আ ন ম আমিনুর রহমান
প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৩ ০৯:০২ এএম
আপডেট : ২০ আগস্ট ২০২৩ ১০:০৬ এএম
কানাডার গুয়েলপ শহরের ‘কোর্টরাইট ওয়াটারফাউল পার্ক’-এ স্বর্ণলোচন হাঁসি। ছবি- লেখক
কানাডার ওন্টারিও প্রদেশের গুয়েলপ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণকালীন সুদর্শন পাখিগুলোকে প্রথম দেখি ‘কোর্টরাইট ওয়াটারফাউল পার্ক’-এ ১৯৯৮ সালের জুলাইয়ে। ১৯৯৮ সালে কানাডার গুয়েলপ সিটিতে অবস্থানকালীন আমার অবসর কাটানোর সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ওয়াটারফাউল (হাঁস-রাজহাঁস-মরাল) পার্কÑ ‘কোর্টরাইট ওয়াটারফাউল পার্ক’।
পার্কটিতে খুব বেশি মানুষ যেত না। আসলে গুয়েলপের অনেকেই জানত না ওদের সিটিতে এমন একটি সুন্দর হাঁসের পার্ক রয়েছে। এই পার্কেই বিশ্বের কমবেশি ৯০ প্রজাতির হাঁস-রাজহাঁস-মরালের দেখা পেয়েছি। জুলাইয়ের এক দুপুরে ক্যামেরা হাতে যখন পার্কে ঘুরছিলাম, তখন হঠাৎই সোনালি চোখের সুদর্শন হাঁসটিকে পানিতে ভেসে বেড়াতে দেখলাম। হাঁসটি বারবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। আমার পুরোনো Nikon MF2 ফিল্ম ক্যামেরার ৭০-৩০০ মিলিমিটার লেন্সে ওর বেশ ক’টি ছবি তুললাম, যার মধ্যে মাত্র একটি ছবি চলনসই হলো। যদিও এদেশে পাখিটিকে কখনও দেখিনি হাকালুকি বা টাঙ্গুয়ার হাওরে অথবা অন্য কোনো জলাশয়-বিলে; কিন্তু অনেকদিন পর অ্যালবামে ছবিটি দেখে ওকে প্রথমবার দেখার স্মৃতিময় মুহূর্তটির ছবি মনের পটে ভেসে উঠল।
কোর্টরাইট ওয়াটারফাউল পার্কের সেই সোনালিচোখ হাঁসটি এদেশের অনিয়মিত ও তথ্য অপ্রতুল পাখি। এর কোনো প্রচলিত বাংলা নাম না থাকায় অনুবাদ করে যদিও সোনালিচোখ হাঁস বলা যায়; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত স্বর্ণলোচন নামটি বেশ মনে ধরল। এদেশের অতি বিরল ও তথ্য অপ্রতুল ভবঘুরে হাঁসটির ইংরেজি নাম Common Goldeneye বা Golden-eye Duck। অ্যানাটিডি গোত্রের হাঁসটির বৈজ্ঞানিক নাম Bucephala clangula বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ ষাঁড়ের মাথা। বিশ শতকের গোড়ার দিকে (১৯১৩-১৯১৪) সিলেট বিভাগের হাওরে একবার হাঁসটিকে দেখার তথ্য রয়েছে। পাখিটির মূল আবাস কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরাঞ্চল, স্ক্যান্ডিনেভিয়া (ডেনমার্ক, নরওয়ে ও সুইডেন), বাল্টিক অঞ্চল (এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুনিয়া) ও রাশিয়ার উত্তরাঞ্চল।
স্বর্ণলোচন ত্রিকোনাকৃতির মাথা ও ঢালু চঞ্চুর মাঝারি আকারের সামুদ্রিক হাঁস। হাঁসার দেহের দৈর্ঘ্য ৪০ থেকে ৫১ সেন্টিমিটার, ওজন প্রায় এক কেজি। অন্যদিকে হাঁসির দৈর্ঘ্য ৪০ থেকে ৫০ সেমি ও ওজন প্রায় ৮০০ গ্রাম। হাঁসা-হাঁসি নির্বিশেষে প্রসারিত ডানা ৭৭ থেকে ৮৩ সেমি। হাঁসা ও হাঁসির পালকের রঙে বেশ পার্থক্য থাকে। প্রজননকাল বাদে অন্য সময় হাঁসার দেহের রঙ কালচে, মাথা চকলেট-বাদামি, ডানায় থাকে সাদা পট্টি ও লেজ কালচে-ধূসর। কিন্তু প্রজননকালে হাঁসার দেহে যেন রঙ খোলে! এ সময় মাথা হয় কালচে-ধূসর; যাতে থাকে সবুজাভ আভা। গালে থাকে ডিম্বাকার সাদা পট্টি। ঘাড়, পিঠ ও লেজ হয় কালো এবং ডানা হয় সাদা-কালো বা পাকরা। দেহতল, ডানার মধ্য পালক, বুক, দেহের দু-পাশ ও পেট হয় সাদা। চঞ্চু কালো, চোখ সোনালি এবং পা ও পায়ের পাতা হলুদ বা সোনালি। অন্যদিকে হাঁসির দেহ ধূসর, মাথা বাদামি ও চোখ ফ্যাকাশে। চঞ্চু, পা ও পায়ের পাতা হলদে-বাদামি।
স্বর্ণলোচন উপসাগর, নদী, হ্রদ, লেগুন ও পোতাশ্রয়ে বিচরণ সচরাচর ছোট ঝাঁকে বিচরণ করে। খাটো ও সুচালো ডানা ঝাপটে দ্রুতগতিতে উড়ে যায়; ওড়ার সময় ডানা থেকে শিসের মতো শব্দ হয়। অগভীর পানিতে সাঁতার কেটে ধীরগতিতে মাছের ডিম, শামুক, চিংড়িজাতীয় প্রাণী, জলজ কীটপতঙ্গ, জলজ উদ্ভিদ ইত্যাদি খায়। প্রজনন মৌসুমে উঁচু স্বরে কর্কশ কণ্ঠে ‘স্পির-স্পির---’ বা ‘কুয়েহ-কুয়েহ---’ শব্দে ডাকে।
ডিসেম্বর থেকে মে প্রজননকাল। এ সময় আবাস এলাকা অর্থাৎ উত্তর আমেরিকা, স্ক্যান্ডিনেভিয়া, বাল্টিক অঞ্চল ও সাইবেরিয়ায় গাছের প্রাকৃতিক গর্তে দেহের কোমল পালক বিছিয়ে হাঁসি বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ৪ থেকে ১৩টি; রঙ চকচকে সবুজ। স্ত্রী একাই ডিমে তা দেয় ও ডিম ফোটে ১৮ থেকে ৩২ দিনে। ছানারা ৫৬ থেকে ৬৫ দিনে উড়তে শেখে। আয়ুষ্কাল ১১ থেকে ১২ বছর।