ্ঠান টার্টেল ভেঞ্চার স্টুডিও। বাংলাদেশে ভিন্নধর্মী এ উদ্যোগ নিয়ে তারাই সর্বপ্রথম কাজ শুরু করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তারা দম্পতি। ২০১৬ সাল থেকে ছয়জন বন্ধু মিলে ঠিক করেছিলেন ই-কমার্স সেক্টরে কাজ করবেন। এদের মধ্যে কেউ ছিলেন গ্রাফিক ডিজাইনার, কেউ ওয়েব ডেভেলপার, কেউবা মার্কেটিংয়ে পারদর্শী। সেখান থেকেই ২০১৮ সালে টার্টেল ভেঞ্চার স্টুডিওর যাত্রা শুরু হয়েছিল।
২০১৮ সালে প্রথম উদ্যোক্তাদের সবচেয়ে বৃহৎ গ্লোবাল কম্পিটিশন SHE LOVE TECH এর আয়োজকরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং একসঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করেন। এ ছাড়া নারী উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নিয়ে যেতেও তারা কাজ করছেন। এখন পর্যন্ত শতাধিক উদ্যোক্তার ১৫ মিলিয়নের বেশি বিনিয়োগ পেতে সাহায্য করেছে এ প্রতিষ্ঠানটি। কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে তারা- এ প্রশ্নের উত্তরে আনোয়ার সায়েফ বলেন, ‘পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতে উনিশ শতকের দিকে উদ্যোগের ধারণা নিয়ে কাজ শুরু হলেও বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে অনেক দেরিতে।
দেশীয় স্টার্টআপগুলোকে শুরুর দিকে বেশ ধাক্কার সম্মুখীন হতে হয়। বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো ও স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোর ট্যাক্সটেশন খরচ একই। এ ছাড়া অন্যান্য আইনি জটিলতা ও নিয়ম-কানুন মেনে অনেক সময় লেগে গিয়েছিল কাজ শুরু করতে। ফান্ডিং নিয়ে আমরা স্ট্রাগল করেছি, কেননা তখনও দেশে বিদেশি বিনিয়োগ শুরু হয়নি। কোভিডের সময় অনেক কর্মী ছাঁটাই করেছি, অফিস বাদ দিয়ে নিজের বাসার ড্রইং রুমে কাজ করেছি। কিন্তু সরকার এখন স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোকে সাপোর্ট করতে বাজেট বরাদ্দ করেছে, যা দেশীয় কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখবে।’
ফোর্বসের তালিকায় মনোনয়নের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথমত আমরা দুজনেই শকড। কখনোই আমরা ভাবতে পারিনি ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করার মতো গুরুদায়িত্ব আমাদের কাঁধে এসে পড়বে। যেকোনো প্রাপ্তি কাজের উৎসাহ অনেক গুন বাড়িয়ে দেয়। পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা পাচ্ছি। সবমিলিয়ে অনুভূতিটা দারুণ।’
কৃষিপণ্য নিয়ে কাজ করেন দীপ্ত সাহা
ফোর্বসের তালিকায় কনজিউমার টেকনোলজি ক্যাটাগরিতে স্থান পেয়েছেন দীপ্ত সাহা। অ্যাগ্রোশিফট টেকনোলজির সহপ্রতিষ্ঠাতা তিনি। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা একদিকে যেমন সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহের সুযোগ পাচ্ছেন, অন্যদিকে কৃষকরাও কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন। ফলে ক্রেতার উপর বাড়তি দামের চাপ কমছে অনেকাংশে। agroshift.com এর কার্যক্রম সম্পর্কে দীপ্ত সাহা বলেন, ‘কৃষকদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণে ও পোশাকশিল্পের নিম্ন আয়ের মানুষের হাতে সুলভমূল্যে কৃষিপণ্য সরবরাহ করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এর পাশাপাশি পোশাকশিল্পে কর্মীদের জীবনমান উন্নয়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ঢাকা জেলা ও আশপাশের এলাকার প্রায় সাতটি তৈরি পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানে পণ্য পৌঁছে দিচ্ছি আমরা। গ্লোবাল প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করার সুযোগ পেয়ে আমি আনন্দিত।’
সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি
প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু
রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯
যোগাযোগ
প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]
বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]
বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯, +৮৮০১৮১৫৫৫২৯৯৭ । ই-মেইল: [email protected]
সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]
2023 Protidiner Bangladesh All Rights Reserved. Developed By Protidiner Bangladesh Team.