× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ঘরে বাইরে নারীর নিরাপত্তা

তানিয়া আক্তার

প্রকাশ : ১৯ জুন ২০২৩ ১৪:২০ পিএম

ঘরে বাইরে নারীর নিরাপত্তা

চলতি বছরের প্রথম কয়েক মাসে নারী নির্যাতনের ঘটনা কম ঘটলেও সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বেড়েছে আবার। পারিবারিক সহিংসতাসহ ধর্ষণ, খুন, বুলিং ও অপহরণের মতো ঘটনা ঘটছে অহরহ। ঘরে বা বাইরে- কোথাও যেন নিরাপদ নয় নারীরা।


ঘটনা-১

পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বগা ইউনিয়নের বালিয়া গ্রামের ২২ বছর বয়সি নারী মোছা. সাবিনা বেগম। মো. সুজন মোল্লা ঢাকায় দরজির কাজ করেন। বিয়ের সময় দুই লাখ টাকা যৌতুক দেওয়া হয় সাবিনার স্বামী সুজনকে। বিয়ের পরে আরও পাঁচ লাখ টাকা যৌতুকের দাবিতে স্ত্রীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করত সে। সাবিনা পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে টাকার দাবিতে সাবিনার ওপর চালানো হয় চরম নির্যাতন। মারধর থেকে নিজেকে রক্ষার চেষ্টায় দৌড়ে পালানোর সময় পেছন থেকে লাথি মারলে মাটিতে পড়ে যায় সাবিনা। এ ধরনের নির্যাতন সইতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়ে সাবিনা। রাতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার পথে অটোরিকশার মধ্যেই পাঁচ মাসের মৃত সন্তান প্রসব করে সাবিনা। স্ত্রীর ওপর এই নির্যাতনের কথা অস্বীকার করেছে সুজন। এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি।

ঘটনা-২

রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোডে ফাতেমা নাসরিন স্বামী মির্জা শাখাওয়াত হোসেন এবং একমাত্র মেয়েকে নিয়ে বসবাস করতেন। স্বামী মির্জা শাখাওয়াত হোসেন গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী। বাবার বাড়ির জমি বিক্রি করে এক কোটি টাকা এনে দিতে কয়েক মাস ধরেই শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন চলেছিল ফাতেমার ওপর। স্বামীর এই দাবি মানতে না চাইলে মার্চ মাসের মধ্যভাগে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে ও মসলা বাটার হামানদিস্তা দিয়ে ফাতেমার মাথায় আঘাত করেন শাখাওয়াত। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে শেরেবাংলা নগরের নিউরো সায়েন্স ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেই রাতেই মারা যান তিনি। এ ঘটনায় নিহতের পরিবার মামলা করলে স্বামী শাখাওয়াতকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

ঘটনা-৩

নাটোর সদরের মীরপাড়া এলাকার নবম শ্রেণির ছাত্রী লিজা (ছদ্মনাম)। এক সন্ধ্যায় প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার পথে পাশের পাড়ার আব্দুল্লাহ ও সিয়াম নামের দুই কলেজছাত্রসহ আরও কয়েক কিশোর তার পথ রোধ করে দাঁড়ায়। লিজা এ সময় তাদের হাত থেকে বাঁচতে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পেছন থেকে ওড়না টেনে খুলে নেয় তারা এবং শারীরিকভাবে নিগৃহ করে। বখাটে কিশোররা সেই দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করে নেয়। লিজা এরপর তাদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে রাস্তার পাশের এক বাড়িতে আশ্রয় নেয়। ওই বাড়ির লোকজন ও স্থানীয়রা পুলিশে খবর দিলে আব্দুল্লাহ ও সিয়ামকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

উপরের তিনটি ঘটনা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংঘটিত হলেও, ঘটনাগুলোর মধ্যে একটি মিল আছে। সেটা হলো প্রত্যেক ক্ষেত্রেই নির্যাতনের শিকার মানুষটি হলো ‘নারী’। এমন ঘটনা পত্রিকার পাতায় প্রকাশ পায় প্রতিদিনই। একটি দিনও বাদ যায় না, যেদিন নারী নির্যাতনের ঘটনা নেই।



