বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস
সীমান্ত দীপু
প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০২৩ ১৩:১০ পিএম
আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০২৩ ১৯:২১ পিএম
হাকালুকি হাওরে দীর্ঘ ভ্রমণকারী উত্তুরে ল্যাঞ্জা হাঁস ছবি : লেখক
হাজার মাইল দূর থেকে প্রতিবছর খাবার ও প্রজননের তাগিদে আমাদের দেশে আসে লাখো পরিযায়ী পাখি। এই তালিকায় আছে বিপন্ন কিছু প্রজাতি। কিন্তু আমাদের কর্মকাণ্ডে দিন দিন ছোট হয়ে আসছে এই পাখিদের দুনিয়া। আজ বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস। দিনটি উপলক্ষে পরিযায়ী পাখি নিয়ে বিশেষ লেখা...
রাশিয়ার উত্তর দিকের তুন্দ্রা অঞ্চলের একটি প্রত্যন্ত এলাকার নাম কামচাটকা। এ এলাকায় পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন একটি পাখির বসবাস। নাম চামুচঠুঁটো বাটান। এখানেই তারা প্রজননকাল কাটায়। বলা যায়, এ এলাকাটিই পাখিটির পৃথিবীর বুকে শেষ আশ্রয়স্থল। প্রজননকাল শেষ হলে তারা পরিযায়ন করে হাজার হাজার মাইল। মাত্র ৩০ গ্রাম ওজনের এ পাখিটিকে প্রতি শীতেই দেখা যায় বাংলাদেশের সোনাদিয়া দ্বীপে। কামচাটকা থেকে সোনাদিয়ার দূরুত্ব প্রায় ৮ হাজার মাইল। পৃথিবীতে এ প্রজাতির পাখি টিকে আছে এখন মাত্র ২০০ জোড়া। প্রতি বছরই তাদের সংখ্যা কমছে।
১৯৮৯ সালের কথা। ভোলার মৌলভীচরে পাখিশুমারির সময় এই চামুচঠুঁটো বাটানকে একসঙ্গে দেখা গেল প্রায় ২০২টি। এখন ভাবতেই অবাক লাগে! আর গত বছরের পাখিশুমারিতে পুরো উপকূলে কোনো চামুচঠুঁটো বাটান দেখা যায়নি। শুধু সোনাদিয়ায় দেখা গেছে মাত্র তিনটি। চামুচঠুঁটো বাটানের মতো এই একটি পাখির বিচরণস্থল দেখেই বোঝা যায় উপকূলে পাখিদের অবস্থা কতটা দুর্বিষহ।
সৈকত পাখির পরিবারে প্রায় ৬০ প্রজাতির পাখি এ দেশের উপকূলে দেখা যায়। পাখিবৈচিত্র্যের এত সুন্দর উপকূল পৃথিবীর খুব কম প্রান্তেই আছে। এ সৈকত পাখিগুলো মূলত কাদাচরের পাখি। মেঘনার কোলজুড়ে ভেসে ওঠা চর অথবা সাগরের বুকে ভেসে ওঠা দ্বীপগুলোয় জোয়ারের সময় এরা পোকাকাকড়, শ্যাওলা আর ছোট মাছ খেয়ে বেঁচে থাকে। প্রাকৃতিক চর ছাড়া এ পাখিগুলোর টিকে থাকা একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু আমাদের উপকূলজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে সবুজ বেষ্টনী। জলবায়ুর প্রভাব থেকে মানুষকে রক্ষা অথবা ঝড়ের কবল থেকে বাঁচাতে উপকূলের সবুজ বেষ্টনী বড় ভূমিকা রাখছে। মানুষ আর উপকূল বাঁচাতে আমরা সৈকত পাখির ভূমিটুকু কেড়ে নিয়েছি। তাদের টিকে থাকার জন্য কাদাচরগুলো কমে যাচ্ছে। কাদাচর হয়ে যাচ্ছে বড় বড় বাদাবন।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে পর্তুগালে একটি পরিযায়ী হাঁসপাখির সম্মেলনে জর্জিয়ান এক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। তার গবেষণার বিষয় ছিল আইডার পরিবারের একটি পাখি। এ পাখিটিও পরিযায়ী। প্রজনন করে জর্জিয়ায়, তার গ্রামে। দুই যুগ আগেও গ্রামে শত শত পাখি বাসা করে বাচ্চা ফোটাত। এখন পাখিটি ডিম পাড়লেই শিকারিরা তাদের ধরার চেষ্টা করে। পাখি ধরতে না পারলেও তাদের ডিম নিয়ে গিয়ে ভেজে খায়। এখন পৃথিবীতে পাখিটির প্রজননের শেষ এলাকা হলো এই গ্রামটি। মাত্র কয়েক জোড়া পাখি এখন ডিম পাড়তে আসে। আর তার প্রজনন এলাকার সুরক্ষা দেওয়াই আমার ওই বন্ধুটির বড় কাজ।
জর্জিয়ার সেই আইডারের মতো পরিযায়ী কোনো হাঁসপাখি এ দেশে প্রজনন করে না। তবে ৩০-এর অধিক প্রজাতির লাখ লাখ হাঁসপাখি এ দেশে শীতে আসে খাবারের খোঁজে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বিরল এক হাঁস প্রজাতির নাম বেয়ারের ভূতিহাঁস। পৃথিবীজুড়ে এর সংখ্যা ২০০ জোড়ার কম। প্রতি বছর হাওর এলাকায় কয়েকটি দেখা যায়। নব্বইরের দশকে এর সংখ্যা ছিল কয়েক জোড়া। পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ১০০ হাঁসপাখির পিঠে স্যাটেলাইট যন্ত্র বসিয়েছি তাদের পরিযায়ন পথ দেখতে। দূরপথযাত্রী এসব অসাধারণ ভ্রমণকারী হাঁস যখন হাতে নিয়ে দেখি তখন আনন্দে মনটা ভরে যায়। তাদের বুকের ধুকধুক আওয়াজ দেখলে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিই। গবেষণা কাজ শেষ হলে পাখিগুলো ছেড়ে দেওয়ার সময় তাদের উড়ে যাওয়ার আনন্দ দেখতেও কেন যেন খুব শান্তি লাগে।
উত্তুরে ল্যাঞ্জা হাঁস নামে একটি বড় পরিযায়ী হাঁসে গত বছর স্যাটেলাইট যন্ত্র বসিয়ে দিলাম। এটিও দীর্ঘ ভ্রমণকারী হাঁস হিসেবে বেশ পরিচিত। বাংলাদেশে আসা উত্তুরে ল্যাঞ্জা হাঁসটি আসলে প্রজননকাল কাটাতে কোথায় যায় তা জানার আগ্রহ থেকেই এ গবেষণা কাজটুকু করা। প্রায় এক বছর ধরে তার গতিবিধি পরিবীক্ষণ করলাম। কি অসাধারণ তার যাত্রাপথ। চীনের কুইনহো অঞ্চলের শেষভাগ আর উত্তর মঙ্গোলিয়ার শুরুর দিকে একটি অঞ্চলে পাখিটি সংসার সাজায়। খুবই বিরল এ তথ্য পেয়ে দারুণ উল্লসিত হলাম। আগে জানা ছিল আমাদের পরিযায়ী হাঁসগুলো সাইবেরিয়া বা রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে যায় প্রজননকাল কাটাতে। এ ধারণা সঠিক নয়। আমাদের বেশিরভাগ হাঁসপাখিই প্রজনন করে চীন, মঙ্গোলিয়া আর তিব্বতের বিভিন্ন অঞ্চলে।
আমাদের দেশে আসা প্রায় ৮০ ভাগ হাঁসপাখিই শীতে দেখা যায় হাওরাঞ্চলে। দিন দিন প্রাকৃতিক হাওর এলাকা কমছে। হাওরের বিলগুলোয় ধান চাষ হচ্ছে, কৃত্রিম উপায়ে মাছ চাষ হচ্ছে। মাছ আর ধান চাষে বিলগুলো হারাচ্ছে তার প্রাকৃতিক রূপ। পরিযায়ী হাঁসের বসবাসের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। হাওর এলাকায় তাদের জায়গা কমতে কমতে এখন টাঙ্গুয়া, হাকালুকি আর হাইল হাওরে এসে পৌঁছেছে। তবুও সেখানে অত্যাচারের যেন শেষ নেই।
সৈকত আর হাঁস পাখিই শুধু পরিযায়ী নয়; এ দেশে আসা পরিযায়ীর মধ্যে একটি বড় অংশ ঘাসপাখি। ঘাস বা নলবনে এক প্রজাতির পাখি এসেছে পরিযায়ী হয়ে। আমাদের মিঠাপানির নদীগুলোর চরজুড়ে বড় বড় ঘাসবন দেখা যায়। হাওরেও বেশ ভালো নলবন টিকে আছে। তবে সাম্প্রতিককালে এ ঘাসবনগুলো গোচারণভূমি হয়ে উঠেছে। শীতের শুরুতে জেগে ওঠা নলবনগুলো শীত শেষে মানুষ আর গরুর অত্যাচারে প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়। ফলে ঘাসবনে খাবারের খোঁজে আসা পরিযায়ীরাও হরিয়ে যেতে বসেছে।
শিকারি পাখিরও একটি বড় অংশ এ দেশে আসে পরিযায়ী হয়ে। এর মধ্যে ঈগল, শাহিন, বাজই বেশি। প্রজাতির সংখ্যা হবে ৫০-এর অধিক। এর মধ্যে পালাসের কুড়া ঈগলের কথা না বললেই নয়। পাখিটি এ দেশে শীতে মঙ্গোলিয়া থেকে আসে হাওর এলাকায় প্রজননকাল কাটাতে। সম্প্রতি পাখিটি বিপন্ন পাখির তালিকায় স্থান পেয়েছে। হাওর এলাকায় তাদের বাসা করার গাছের বড়ই অভাব। অনেক পাখি মারা পড়ছে বিদ্যুতের তারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে। শুধু কুড়া ঈগলই নয়, এ দেশে বেশিরভাগ শিকারি পাখির সংখ্যাই দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।
পরিযায়ী পাখির আবাস প্রতিনিয়ত কমছে। পরিযায়ীদের দুনিয়া আসলেই ছোট হয়ে আসছে। পরিযায়ী পাখিরা প্রতি বছরই একই পথ অনুসরণ করে। একই জায়গায় খাবারের জন্য আসে। ৩০ গ্রাম ওজনের ছোট্ট এক ঘাসপাখি হাজার মাইল পথ বেয়ে এ দেশে হাওরের একটি কান্দায় এসে যদি দেখে ওই ঘাসবনটি আর নেই; তাহলে তার বেঁচে থাকার উপায় থাকে না। এ পৃথিবীটা পরিযায়ীদের বাসযোগ্য করতে এখন সবচেয়ে বেশি দায় নিতে হবে মানুষকেই।