মির্জা সোহেল
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৩ ১৪:৩০ পিএম
আপডেট : ২১ আগস্ট ২০২৩ ১৭:৪৪ পিএম
নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্থাপত্য দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কাকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। আজ থাকছে শ্রীলঙ্কার উল্লেখযোগ্য কিছু ভ্রমণ গন্তব্যের তথ্য নিয়ে আয়োজন। লিখেছেন মির্জা সোহেল
দীর্ঘদিনের ইচ্ছা দশানন রাবণ রাজার দেশে যাওয়ার। যাই বললেই তো যাওয়া যায় না। তবু কীভাবে যেন উপমহাদেশের দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় যাওয়াটা হুট করেই। দেশটা খুবই নিরিবিলি ও পরিচ্ছন্ন। আমাদের দলে রয়েছেন পাঁচজন। বিমানবন্দরের আনুষঙ্গিক কাজকর্ম সেরে বিমানে আরোহণ। ঠিক সময়েই বিমান ছাড়ল, রাতের অন্ধকার চিরে সাগর পেরিয়ে কলম্বোর বন্দরনায়েকে বিমানবন্দরে পৌঁছালাম ঠিক ভোর ৫টায়। মালপত্র নিয়ে বেরোতে আরও ঘণ্টাখানেক। তারপর ভ্রমণ সংস্থা নিয়োজিত গাইডের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা গেল। শুধু গাইড নয়, ড্রাইভার কাম গাইড।
কলম্বোর রাস্তাঘাট বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, খানাখন্দ-গর্ত একেবারে নেই।কলম্বোতে ঘোরাঘুরি শুরু করার আগে তার ইতিহাস একটু জেনে রাখা ভালো। পঞ্চম শতাব্দী থেকে এশিয়া ও পশ্চিম দেশগুলোর জলপথে ব্যবসায় সিংহল ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। অষ্টম শতাব্দীর গোড়ায় আরব ব্যবসায়ীরা বন্দরের কাছাকাছি বসতি স্থাপন করে প্রাধান্য বিস্তার করতে শুরু করলেন। পর্তুগিজদের আবির্ভাব সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এলাকার কর্তৃত্ব চলে আসে ওলন্দাজদের হাতে। তারা এখানে দারুচিনি চাষে নিয়োজিত করে স্থানীয় মানুষদের। তবে এলাকাটি শহর হিসেবে পরিগণিত হতে শুরু হয় ব্রিটিশদের আগমনের পর থেকে।
সিংহলের নতুন নাম হয় শ্রীলঙ্কা। অতীতে সিংহল চারটি সাম্রাজ্যে বিভক্ত ছিল। দশম খ্রিস্টাব্দে রাজা পরাক্রমবাহু চারটি সাম্রাজ্যকে একত্রিত করে অখণ্ড রাষ্ট্রে পরিণত করেনÑ নাম হয় সিংহল। সিং অর্থে দেশ আর হাল অর্থে চার। ‘শ্রী’ একটি সিংহলি শব্দ যার অর্থ সম্পদ, সৌন্দর্য, সাফল্য।
শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলিম, হিন্দু সব ধর্মের মানুষের সহাবস্থান। প্রথমে গেলাম সেন্ট অ্যান্টনিস চার্চে। বাইরে থেকে একটি সাধারণ পর্তুগিজ ক্যাথলিক চার্চের মতো দেখতে যদিও অন্দরের ব্যবস্থাপনায় ইউরোপীয় রীতির তুলনায় এই উপমহাদেশীয় ধাঁচই বেশি। সামনেই সেন্ট অ্যান্টনির মূর্তি। এই চার্চ নাকি খুবই জাগ্রতÑ নানা ধর্মের মানুষ, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা নিবেদন করতে এই চার্চে উপস্থিত হন, তাদের প্রার্থনা পূরণও হয়েছে বলে শোনা যায়।
শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় চার্চ হলো সেন্ট লুসিয়া ক্যাথিড্রাল। যে বৌদ্ধ মন্দির কলম্বো সফরকারীর তালিকায় সব সময় স্থান পায় তা হলো গঙ্গারামায়া বৌদ্ধ মন্দির। শহরের মধ্যেই ১০০ বছরের প্রাচীন এই বৌদ্ধ মন্দির। এই বৌদ্ধ মন্দিরে প্রাচীন স্থাপত্যরীতির মিল খুঁজে পাওয়া ভার। আধুনিক রীতিতে নির্মিত এই মন্দিরে শ্রীলঙ্কার স্থাপত্য রীতির সঙ্গে চীন, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার ও অন্যান্য বিভিন্ন দেশের স্থাপত্য রীতির মিশ্রণ হয়েছে। প্রবেশ মূল্যও কম নয়, শ্রীলঙ্কা টাকায় ৩০০ রুপি। এই মন্দির পরিচালনা করেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরাই। এই মন্দিরে অন্তর্গত রয়েছে লাইব্রেরি।
মিউজিয়াম আর অসাধারণ কিছু দামি পাথর ও সোনা-রুপার তৈরি উপহারসামগ্রী; যা উপহার দিয়েছেন নানা দেশের ভক্তবৃন্দ ও শুভানুধ্যায়ীরা। নবম পোয়াতে (পূর্ণিমায়) ফেব্রুয়ারি মাসে এখানে উৎসব হয়। বিশাল ঐতিহ্যমণ্ডিত বর্ণময় মিছিলের পথেই পড়ে এই বৌদ্ধ মন্দির। কলম্বোর টাউন হল এক ঐতিহাসিক স্থাপত্য। টাউন হলের ঠিক বিপরীতে রাস্তার ওপারেই বিহারামহাদেবী পার্ক। কলম্বোর সবচেয়ে বড় পার্ক এটাই।
এই পার্কের নাম ছিল রানি ভিক্টোরিয়ার নামানুসারে ভিক্টোরিয়া পার্ক। বর্তমানে রানি বিহারাম দেবীর (রাজা দুষ্টুগেমুনু) নামে পার্কটির নামকরণ হয়েছে। এ ছাড়াও আরও যেসব উল্লেখযোগ্য স্থান ঘুরে এলাম তার কিছু সংক্ষিপ্ত তথ্য তুলে ধরা হলো-
সিগিরিয়া
সিগিরিয়া হচ্ছে শ্রীলংকার একটি অপূর্ব সুন্দর গুহামন্দির। ছয়শত ফুট উঁচু এক পাথর কেটে দুর্ভেদ্য প্রাসাদ বানিয়েছেন এক রাজা। প্রাসাদ অনেকটা মৌচাকের চাকের মতো। এই পাথর 'সিগিরিয়া রক' নামে ভুবন বিখ্যাত। সিগিরিয়া রকের আরেক নাম 'লায়ন রক'। এটি বৌদ্ধমন্দির হিসেবে চৌদ্দ শতক পর্যন্ত ব্যবহৃত হতো। সিগিরিয়া দুর্গের পাথরের প্রবেশপথটি একটি বিশাল সিংহমূর্তির মতো। সিংহমূর্তির অনেকখানি এখনো টিকে আছে। প্রাগৈতিহাসিক এই গুহাটি খ্রীস্টপুর্ব ৫০০ শতাব্দী থেকেই সাধু সন্যাসীদের আশ্রম হিসেবে ব্যবহৃত হত। শোনা যায় দক্ষিণ ভারতীয় রাজা কাশ্যপ কোন যুদ্ধে পড়াজিত হয়ে ৪৯৫ খ্রীস্টাব্দ নাগাদ এই স্থানে আশ্রয় নেন এবং সুরক্ষিত একটি দুর্গ গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে এটি বৌদ্ধদের মঠে পরিণত হয়। বর্তমানে এটি শ্রীলংকার একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র এবং বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।
অ্যাডামস পিক
চা-বাগানের রাস্তা ধরে হিম হিম ঠান্ডায় হাঁটছি। গুগল ম্যাপ বলছে, হাঁটতে হবে ২০ মিনিটের মতো। তেমন কোনো উঁচু-নিচু ছাড়াই প্রথম ১০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম অ্যাডামস পিকের নিচে। এরপর সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠলেই সোজা চূড়ায়। ধীরে ধীরে এগোলাম। আমাদের মতো আশপাশে অনেকেই এসেছেন সুন্দর এই সকালটা উপভোগ করতে।
ইয়ালা সাফারি
এখানে অরণ্য গভীর সখ্যতায় ভারত মহাসাগরের ধূসর নীল জলকে ছুঁয়ে থাকে। সমুদ্রের সফেন ঢেউ রোজ ভিজিয়ে দিয়ে যায় মাটির ওপর জেগে থাকা ম্যানগ্রোভের শ্বাসমূল। শেষ বিকালের নরম আলোয় যখন গোটা চরাচর হয়ে ওঠে ভারী মায়াময়, তখন হয়তো কোনোদিন পথ ভুলে দলছুট হাতি পৌঁছে যায় সমুদ্রের কিনারে অথবা গভীর রাতে নিঃশব্দে রাজকীয় ভঙ্গিতে হেঁটে চলে যায় লেপার্ড– ঢেউভাঙা বালুর তটে পড়ে থাকে তার পায়ের ছাপ। এই বৈচিত্র্য ভরা অরণ্য প্রকৃতির পোশাকি নাম ‘ইয়ালা ন্যাশনাল পার্ক’। শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলঘেঁষে প্রায় হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে আছে এই অরণ্য। অবস্থানগত কারণে ইয়ালায় বর্ষা আসে শীতকালে। শিশিরঝরা হেমন্তের শেষে, উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বাতাসের হাত ধরে বৃষ্টি নামে ইয়ালায়। প্রায় ৪৪টি প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ২১৫ প্রজাতির পাখি এবং অসংখ্য সরীসৃপের বসবাস এই অরণ্যে। জঙ্গল সাফারির পথে তাদের অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়ে যায়। আর যদি ভাগ্য সত্যিই প্রসন্ন থাকে, তবে দেখা মেলে ইয়ালার রাজা লেপার্ডের।
বেনটোটা
শ্রীলঙ্কার দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত বেনটোটা শহর সমুদ্রসৈকতের জন্য বিখ্যাত। ভারত মহাসমুদ্রবেষ্টিত শহর হিসেবে শহরটিতে অনেকগুলো রিসোর্ট রয়েছে। এখানে সার্ফিংসহ রয়েছে বিনোদনের নানা ব্যবস্থা। সপ্তদশ শতকে নির্মিত সুরক্ষিত দুর্গ ও মধ্যযুগে নির্মিত বৌদ্ধ মন্দির এখানকার প্রধান আকর্ষণ। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে ছুটে আসে।
পিনাওয়ালা এলিফ্যান্ট অরফানেজ
‘পিনাওয়ালা এলিফ্যান্ট অরফানেজ’ আমাকে মুগ্ধ করেছে। এটা মূলত হাতির আশ্রম; সেখানে প্রবেশ করতে এক হাজার রুপি দিতে হয় জনপ্রতি। এ যেন হাতিদের জন্য এক জলসাঘর। এক পাল হাতি জলে আর পাথুরে ডাঙ্গায় নানা রকম অদ্ভুত কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকে। শ্রীলঙ্কায় এলে অসাধারণ সুন্দর স্থানটিতে আসতে ভুলবেন না। এখানে এলে হাতির প্রতি শুধু ভালোবাসা জন্মাবে না, জায়গাটার প্রেমেও পড়বেন নিশ্চিত।
নুওয়ারা ইলিয়া
এ শহর চায়ের জন্য বিখ্যাত। শ্রীলঙ্কার সব বয়সের মানুষ এখানে উৎপন্ন চা পান করেন। বলা হয়, শহরটি শ্রীলঙ্কার চায়ের রাজধানী। পাহাড়ি শহরটি উনবিংশ শতাব্দীতে গড়ে ওঠে। একে লিটল ইংল্যান্ড বা ছোট ইংল্যান্ড হিসেবে অভিহিত করা হয়।
অনুরাধাপুর
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে অনুরাধাপুর পবিত্র স্থান। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে এটি নির্মিত হয়। এখানে গৌতম বুদ্ধের ডুমুরগাছ রয়েছে। এ ছাড়া ১৩০০ বছরের প্রাচীন অভিজাত ভবন, মন্দির ও মনুমেন্ট রয়েছে। দশম শতাব্দীতে ধ্বংস হয়ে যায় এটি। কিন্তু ইউরোপীয়রা পুনরায় এটি আবিষ্কার করেন এবং তখন থেকে এটি শ্রীলঙ্কার উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানে রূপান্তর হয়।
মিরিসা
মিরিসা শহরে যেদিকে তাকানো যায় সেদিকে নারকেলগাছ রয়েছে। একে ভূস্বর্গ হিসেবে অভিহিত করে স্থানীয় বাসিন্দারা। শহরটির সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থান নয়নাভিরাম সমুদ্রসৈকত। শ্রীলঙ্কার দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত এই শহর।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
শ্রীলঙ্কার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আবহাওয়া বেশ চমৎকার। চারদিকে সমুদ্র থাকার কারণে এর আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। এখানে অক্টোবর এবং নভেম্বরে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয়। তাই পর্যটকদের এই সময়টা এড়িয়ে চলাই ভালো। শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করার জন্য বছরের সবচেয়ে ভালো সময় হলো ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস।উপমহাদেশের দ্বীপরাষ্ট্রটিতে যেতে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা বাধ্যতামূলক নয়। শ্রীলঙ্কা গিয়েই অন-অ্যারাইভাল ভিসা নেওয়া যায়। তবে ঢাকাস্থ শ্রীলঙ্কা দূতাবাসে গিয়ে আগে থেকেই ভিসা সংগ্রহ করে নেওয়া ভালো। কারণ কলম্বো বিমানবন্দরে গিয়ে ভিসা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলা যায় না। ঢাকা থেকে কলম্বোর সরাসরি ফ্লাইট আছে। শ্রীলঙ্কায় ৪০ থেকে ৬০ ডলারের মধ্যে ভালো হোটেল পাওয়া যাবে সব জায়গায়। শ্রীলঙ্কা ভ্রমণের জনপ্রিয় মাধ্যম হলো রেন্টাল কার। যে গাড়ি ভাড়া করবেন, সে ড্রাইভারই আপনার ট্যুর গাইড। তবে ব্যাকপ্যাকাররা বাস ও ট্রেনেও শ্রীলঙ্কা ঘুরতে পারেন।