নারীর নিরাপত্তা কি আছে আদৌ? ঘরে হোক বা বাইরে, কোথাও কি নিরাপদ আছে নারী? এই প্রশ্নের সরল জবাব, ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নয় নারীরা।

কেন নিরাপদ নেই, এই প্রশ্নের উত্তর বিগত বছরগুলোয় নানাভাবে দিয়ে আসছেন আমাদের আইনপ্রণেতা থেকে শুরু করে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন মানুষসহ সমাজ উন্নয়নে যুক্ত মুখপাত্ররা। নারী নির্যাতন রোধে কঠোর আইনও করা হয়েছে। কিন্তু নারী নির্যাতন কি থেমেছে? আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, সাম্প্রতিক সময়ে তো কমই চোখে পড়ছে নির্যাতনের খবরাখবর। কিন্তু আসলেই কি তাই? এমনটা মনে করে সুখলাভের কোনো সুযোগই নেই আমাদের।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ দেশের ১৩টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সম্প্রতি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের মে মাসে নির্যাতনের শিকার ৩১০ নারী ও কন্যাশিশু। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৯ শিশুসহ ৬৫ জন। ৮ শিশুসহ ১৫ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এক কন্যাশিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ৬ শিশুসহ ৯ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ১৭ কন্যাশিশুসহ ২৫ জন। উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে ১৫ কন্যাশিশুসহ ১৬ জন। অ্যাসিডদগ্ধের শিকার হয়েছে একজন। আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছে তিনজন। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৫ জন। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে হত্যা করা হয়েছে। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১০ শিশুসহ ১৬ জন। পারিবারিক সহিংসতার ঘটনায় শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে পাঁচজন। বিভিন্ন কারণে চার কন্যাশিশুসহ ৪৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ৯ কন্যাশিশুসহ ২৬ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। পাঁচ কন্যাশিশুসহ ২৪ জনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। তাদের মধ্যে চারজন আত্মহত্যার প্ররোচনার শিকার হয়েছে। ১২ কন্যাশিশুসহ ১৬ জন অপহরণের শিকার হয়েছে।

মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। সংগঠনটির হিসাবমতে, মে মাসে ৪৫৭টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এপ্রিল মাসে এই সংখ্যা ছিল ২৮৬টি। মে মাসে সংঘটিত ঘটনাগুলোর মধ্যে ধর্ষণ ৯৩টি। এপ্রিলের তুলনায় যা ৪৫টি বেশি। সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৪টি, ধর্ষণ ও হত্যা ৪টি। এর মধ্যে ১৪ প্রতিবন্ধী নারীও রয়েছে। ধর্ষণের শিকার ৯৩ জনের মধ্যে ৩২ জন শিশু, ৩৪ জন কিশোরী রয়েছে। অপরদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১ জন শিশু ও ৫ জন কিশোরী এবং ধর্ষণ ও হত্যার শিকার ২ জন শিশু, ১ জন কিশোরী ও ১ জন নারী। ধর্ষণের চেষ্টা ১৮টি, যৌন হয়রানি ২৭টি ও শারীরিক নির্যাতনের ৯৫টি ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে ১ জন শিশু, ৩২ জন কিশোরী ও ৪১ জন নারীসহ মোট ৭৮ জন আত্মহত্যা করেছে।


অ্যাসিড নিক্ষেপে আক্রান্ত হয়েছে ২ জন নারী। এ মাসে ১ জন শিশু, ৪ জন কিশোরী ও ১ জন নারী অপহরণের শিকার হয়েছে। অপরদিকে ১ জন শিশু, ১০ জন কিশোরী ও ২ জন নারী নিখোঁজ রয়েছে। এ ছাড়াও মে মাসে ৯ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যুসহ মোট ৯১ জন শিশু, কিশোরী ও নারী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। যার মধ্যে ৩১ জন শিশু ও কিশোরী রয়েছে। এপ্রিল মাসে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল ৫৬ জন।

দেশে কর্মজীবী নারী ও শিক্ষার্থী বেড়েছে। কর্মস্থলে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসা-যাওয়ার পথে অধিকাংশেরই প্রধান ভরসা গণপরিবহন। কিন্তু এই গণপরিবহনও নিরাপদ নয় নারীদের জন্য। ২০২২ সালের প্রথম তিন মাস এবং বিগত তিন মাসে ঢাকার গণপরিবহনে নারীদের হয়রানির বিষয়ে একটি জরিপ চালায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আঁচল ফাউন্ডেশন। ওই বছরের জুন মাসে প্রকাশিত ‘ঢাকা শহরে গণপরিবহনে হয়রানি : কিশোরী এবং তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব’ শিরোনামের জরিপে দেখা যায়, রাজধানীতে গণপরিবহনে গত ৬ মাসে ৬৩ দশমিক ৪ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন। ১৩ থেকে ৩৫ বছর বয়সি ৮০৫ নারী অংশ নেন এই জরিপে। এর মধ্যে ৪৬ দশমিক ৫ শতাংশ নারী কোন না কোনো ভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ বুলিং, ১৫ দশমিক ২ শতাংশ সামাজিক বৈষম্য, ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ লিঙ্গবৈষম্য এবং ৮ দশমিক ২ শতাংশ বডি শেমিংয়ের মতো হয়রানির মুখোমুখি হয়েছেন। যৌন নিপীড়নের শিকার নারীদের ৭৫ শতাংশের ক্ষেত্রে অন্য যাত্রীদের মাধ্যমে ঘটেছে। 

২০ দশমিক ৪ শতাংশ হেলপার কর্তৃক, ৩ শতাংশ হকারের মাধ্যমে এবং ১ দশমিক ৬ শতাংশ ড্রাইভারের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।

নারী নির্যাতন রোধে ইতোমধ্যে সরকারের তরফ থেকে করা হয়েছে বেশ কয়েকটি আইন। সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু তবু কেন থামছে না এই নীল মহামারি। প্রশ্ন আছে, উত্তর নেই যেন।


মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম’-এর আওতায় ২০০০ সালে চালু হয়েছে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি)। এই প্রকল্পের অধীনে দেশের ১৪টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে শারীরিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন ও দগ্ধ (আগুন, অ্যাসিডসহ দাহ্য পদার্থ)Ñ এ তিন ধরনের সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ ছাড়াও ডিএনএ পরীক্ষা, পুলিশ ও আইনি সহায়তা, কাউন্সেলিং এবং পুনর্বাসন সেবাও দেওয়া হয়। এর বাইরে জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৬৭টি ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেল রয়েছে। এসব সেলে চিকিৎসা, ডিএনএ ও আইনি সহায়তা দেওয়া হয় সমন্বয়ের মাধ্যমে।

ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের সহায়তায় করা মামলাগুলোর সুরাহা এবং ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচারেও দেখা দিয়েছে দীর্ঘসূত্রতা। মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১৪টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে সহিংসতার শিকার ৫৬ হাজার নারী ও শিশু ভর্তি হন। এসব ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন এবং অ্যাসিড অপরাধ দমন আইনে ১৭ হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২ হাজার মামলার রায় হয়েছে এবং সাজা কার্যকর হয়েছে মাত্র ২২০টির। এ ছাড়াও ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৬৭টি সেলে ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৯৩ ভুক্তভোগী সেবা নিয়েছেন।

পরিসংখ্যান বলছে, নারীদের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়ন থেমে নেই। ভালো নেই নারীরা। সেটা ঘরে হোক বা ঘরের বাইরে। আর নারীদের সুরক্ষায় যেসব আইন আছেÑ বিচারের দীর্ঘসূত্রতা ও অন্যান্য কারণে তার সুফলও পাচ্ছে না তারা। এমন সমাজ কবে পাব আমরা- যেখানে পত্রিকার পাতায় একটি নারী নির্যাতনের খবরও প্রকাশিত হবে না। যেখানে নারীরা নারী হিসেবে নয়, বরং মানুষ হয়ে বাঁচবে। ঘরে বাইরে প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত নিরাপদ হোক নারীর জন্য। 


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা