× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বাল্যবিয়ে

যেন শৈশবেই মৃত্যু

মুহাম্মদ শফিকুর রহমান

প্রকাশ : ২৫ অক্টোবর ২০২৩ ১২:৪০ পিএম

যেন শৈশবেই মৃত্যু

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, ১৮ বছরের কম বয়সি মেয়ে এবং ২১ বছরের কম বয়সি ছেলের বিয়ে নিষিদ্ধ। কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে এ বয়সসীমা মানার কোনো বালাই নেই সমাজে। দেশের নানা প্রান্তে এমন অনেক পরিবার আছে, যারা মেয়ের বিয়ে দিতে পারলেই যেন বেঁচে যায়। অথচ এ কাজটি দীর্ঘ মেয়াদে ওই পরিবার এবং সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্যই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাল্যবিয়ের নানা দিক নিয়ে বিশেষ রচনা...

ক্লাস নাইনে পড়ার সময় বিয়ে হয় জরিনার। ওই বয়সে বিয়ে, সংসার, স্বামী এসবের কিছুই সে বুঝত না। বান্ধবীদের নিয়ে পাড়ায় দস্যিপনা করে বেড়ানোই ছিল তার কাজ। এর গাছের পেয়ারা তো ওর গাছের আম, কোনো কিছুই জরিনার নজর এড়াত না। কৃষক বাবা ভালো পাত্র পেয়েছেন। হাতছাড়া না করে এক সন্ধ্যায় মেয়েকে তার হাতে তুলে দিলেন। চলিশোর্ধ্ব স্বামী প্রথম রাতেই জরিনাকে অসুস্থ করে ফেললেন। শাশুড়িকে সেটা জানালেও তিনি বললেন, ও এমন কিছু না। ঠিক হয়ে যাবে। বছর পেরোতে না পেরোতেই জরিনার গর্ভে সন্তান এলো। সঙ্গে যুক্ত হলো নানা শারীরিক সমস্যা। সন্তান জন্মদানের সময় সে চলে গেলে না-ফেরার দেশে।

জরিনার এ পরিণতির জন্য দায়ী কে বা কারা? এটা শুধু একজন জরিনারই গল্প নয়। দেশের নানা প্রান্তে এমন গল্প আছে হাজারটা। এর সিকি অংশ হয়তো আমরা জানি কিন্তু অধিকাংশই থেকে যায় অজানা। বাল্যবিয়ের কারণে জরিনার মতো এমন করুণ পরিণতি বরণ করে নিচ্ছে দেশের অনেক কিশোরী।


বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের ‘বর্ন টু বি অ্যা ব্রাইড, চাইল্ড ম্যারেজ : ট্রেন্ডস অ্যান্ড কজেস’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৬০ শতাংশের বেশি পরিবারে বাল্যবিয়ের চর্চা রয়েছে। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে এসব পরিবারে যেসব মেয়ের বিয়ে হয়েছে অথবা পুত্রবধূ হিসেবে যারা এসেছে তাদের বয়স বিয়ের সময় ১৮ বছরের কম ছিল। এ ৬০ শতাংশ পরিবার যে গ্রামের অশিক্ষিত লোকজন, তা ভাবার সুযোগ নেই। এর মধ্যে তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরও অভাব নেই। যারা অনেকেটা জেনেশুনেই ছেলের জন্য অল্পবয়সি, অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে ঘরের বউ করে নিয়ে আসেন। বিয়ের বেলায় তারা ‘কচি’ মেয়েই খোঁজেন- এমনটাই বলছিলেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারপারসন বেগম মেহের আফরোজ। তিনি বলেন, যেসব ছেলে অল্পবয়সি মেয়ে বিয়ে করছে তাদের নিয়ে কোনো গবেষণা হচ্ছে না। এদের ছবি তুলে পত্রিকায় প্রকাশ করা প্রয়োজন।

ব্র্যাকের গবেষণায় বলা হয়েছে, বাল্যবিয়ের শীর্ষে রয়েছে পিরোজপুর, সেখানে এর হার ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ। বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে কম নেত্রকোণায়, ২৪ দশমিক ১ শতাংশ। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েদের ৬ দশমিক ৯ শতাংশের বয়স ১৫ বছরের নিচে। পিরোজপুরের পর বাল্যবিয়ের শীর্ষে থাকা জেলার মধ্যে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ (৬৫ দশমিক ২ শতাংশ), নওগাঁ  (৬৫ শতাংশ), ঠাকুরগাঁও (৬২ দশমিক ৫ শতাংশ) ও জয়পুরহাট  (৬১ দশমিক ৪ শতাংশ)। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ৫৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়েছে মাধ্যমিক পাসের আগেই। যোগ্য পাত্র পাওয়ার কারণে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন ৪৪ শতাংশ অভিভাবক। বাল্যবিয়ের কারণ হিসেবে ১৮ শতাংশ দারিদ্র্য, যৌতুক কম বা না চাওয়ার কারণে ১০ শতাংশ, সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে ৭ শতাংশ, পড়ালেখায় ভালো না হওয়ার কারণে ৬ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণের কথা বলেছেন ১৫ শতাংশ।

দক্ষিণ এশিয়ায় বাল্যবিয়ের হারে বাংলাদেশের অবস্থান মোটেই সুখকর নয়। বাংলাদেশে ইউএনএফপিএ’র প্রতিনিধি ক্রিশ্চিন ব্লুখস এক সভায় জানান, এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে বেশি, যা বয়ঃসন্ধিকালে গর্ভধারণের উচ্চ হারের কারণ। ১৫ থেকে ১৯ বছর বছর বয়সি প্রতি ১ হাজারে ৭৪ জন সন্তান জন্ম দিচ্ছে। প্রতি চারজন বিবাহিত কিশোরীর মধ্যে প্রায় একজন ইতোমধ্যেই সন্তান ধারণ শুরু করেছে।


বাল্যবিয়ে কেন হচ্ছে? সমাজবিজ্ঞানীরা দরিদ্রতা আর নিরাপত্তাহীনতাকে কারণ বলে মনে করছেন। বিয়েযোগ্য মেয়ে রাস্তাঘাটে নানা হয়রানির শিকার হয়। প্রবাসী বাবার মেয়ে হলে এ নিরাপত্তার অভাবটা আরও প্রকট হয়ে দাঁড়ায়। জলবায়ু সংকটের কারণে অনেকে বাসস্থান পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছে। বাসস্থান পাল্টানোর আগে মেয়ের বিয়ে দেওয়া ভালো মনে করে অনেক পরিবার। 

মেয়ে যত অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া যায় ততই ভালো বা বিয়েযোগ্য মেয়ে ঘরে রাখতে নেই; এমন কুসংস্কারও প্রচলিত সমাজে। মেয়েকে ঘরে রেখে শিক্ষিত, অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করার চেষ্টা অনেকেই করতে চায় না।

বাল্যবিয়ের কারণ নিয়ে  প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, ‘সামাজিক সচেতনতার অভাব, অভিভাবকদের অশিক্ষা এবং দারিদ্র্যের কারণে অনেকে মেয়েদের বোঝা হিসেবে ভাবে। যে কারণে নানা উদ্যোগের পরও বাল্যবিয়ে কমছে না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, ‘আমাদের বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে। তারা অজ্ঞতা, কুসংস্কার আর দরিদ্রতার কবলে পড়ে সন্তানদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।’

বাল্যবিয়ে রোধে সরকার বিভিন্ন সুযোগসুবিধা দিচ্ছে। গঠন করা হয়েছে কিশোর-কিশোরী ক্লাব। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকার প্রণয়ন করেছে বেশকিছু আইন, যার মধ্যে রয়েছে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন, যা ১৮ বছরের কম বয়সি মেয়েদের এবং ২১ বছরের কম বয়সি ছেলেদের বিয়ে নিষিদ্ধ করে। তবে  আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়।

বাল্যবিয়ের পরও অনেক নারী দিব্যি টিকে আছে। খোলা চোখে তাদের ভালো মনে হলেও ভেতরে কতটা সুস্থ, সে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। কারণ একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক মা সন্তান জন্ম দিলে পরবর্তীতে তার স্বাস্থ্যগত সমস্যার অন্ত থাকে না।

সীমার কথাই ধরা যাক। বিয়ের এক বছরের মাথায় কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে বাচ্চা। এর পর থেকে শরীরে সমস্যা লেগেই আছে। হাত-পা যখন তখন ফুলে যায়। এজন্য শাশুড়ি দুই কথা শোনাতে ভুল করেন না! সংসার টেকাতে সব মুখ বুজে সহ্য করে নেয় সীমা। 


বাল্যবিয়ে তৈরি করে বিবিধ স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি। এমনটাই বলছিলেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মুকেমুজান্নাতুন নেছা মমু। তিনি বলেন, ‘বাল্যবিয়ের কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা, অপরিণত গর্ভধারণ, মাতৃমৃত্যু ঝুঁকি, শিশুর মৃত্যুঝুঁকি, প্রজননস্বাস্থ্য সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। শরীর-মনেও বিরূপ প্রভাব ফেলে।’

হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের অধ্যাপক ড. রওশন আরা বলেন, ‘বিয়ের জন্য মেয়েদের শারীরিক গঠনের পূর্ণতা অত্যন্ত জরুরি। ১৮ বছরের আগে কোনোভাবেই একজন মেয়ের শরীর পূর্ণতা পায় না। অল্পবয়সি মায়েরা নানা ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভোগেন। রোগাক্রান্ত শিশুরও জন্মের কারণ অল্পবয়সি মা।’

সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন, বাল্যবিয়ের পরিমাণ না কমালে নারীর প্রতি সহিংসতা, মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি, অপরিণত গর্ভধারণ, প্রসবকালীন শিশুমৃত্যু, প্রজননস্বাস্থ্য সমস্যা, নারী শিক্ষার হার হ্রাস, স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি, নারীর অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষমতা ও সুযোগ কমে যাওয়াসহ নানাবিধ নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকবে।

আইনের প্রয়োগের পাশাপাশি বাল্যবিয়ে রোধে অভিভাবকদের সচেতনতাও অত্যন্ত জরুরি। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনদেরও এগিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি, সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া এককভাবে সরকার পদক্ষেপ নিলেই বাল্যবিয়ে বন্ধ হবে, এমনটা আশা করার অবকাশ নেই।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা