× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

যে গ্রন্থাগার বিস্ময়কেও হার মানায়

এলিজা বিনতে এলাহী

প্রকাশ : ২৭ মে ২০২৩ ১২:০৮ পিএম

আপডেট : ২৭ মে ২০২৩ ১২:১৩ পিএম

পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ গ্রন্থাগার দ্য লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের অবস্থান ওয়াশিংটন শহরে

পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ গ্রন্থাগার দ্য লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের অবস্থান ওয়াশিংটন শহরে

আমেরিকা ভ্রমণে গিয়েছিলাম আসলে মার্কিন রাজ্য সরকারের আমন্ত্রণে। বাংলাদেশ থেকে পাঁচ সদস্যের একটি দলকে আমেরিকার স্টেট গভর্নমেন্ট আমন্ত্রণ জানায় ‘ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটর লিডারশিপ প্রোগ্রাম-২০২২’-এ। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় কিংবা নিজ উদ্যোগে যারা কাজ করছে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে, সে সুবাদেই আমেরিকার চারটি রাজ্যের বিভিন্ন শহরে ২১ দিন একটি দারুণ শিক্ষামূলক ও স্মৃতিময় ভ্রমণ সময় পার করেছি।

আমেরিকার সরকারি-বেসরকারি নির্ধারিত রুটিন সভা ও আলোচনা ছাড়া আমাদের কিছু অবসর দেওয়া হয়েছিল নিজের মতো সময় কাটানোর। সেই অবসর কাজে লাগিয়েছি আমি পুরোপুরি। ভ্রমণ শুরু হয়েছিল ওয়াশিংটন ডিসি শহর থেকে। ওয়াশিংটনকে আমার মনে হয়েছে সংগ্রহশালার শহর। জাদুঘর তো রয়েছেই, পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ গ্রন্থাগার দ্য লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের অবস্থান এই শহরেই। 

ছাত্রাবস্থায় আমাদের এক শিক্ষকের কাছে শুনেছিলাম লাইব্রেরি অব কংগ্রেস সম্পর্কে দারুণ এক তথ্য। তিনি বলেছিলেন, এই সংগ্রহশালার তাকগুলো পাশাপাশি সাজালে তা প্রায় ৫০০ মাইল দীর্ঘ হবে! মনে মনে ছবি আঁকার চেষ্টা করেছি আসলে এই পাঠাগারের অবয়ব কেমন হবে। কোনো অবয়ব দাঁড় করাতে পারিনি, কারণ তখন বিশ্ব ভ্রমণের কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। সে সময় গুগল আংকেল না থাকবার কারণে বড় পাঠাগার, বড় স্থাপনা কেমন হয় তার কোনো ধারণা ছিল না। তখন ভেবেছি, আসলে কি এই পাঠাগার দেখার কোনো সুযোগ ঘটবে আমার জীবনে! মেঘে মেঘে বেলা পার করে এই তো অল্প কয়েক দিন আগেই চোখ ভরে দেখে এলাম অনন্য এক গ্রন্থাগার! 

ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল আমেরিকার কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান কার্যালয়। ‘ক্যাপিটল’ প্রাসাদের কাছাকাছি একটি এলাকাজুড়ে তিনটি বিশালাকার বাড়িতে চলছে এই গ্রন্থাগারের বিস্ময়কর কর্মযজ্ঞ। করোনা-পরবর্তী সময়ে নিয়ম কিছুটা পরিবর্তন হওয়ায় এক দিন আগ থেকেই অনলাইনে কনফার্ম করতে হয় নিজের অবস্থান। নিজের পছন্দমতো সময় নির্ধারণ করে নিতে হয়। একসঙ্গে বেশি লোকের সমাগম যেন না হয়, সেজন্যই এই ব্যবস্থা। দুই দিন চেষ্টা করার পর সফলকাম হয়েছি, তাও আবার প্রবাসী এক বন্ধুর সহায়তায়। 

নির্ধারিত দিন ও সময়ের কিছু আগে গিয়েই উপস্থিত হলাম গ্রন্থাগারের সামনে। নিরাপত্তাবলয় পার হয়ে প্রবেশ করলাম জেফারসন বিল্ডিংয়ে। ঢুকে তো চোখ ছানাবড়া! এটি গ্রন্থাগার! রোমান স্থাপত্যশৈলীতে সাজানো পুরো স্থাপনাটি। দেয়াল, ছাদ, মেঝে, চারদিকের সাজসজ্জা, তৈলচিত্র, ভাস্কর্য ইঞ্চি ইঞ্চি করে উপভোগ করার চেষ্টা করছি। ছবি তুলব, ভিডিও করব, নাকি শুধু দেখতেই থাকব। দ্বিধান্বিত অবস্থায় থাকলাম বেশ কিছুক্ষণ। পুরো পরিবেশের সঙ্গে মনের খাপ খাওয়াতে খানিকটা সময় লেগেছে। নিরাপত্তাবলয় পার হওয়ার পর কিছু বুকলেট আর লাইব্রেরি ভ্রমণের ম্যাপ হাতে নিয়ে প্রবেশ করেছিলাম। থিতু হওয়ার জন্য এক কোণায় দাঁড়িয়ে সেগুলো পড়তে আরম্ভ করলাম। সেই বুকলেটগুলো থেকেই জানলাম লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের ইতিহাস। 

পেছনের কথা 

এই গ্রন্থাগারের বয়স ২২২ বছর। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকান রাষ্ট্রপতি জন অ্যাডামস যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যালয় ফিলাডেলফিয়া থেকে ওয়াশিংটন ডিসিতে সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে কংগ্রেস থেকে অনুমোদন নেন। এই সময় ওয়াশিংটন ডিসিতে কংগ্রেসম্যানদের নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহ ও বইপত্র ব্যবহারের জন্য কোনো উপযুক্ত গ্রন্থাগার ছিল না। রাষ্ট্রপতি অ্যাডামস শুধু কংগ্রেস সদস্যদের ব্যবহারের জন্য মাত্র পাঁচ হাজার ডলার ব্যয়ে একটি ছোট লাইব্রেরি স্থাপনের জন্য কংগ্রেস থেকে অনুমতি নেন। ইংল্যান্ড থেকে বই এনে খুব ছোট পরিসরে ক্যাপিটল প্রাসাদের পাশেই এই লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রথমে শুধু কংগ্রেসের লোকদের ব্যবহারের জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে নাম রাখা হয় ‘দ্য লাইব্রেরি অব কংগ্রেস’। কালক্রমে এর আকৃতি ও সংগ্রহের বিশালত্বের সঙ্গে সঙ্গে লাইব্রেরির দরজা খুলে দেওয়া হয় সর্বসাধারণের জন্য। ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে পুরো লাইব্রেরিটি পুড়িয়ে দেয় ইংরেজ সেনারা। যুদ্ধ শেষে আবার গড়ে তোলা হয় দ্য লাইব্রেরি অব কংগ্রেস। 

জেফারসন ভবন 

আমি এখন যে ভবন দেখে বিস্মিত হচ্ছি এটির নির্মাণকাল ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দ। এ ছাড়া আরও দুটি ভবন আছে। লাইব্রেরির জন্য প্রথম তৈরি হয় এই স্থাপনাটি। ৫০ জন সুনির্বাচিত স্থপতি, ভাস্কর ও চিত্রকর লাইব্রেরি বাড়িটি গড়ে তোলেন। অন্য বাড়িগুলো পরে তৈরি হয়। জেফারসন ভবনের সবচেয়ে বড় পড়ার ঘরটি তিন তলায়। 

এই স্থাপনার মেঝে থেকে পাথরের স্তম্ভগুলো ১৬০ ফুট উঁচু। শুধু এই একটি হলেই ৪৫ হাজারেরও অধিক রেফারেন্স বই আছে। ২১২ জন পাঠক একসঙ্গে বসে পড়তে পারেন এই একটি হলঘরে। এটি ছাড়া আরও পড়ার ঘর আছে। প্রতিটি ডেস্কে পৃথক আলো, আরামদায়ক চেয়ারের ব্যবস্থা আছে। পড়ার স্থানটি পাঠকবিহীন ছিল করোনা পরিস্থিতির জন্য। 

জন এডামস ও জেমস ম্যাডিসন মেমোরিয়াল ভবন 

জেফারসন বিল্ডিংয়ে লাইব্রেরির স্থান সংকুলান না হওয়ায় এই বাড়ির পেছনে তৈরি হয় জন অ্যাডামস ভবন, নির্মাণকাল ১৯৩৯ সালে। সাজসজ্জায় জেফারসন বিল্ডিংয়ের মতো না হলেও বাড়ির সামনের দিক সুন্দর মার্বেল পাথরে মোড়া আর তার প্রধান প্রবেশপথে ব্রোঞ্জের বিরাট দরজা। তাতে শোভা পাচ্ছে ১২টি মনুষ্য-মূর্তি। এই চমৎকার মূর্তিগুলো সেসব ঐতিহাসিক পুরুষদের, যারা পৃথিবীর নানা দেশে লেখার হরফ আবিষ্কার করেছিলেন। কলেবর বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় ১৯৮০ সালে নির্মাণ করা হয় জেমস ম্যাডিসন মেমোরিয়াল ভবন। এই তিনটি স্থাপনায় সাধারণ পাঠকদের জন্য ২১টি পড়ার রুম রয়েছে।

দুষ্প্রাপ্য বই আর ম্যাপের এক অনন্য সংগ্রহশালা 

প্রেসিডেন্ট জেফারসনের নিজস্ব পাঠাগারে অনেক দুর্লভ সংগ্রহ ছিল। সেগুলো তিনি লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। জেফারসনের সংগ্রহ থেকে ছয় হাজার ৪৮৭টি বাছাই করা গ্রন্থ লাইব্রেরি কিনে নেয়। এভাবেই লাইব্রেরির জন্য বই সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু হয়। 

বর্তমানে লাইব্রেরিতে প্রায় ৫০০টি ভাষার বই সংরক্ষিত রয়েছে। এখানে ২.৯ মিলিয়নের মতো আইনের বই, প্রায় সাত লাখের মতো উত্তর আমেরিকান অঞ্চলের বই, সাড়ে সাত লাখের মতো ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষার বই, আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়া বিভাগে রয়েছে ছয় লাখের অধিক বই। এশিয়ান বিভাগের রয়েছে প্রায় তিন লাখের মতো বই। শুধু তা-ই নয়, প্রায় দেড় কোটির ওপর বই ও পুস্তিকা আছে, আছে সাড়ে তিন কোটির ওপর পাণ্ডুলিপি ও পুঁথি। যার মধ্যে আমেরিকার রাষ্ট্রপতিদের কাগজপত্র, বিখ্যাত লেখক ও শিল্পীদের পাণ্ডুলিপি ও চিত্রও রয়েছে। এমনকি বিজ্ঞানীদের আবিষ্কারের খসড়াও এতে আছে।

এ ছাড়া এখানে আছে ৪০ লাখের ওপর ম্যাপ, যা খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দী থেকে একেবারে হাল আমল পর্যন্ত। আর আছে ষাট লাখ গানের স্বরলিপি, চিঠিপত্র, বাদ্যযন্ত্র, রেকর্ড, টেপ, ক্যাসেট ইত্যাদি। আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকা এক কোটির মতো নানা দুষ্প্রাপ্য ছবি ও ফটোগ্রাফ এবং বারোশ খবরের কাগজের নিয়মিত সংখ্যার ফাইল। প্রায় আড়াই লাখের ওপর চলচ্চিত্র ও ডকুমেন্টারি ফিল্ম এখানে আছে। লাইব্রেরির অমূল্য সংগ্রহ দুটি বাইবেল, গুটেনবার্গের ছাপা বাইবেল আর মেইনজের হাতে আঁকা ছবিসহ বিরাট আকারের বাইবেল। 

দ্য লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের সংগ্রহ থেমে নেই। প্রতি মিনিটে গড়ে এখানে ১০ থেকে ১৫টি বইসহ কাগজপত্র সংগ্রহ করা হচ্ছে, অর্থাৎ এই গ্রন্থাগারে দৈনিক গড়ে ১২ হাজারেরও বেশি বিষয় সংগৃহীত হচ্ছে। আমার জন্য নির্ধারিত ছিল তিন ঘণ্টা সময়। তিন ঘণ্টায় পুরো লাইব্রেরি ঘুরে দেখা যায়, কিন্তু এর গুরুত্ব আর ব্যাপ্তি ধারণ করা কিংবা অনুধাবন করা সম্ভবপর নয় বলে আমার মনে হয়। দারুণ এক ভালোলাগা নিয়ে ওয়াশিংটনের দিনটি ফুরাল।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা