× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

গহিন অরণ্য ঘুরে

জুলিয়া পারভীন

প্রকাশ : ২৭ মে ২০২৩ ১৩:০৮ পিএম

আপডেট : ২৭ মে ২০২৩ ১৩:৪৪ পিএম

গহিন অরণ্য ঘুরে
গহিন অরণ্য ঘুরে
পূর্ব আফ্রিকার দেশ কেনিয়ায় রয়েছে গহিন অরণ্য সাভো ন্যাশনাল পার্ক, বিস্ময়কর গোলাপি হ্রদ এলিমেন্টাইটা

পূর্ব আফ্রিকার দেশ কেনিয়ায় রয়েছে গহিন অরণ্য সাভো ন্যাশনাল পার্ক, বিস্ময়কর গোলাপি হ্রদ এলিমেন্টাইটা

গহিন অরণ্য ঘুরে

পূর্ব আফ্রিকার দেশ কেনিয়া। যেখানে রয়েছে গহিন অরণ্য সাভো ন্যাশনাল পার্ক, বিস্ময়কর গোলাপি হ্রদ এলিমেন্টাইটা। শত শত বর্গমাইল বিস্তৃত অরণ্যে হায়েনা, সিংহ, চিতার মতো মাংসাশী, জেব্রার মতো তৃণভোজী নিরীহ পশু সহাবস্থান করে। দেখা মেলে অগণিত গোলাপি ফ্লেমিংগোর। কেনিয়া থেকে লিখেছেন জুলিয়া পারভীন 

কেনিয়া নিঃসন্দেহে আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে সুন্দর দেশগুলোর মধ্যে একটি। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়া, উঁচু পর্বতমালা, সাদা বালুকাময় সৈকত, ক্যাম্পিং সাইট, বিস্ময়কর বন্যপ্রাণী, ওয়াইল্ডবিস্ট মাইগ্রেশন এবং জাতিগত বৈচিত্র্য কেনিয়াকে বিশ্বের অন্যতম পর্যটন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। অসম্ভব এই সুন্দর দেশটিকে আরও বেশি আবিষ্কার করতে তিন রাত এবং চার দিনের একটি অভিযানে আমরা গোলাপি হ্রদ ‘এলিমেন্টাইটা’, বিশ্ববিখ্যাত ভয়ঙ্কর বন ‘মাসাই মারা’ এবং রহস্যময় ‘নরকের গেট’ অন্বেষণ করতে যাচ্ছি।

পুরো অভিযানে আমরা কেনিয়ার উপকূলীয় শহর মোম্বাসা হতে রাজধানী নাইরোবি হয়ে রিফ্ট উপত্যকা অঞ্চলের নাকুরু, নাইবাসা এবং নারক প্রদেশ পাড়ি দেব । শুধু তাই-ই নয়, অভিযানটিকে আরও বেশি দুঃসাহসিক করে তুলতে কোনো হোটেল বা রিসোর্টে না থেকে তাঁবুতে রাত্রী যাপন করব। আমরা এই অভিযানটি করতে যাচ্ছি আমাদের শরীরকে আরও বেশি কঠিন অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে। বিশেষ করে রাশিয়ায় অবস্থিত ইউরোপের সর্বোচ্চ চূড়া ‘মাউন্ট এলব্রুস’ অভিযানের জন্য ।

লেক এলিমেন্টাইটা

কেনিয়ার গ্রেট রিফট ভ্যালিতে অবস্থিত এলিমেন্টাইটা। হ্রদটি ৪৮ হাজার একরজুড়ে বিস্তৃত। এখানে ৪৫০টিরও বেশি প্রজাতির পাখিসহ বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণী রয়েছে। এই হ্রদে দেখা যায় এমন কিছু পাখির মধ্যে রয়েছে ফ্লেমিংগো, পেলিকানস, হেরোনস, কর্মোরান্টস, গ্রেট হোয়াইট, আফ্রিকান স্পুনবিল এবং পাইড অ্যাভোকেট প্রজাতি অন্যতম। বিস্ময়কর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এই সোডা হ্রদের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এর অনন্য গোলাপি রঙ। হ্রদটি প্রায় ১৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এবং অগভীর, গড় গভীরতা মাত্র ১.৫ মিটার। 

যেভাবে পৌঁছাবেন?

নাইরোবি থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার উত্তরে এবং নাকুরু থেকে ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত লেক এলিমেন্টাইটা সড়কপথে ট্রান্স-আফ্রিকান হাইওয়ে থেকে প্রবেশ করতে হয়। তা ছাড়া আকাশপথে এই লেকটিতে আসা যায়। নিকটতম এয়ারস্ট্রিপ নাকুরু ( লেনেট) এবং সয়সাম্বু এয়ারস্ট্রিপের দূরত্ব যথাক্রমে ২১ কিলোমিটার ও ৪০ কিলোমিটার।

যাওয়ার সেরা সময়

এলিমেন্টাইটা হ্রদটি বছরের যেকোনো সময় দেখার জন্য একটি বিস্ময়কর স্থান, তবে শুষ্ক মৌসুম জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি এবং জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পরিদর্শনের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। 

আমাদের পরবর্তী কাজ হচ্ছে টেন্টের জন্য একটি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গা নির্বাচন করা। সাধারণত বন্যপ্রাণীর দল রাতে লেকটির কাছাকাছি সবুজ তৃণভূমিতে ঘাসের সন্ধানে আসে। আর তাই ঘাসযুক্ত স্থানে রাতে ক্যাম্প করা অনিরাপদ। অবশেষে আমরা লেকটির ঠিক তীরঘেঁষে, বালুময় ঘাসমুক্ত একটি স্থানকেই রাত্রিকালীন ক্যাম্পের জন্য বেছে নিলাম। হাজার হাজার গোলাপি ফ্লেমিংগো বেষ্টিত লেকটির তীরে রাত্রি যাপনের এক অনন্য রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে যাচ্ছি। আমাদের লেক এলিমেন্টাইটা অভিযানের অন্যতম কারণ ও উদ্দেশ্য একটাই।

‘গোলাপি ফ্লেমিংগো- বছরজুড়ে অসংখ্য পর্যটক ও পাখিপ্রেমীরা এই লেকে আসেন অগণিত গোলাপি ফ্লেমিংগোর অভাবনীয় সৌন্দর্য দেখতে। গোলাপি ফ্লেমিংগো হলো বড় ওয়াডিং পাখি। দীর্ঘ, সরু পায়ের জন্য এরা অগভীর পানির মধ্য দিয়ে খুব সহজে হেঁটে যেতে পারে। গোলাপি ফ্লেমিংগো ছয়টি বিভিন্ন প্রজাতির ফ্লেমিংগোর মধ্যে সবচেয়ে লম্বা, যা ৪ থেকে ৫ ফুট এবং ওজন সাড়ে তিন কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদের ডানার দৈর্ঘ্য ৫ ফুট পর্যন্ত লম্বা, যা তাদের প্রতি ঘণ্টায় ৫৬ কিলোমিটার গতিতে উড়তে এবং বাতাসে চমৎকারভাবে ভেসে থাকতে সহায়তা করে। 

সাভো ন্যাশনাল পার্কে চিতা-সিংহের দেখা মেলে 

সাভো অরণ্যে

ক্ষণিকের এ জীবনে দেখার কোনো শেষ নেই। বাঙালি ভ্রমণপ্রিয়, সে অনেক পুরোনো সত্য। বাঙালির ভ্রমণপিপাসা প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ বন্ধু শংকরলালকে বলেছিলেন, ‘জাতি হিসেবে আমাদের নতুন করে তৈরি করে নিতে হলে বেশ সহজেই অন্য জাতির সঙ্গে মিশতে জানতে হবে। তাই যেখানে পারো ভ্রমণ করো।’ ভ্রমণের ছড়াছড়ি যে আধুনিক এ সময়েই শুরু তা নয়, বরং মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যেও ভ্রমণের নানা বিষয়ের উপস্থিতি পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের ভাবনামতে, আফ্রিকা বরাবরই এক দূরবর্তী অন্ধকার মহাদেশ। তা ছাড়া এশিয়া ভিন্ন অন্য যেকোনো মহাদেশের মানুষ, প্রকৃতি, বন্যপ্রাণী, সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে জানার আগ্রহ আমাদের মনে বিশেষভাবে কাজ করে। এ হচ্ছে মানুষের অসীম কৌতূহল। ইতিহাসের শুরুতেই যা ছিল বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর চারণভূমি। এ কেনিয়ায় রয়েছে বিশাল সাভানা। যেখানে শত শত বর্গমাইল বিস্তৃত সেই তৃণভূমিতে হায়েনা, সিংহ, চিতার মতো মাংসাশী আর ইম্পালা, জেব্রার মতো তৃণভোজী নিরীহ পশু সহাবস্থান করে।

কেনিয়ায় মাসাইমারার পাশাপাশি আরও ৪০টির বেশি জাতীয় উদ্যান এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণাগার রয়েছে। সাভো ন্যাশনাল পার্ক বিশ্বের প্রাচীনতম জাতীয় উদ্যানগুলোর একটি। কেনিয়ার মোট ভূমির ৪ শতাংশ জুড়ে রয়েছে এ উদ্যানটি। কেনিয়ার উপকূল প্রদেশে অবস্থিত উদ্যানটি নাইরোবি-মোম্বাসা হাইওয়ে ও রেললাইন দ্বারা পূর্ব ও পশ্চিম এ দুই ভাগে বিভক্ত।

সাভো ইস্ট

সাভো ইস্ট ন্যাশনাল পার্ক হলো সমতল, শুষ্ক সমভূমির একটি প্রাকৃতিক এলাকা, যেখানে কাঁটাযুক্ত ঝোপ রয়েছে। এখানে জিরাফ, গাজেল, হার্টবিস্ট, হাতির পাল, সিংহ, জেব্রাসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীতে ভরা। 

যে ঘটনা শুনে ভয়ে আঁতকে ওঠে মন

১৮৯৬ সাল। ব্রিটিশরা মোম্বাসা থেকে ভিক্টোরিয়া হ্রদ পর্যন্ত উগান্ডা রেলওয়ে নির্মাণ শুরু করে। লুনাটিক এক্সপ্রেস নামে এ প্রকল্পটির নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন জন প্যাটারসন। সাভো নদীর ওপর সেতু নির্মাণের তিন মাসে প্রায় ১৩৫ জন রেল নির্মাণ শ্রমিক সিংহের আক্রমণে নিহত হন। এই নরখেকো সিংহরা মানুষকে তাদের তাঁবু থেকে টেনে নিয়ে যেত; যদিও কাঁটার বেড়া (বোমাস) তৈরি করা ছিল সুরক্ষার জন্য। অনেক কৌশলে অবশেষে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জন হেনরি প্যাটারসন সিংহদের গুলি করে হত্যা করেন। 

নাইল কুমিরের খোঁজে

পূর্ব আফ্রিকার প্রথম প্রশাসক ক্যাপ্টেন লুগার্ডের নামে জলপ্রপাতের নামকরণ হয়েছে ‘লুগার্ড ফলস’। গালানা নদীর সঙ্গে এ জলপ্রপাতটি মিশে গেছে। অজস্র কুমিরের দেখা মেলে এ নদীতে। আমরা যখন কুমিরের সন্ধানে এ নদীতে গেলাম তখন দেখে বোঝার উপায় ছিল না পানির মধ্যে তারা নিজেদের কীভাবে লুকিয়ে রাখে! এগুলোকে বলা হয় নাইল কুমির। আমরা স্থানীয় একজনের সহযোগিতায় কুমিরগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। এর পরই কুমিরগুলো সাঁতরিয়ে আমাদের দিকে আসতে লাগল। স্থানীয় লোকটি খাবার দেওয়ার ভঙ্গি করে এক-জাতীয় শব্দ করতে থাকল, আর এতেই কুমিরগুলো ভাবল আমরা তাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছি। এভাবে কখন যে একটা কুমির আমার দিকে আসছিল লক্ষ করিনি, সঙ্গে সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব আমি দৌড়ে নিজেকে রক্ষা করলাম।

৫৫০ মিলিয়ন বছর পুরোনো শিলা

কেনিয়ার সাভো ইস্ট ন্যাশনাল রিজার্ভের মুদান্ডা রক প্রায় ৫৫০ মিলিয়ন বছর পুরোনো একটি প্রাচীন শিলা। বিশাল তিমির পিঠের মতো দেখতে এ রকটি ১.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। 

সাভো ওয়েস্ট

সন্ধ্যা নামার আগেই ইস্ট পার্ক থেকে বেরিয়ে সাভো ওয়েস্ট পার্কের দিকে যাত্রা করলাম। পার্ক দুটি দেখার জন্য আলাদা ফি এবং আলাদা গেট ব্যবহার করতে হয়। সাভো ওয়েস্ট ন্যাশনাল পার্ক অনেক বেশি ঘন জঙ্গল ও সবুজে ঘেরা। পাহাড়ি ল্যান্ডস্কেপ, আগ্নেয়গিরির চূড়া, কালো বা শয়তানি লাভা, টাইটা পাহাড়ের দৃশ্য এবং আবহাওয়া ভালো থাকলে আফ্রিকার সর্বোচ্চ চূড়ার দেখা মেলে এ জঙ্গলে।

লাভা ফ্লোতে শয়তানের বাস!

প্রাগৈতিহাসিক যুগে এটি ওয়াকাম্বা উপজাতির শিকারের জায়গা ছিল। যখন পাহাড়ে অগ্ন্যুৎপাত হতো তখন স্থানীয়রা মনে করত এটা শয়তানের কাজ। স্থানীয়দের বিশ্বাস পাহাড়টি ভুতুড়ে। যদি পাহাড়টির খুব কাছাকাছি যাওয়া হয়, তাহলে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার প্রবল আগ্রহ বেড়ে যায়। আর যদি কেউ পাহাড়ের চূড়ায় ওঠে, তখন আর তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না! সাভো শুধু বন্যপ্রাণীর অভ্য়ারণ্য নয়, এটি নানা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। বন্যপ্রাণীর সঙ্গে এখানকার প্রচলিত গল্পগুলোও রহস্য হয়ে লুকিয়ে আছে, যা কি না আমাদের কয়েকবার ভ্রমণ থেকে সবটুকু তুলে ধরা সম্ভব নয়।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা