আ ন ম আমিনুর রহমান
প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২৩ ১০:১৪ এএম
আপডেট : ০৯ জুলাই ২০২৩ ১৪:৪৮ পিএম
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিলে একঝাঁক উড়ন্ত রামঠেঙ্গি। ছবি : লেখক
সকাল সকাল বাইক্কা বিলে এসেও কুয়াশার কারণে ঠিকমতো পাখি দেখতে পারলাম না, ছবি তোলা তো দূরের কথা! কুয়াশার চাদর ভেদ করে ঠিক সাড়ে ১২টার দিকে সূর্যি মামা উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করল। আর ঠিক ১টার সময় পুরোপুরি সূর্য উঠল। চমৎকার আলো। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে প্রয়াত মিরাস ভাইকে নিয়ে কোশা নৌকায় করে বিলের দিকে ছুটলাম।
বিলের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে নানা প্রজাতির পাখি দেখতে দেখতে একসময় একপ্রান্তে চলে এলাম। আর হঠাৎই কালো লেজ জৌরালির বড় একটি ঝাঁক আমাদের সামনে থেকে উড়াল দিল। পুরো আকাশ যেন পাখিতে ছেয়ে গেল। দেখতে দারুণ লাগছিল। পাখিগুলো যেখান থেকে উড়াল দিল তার ঠিক পেছনে আরেকটি ছোট ঝাঁকে কতগুলো সাদা-কালো লম্বা পায়ের পাখির দেখা পেলাম। লাল লাল পা ও কালো চঞ্চুর পাখিগুলোকে অত্যন্ত সুন্দর লাগছিল। সেগুলো এবারই যে প্রথম দেখলাম তা নয়। পাখিগুলো প্রথম দেখি ২০০০ সালে মেলবোর্ন চিড়িয়াখানায়। তখনও অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছিলাম। সবশেষ দেখলাম ২০২০-এর ৯ মার্চ সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে।
লাল লম্বা পায়ের সাদাকালো পাখিগুলো এদেশের দুর্লভ পরিযায়ী পাখি অনিন্দ্য সুন্দর রামঠেঙ্গি। রণঠেঙ্গি, রাজ ঢেঙ্গা, লালপা ডেঙ্গা বা রণ-পা নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে বলে লাল ঠেঙ্গি বা লাল গোরি। ইংরেজি নাম Black-winged Stilt। বৈজ্ঞানিক নাম Himantopus himantopus। শীতে ওরা উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে এদেশে পরিযায়ী হয়ে আসে।
একনজরে রামঠেঙ্গি অত্যন্ত লম্বা ও ছিপছিপে পাখি। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দৈর্ঘ্য ৩৫-৪০ সেন্টিমিটার (সেমি), প্রসারিত ডানা ৬৮-৭১ সেমি ও ওজন ১৬৫-২০৫ গ্রাম। পুরুষের মাথার চাঁদি ও ঘাড় কালচে-ধূসর, প্রজননকালে যা পুরোপুরি সাদা হয়ে যায়। ডানা ও কাঁধ-ঢাকনির ওপরের অংশ কালো। পিঠ ধাতব কালো। দেহের নিচসহ বাদবাকি অংশ পুরোপুরি সাদা। স্ত্রী পুরুষের থেকে আকারে খানিকটা ছোটো হয় এবং ওর কাঁধ-ঢাকনি ও ডানা বাদামি। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে চঞ্চু সরু, সোজা, কালো ও লম্বা। চোখের রঙ লাল। লম্বা পা দুটো গাঢ় লাল। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির হলদে পাড়ের পিঠের পালক বাদামি এবং মাথার চাঁদি ও ঘাড়ের নিচে থাকে ধূসর আভা।
রামঠেঙ্গি হাওর, বিল, হ্রদ, বিভিন্ন ধরনের জলাশয়, লবণ চাষের জমি ইত্যাদিতে ছোটো বা মাঝারি দলে বিচরণ করে। এ ছাড়াও অন্যান্য খাদ্যসন্ধানী জলচর পাখির মিশ্র দলেও বিচরণ করতে দেখা যায়। অগভীর পানিতে ধীরে ধীরে হেঁটে লম্বা চঞ্চু দিয়ে পানি বা কাদা থেকে প্রিয় খাবার, যেমন- চিংড়ি, জলজ পোকামাকড় ও জলজ প্রাণী খায়। আকাশে ওড়ার সময় লম্বা পা দুটো দেহের পিছনে টেনে রাখে ও ‘কিপ-কিপ---’ বা ‘চেক-চেক-চেক---’ শব্দে ডাকে।
এপ্রিল থেকে আগস্ট প্রজনন মৌসুম। এ সময় ওরা নিজ আবাস এলাকার শুকনো মাটিতে ঘাস, লতাপাতা ও ক্ষুদ্র বস্তু দিয়ে স্তূপাকার বাসা বানায় ও তাতে ৩-৪টি জলপাই রঙের ডিম পাড়ে। বাসা বানানো, ডিমে তা দেওয়া ও ছানাদের লালনপালন স্ত্রী-পুরুষ মিলেমিশে করে। ডিম ফোটে ২২-২৬ দিনে। ছানারা খুব দ্রুত বাড়ে। প্রায় চার সপ্তাহে ছানারা উড়তে শেখে ও বাসা ছাড়ে এবং দেড় থেকে দুই মাস বয়সে স্বাবলম্বী হয়। আর ১-২ বছর বয়সে প্রজননক্ষম হয়। আয়ুষ্কাল ৭-৮ বছর।