কালো মানুষের আলো
রাতুল মুন্সী
প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১১:৩৯ এএম
আপডেট : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১১:৪১ এএম
মেরি এলিজা মাহোনি
গায়ের রঙ কালো বলে শ্বেতাঙ্গদের সমাজে তারা একটা সময় পর্যন্ত ব্রাত্য ছিলেন। প্রাণপ্রাচুর্য ও ইচ্ছাশক্তিতে বলিয়ান এ মানুষগুলো নিজেদের কাজের মাধ্যমে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন। তেমনই একজন মেরি এলিজা মাহোনি...
মার্কিন গৃহযুদ্ধ যখন শুরু হয়েছিল, তখন মেরি এলিজা মাহোনির বয়স ১৬ বছর। দুই পক্ষের বহু হতাহতের কারণে চিকিৎসাসেবার প্রতি তার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। তখন থেকেই চেয়েছিলেন বড় হয়ে নার্স হবেন, মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবেন।
নিজ চেষ্টা, অধ্যবসায় আর পরিশ্রমে তিনি হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পেশাদার কৃষ্ণাঙ্গ নার্স। ১৮৭৯ সালে প্রথম আফ্রিকান হিসেবে মার্কিন স্কুল অব নার্সিং থেকে স্নাতক ডিগ্রিও অর্জন করেন তিনি। একই সঙ্গে চিকিৎসাসেবায় কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের বৈষম্য দূরীকরণ এবং গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব কালারড গ্র্যাজুয়েট নার্স নামে একটি সংগঠনও গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৫১ সালে মার্কিন নার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার মাধ্যমে সংগঠনটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
মেরি এলিজা মাহোনির জন্ম ১৮৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ডোরচেস্টার ম্যাসাচুসেটসে। মাহোনির বাবা-মা দুজনই একটা সময় পর্যন্ত ছিলেন ক্রীতদাস। দাসপ্রথা বিলোপের পর স্বাধীন হয়ে পূর্ব-উত্তর ক্যারোলিনা থেকে গৃহযুদ্ধের বেশ আগেই দেশটির উত্তরাঞ্চলে চলে এসেছিলেন।
মাহোনি ছিলেন পরিবারের বড় সন্তান। শৈশবে তার এক ভাই ও বোন মারা যায়। অল্প বয়স থেকেই তিনি ছিলেন বেশ ধর্মপ্রাণ এবং যোগ দিয়েছিলেন রক্সবারি পিপলস ব্যাপটিস্ট চার্চেও। ১০ বছর বয়সে মাহোনি ফিলিপস স্কুলে ভর্তি হন। এ স্কুল বোস্টনের শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গদের সমন্বিত প্রথম কয়েকটি স্কুলের মধ্যে একটি। এখানে তিনি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন।
ফিলিপস স্কুলের পাঠ্যক্রমে ইংরেজি, ইতিহাস ও গণিতের মতো সাধারণ বিষয়গুলোর পাশাপাশি নৈতিকতা ও মানবতা অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর সেই মূল্যবোধের জায়গা থেকে মানবসেবা ও নার্সিং বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে তিনি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধও প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
সে সময় কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের লাইসেন্সপ্রাপ্ত নার্স হিসেবে আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ এবং কর্মজীবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে অনেক বাধা ছিল। মাহোনি ১৮৭৮ সালে ২৯ জন ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে নিউ ইংল্যান্ড হসপিটাল ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেনে (বর্তমান ডিমক কমিউনিটি হেলথ সেন্টার) ১৬ মাসের একটি কোর্সে ভর্তি হন।
৪০ জনের মধ্যে মাহোনি এবং দুজন শ্বেতাঙ্গ মহিলাই শুধু প্রোগ্রামটি সম্পূর্ণ করতে পারেন এবং ডিগ্রি লাভ করেন। ধারণা করা হয়, বয়সের মাপকাঠি পূরণ না হওয়া সত্ত্বেও প্রশাসন মাহোনিকে গ্রহণ করে, কারণ মাহোনির যখন ১৮ বছর বয়স তখন থেকেই তিনি সেখানে বাবুর্চি, পরিচারিকা ও ধোপা হিসেবে কাজ করেছিলেন। মাহোনি সেখানে প্রায় ১৫ বছর প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা কাজ করেছেন।
ডিপ্লোমা প্রাপ্তির পর তিনি প্রাইভেট কেয়ার নার্স হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিন্তু তখনকার শ্বেতাঙ্গ ও ধনী পরিবারে কৃষ্ণাঙ্গ নার্সদের সঙ্গে গৃহকর্মীর মতো আচরণ করত। তাতেও দমে যাননি মাহোনি। সেবার মানসিকতা এবং কর্মদক্ষতা দিয়ে তিনি অল্প দিনেই বেশ পরিচিতি লাভ করেন। তার এ খ্যাতি পেশাদার নারী নার্স তথা কৃষ্ণাঙ্গ নার্সদের প্রতি সমাজের মানসিকতা পরিবর্তনে ও তাদের মর্যাদা বাড়াতে সাহায্য করেছিল।
মাহোনির লক্ষ্য ছিল তার মতো গায়ের রঙের সংখ্যালঘু নার্সদের বিষয়ে রোগী এবং সমাজের চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করা। তিনি বিশ্বাস করতেন, জাতিগত বৈষম্য ছাড়াই সব মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ থাকা উচিত।
সুবিধাবঞ্চিত কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের নিয়ে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান হাওয়ার্ড কালারড অরফান অ্যাসাইলামের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন প্রায় দুই বছর। এখান থেকেই তিনি তার দীর্ঘ কর্মজীবনের ইতি টেনেছিলেন।
অবসরগ্রহণের পর কৃষ্ণাঙ্গ তথা সমাজের সব স্তরের নারীর সমতা ও ভোটাধিকার নিয়ে কাজ করেন। ১৯২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের ভোটাধিকার অর্জিত হলে বোস্টনের প্রথম মহিলা হিসেবে নিবন্ধন করেছিলেন।
১৯২৩ সালে মাহোনি ক্যানসারে আক্রান্ত হন। তিন বছর ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে ৮০ বছর বয়সে ১৯২৬ সালে ৪ জানুয়ারি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।