ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার
প্রকাশ : ১৩ জানুয়ারি ২০২৪ ১২:৩৩ পিএম
হুক্কার ব্যবহার এখন আর দেখা যায় না
আবহমান বাংলার জনপ্রিয় গান ‘আমার মান কুল মান সব হারাইলাম, এই হুক্কার সঙ্গ ধরে রে, ও সাধের হুক্কারে, তোরে ছাড়া প্রাণ বাঁচে না, রই কেমনে ঘরে...; পরানের হুক্কারে তোর নাম কে রাখিল ডাব্বা?...’ অথবা রম্য ছড়া ‘হায়রে সে-ই হুক্কা, উপরে তার তামাক-কলকি, নিচের দিকে চুক্কা, হায়রে সে-ই হুক্কা/নানা বলে নানি বলে, হুক্কা ছাড়া জীবন চলে?, হুক্কার পেট ভরা জলে, টানছে দেখ দুজন মিলে, হায়রে সে-ই হুক্কা।’
একসময়ের ধূমপানের অন্যতম অনুষঙ্গ ‘হুঁকা’ বা হুক্কা নিয়ে রচিত এসব গান, ছড়া এখনও দেশের সংস্কৃতিতে পরিচিত হলেও হারিয়ে গেছে বস্তুটি। এখন শহর দূরের কথা, গ্রামের পর গ্রাম ঘুরেও পাওয়া যায় না হুঁকার দেখা। কালের বিবর্তনে অনেকটা হারিয়ে গেছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী হুঁকা।
তিন-চার দশক আগেও বাংলার গ্রামগঞ্জে ধূমপায়ীরা হুঁকার মাধ্যমে তামাকপানের নেশায় ছিল অভ্যস্ত। সে সময় দেশের প্রায় সব বাড়িতেই ছিল এর প্রচলন। তখনকার দিনে গ্রাম্য সালিশ, সামাজিক অনুষ্ঠান বা জমায়েতে ছোটবড় সবাইকে হুঁকায় আপ্যায়নের রীতি ছিল। প্রতিটি গ্রামের প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী বাড়িতে লম্বা পাইপযুক্ত স্ট্যান্ড হুঁকা ওই বাড়ির শোভাবর্ধন ও প্রভাবের সাক্ষ্য বহন করত। বর্তমান প্রজন্মের কাছে হুঁকা একটি অপরিচিত বস্তু। এটি খাওয়া দূরের কথা, চোখেই দেখেনি তারা।
বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী এ হুঁকার জায়গায় বাজার দখল করেছে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নিকোটিনযুক্ত সিগারেট-বিড়ি। প্রজন্মের একটা বড় অংশ নিষিদ্ধ মাদকের নেশায় মাতোয়ারা। অথচ কম নিকোটিনযুক্ত হুঁকার প্রচলন থাকলে যুবসমাজকে মাদক গ্রহণের অধঃপতন থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করা যেত।
সম্প্রতি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নের নিভৃত গ্রাম ঝাপেরগাঁওয়ে সংবাদ সংগ্রহে গেলে এক বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে বসে কৃষ্ণমোহন সিংহের সঙ্গে বৈকালিক আড্ডায় হুঁকা পানরত অবস্থায় দেখা যায় বয়োবৃদ্ধ ললীমোহন সিংহকে।
আলাপকালে তিনি বলেন, ‘তিন-চার দশক পূর্বেও আমাদের বাপদাদারা তিন বেলা খাবার খেতে ততটা আগ্রহী হতেন না যতটা আগ্রহী ছিলেন হুক্কা টানায়। এ ছাড়া তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন কল্পনাও করা যেত না। ঘরে চালডাল না থাকলেও যথেষ্ট পরিমাণে জমা থাকত হুক্কার তামুক। তামাকপাতা টুকরা টুকরা করে কেটে এনে এতে চিটাগুড় মিশিয়ে তৈরি করা হতো বিশেষ এ তামুক। এতে নিকোটিনের পরিমাণ অনেক কম থাকে। যতটুকু নিকোটিন থাকে তা নারকেলের টোলে থাকা পানিতে মিশে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাপদাদার ঐতিহ্য ধরে রেখে আমি হুক্কা টানায় রয়েছি প্রায় ৬৫ বছর ধরে। এ ছাড়া জীবনে সিগারেট-বিড়ি বা পানও খাইনি। আমার গ্রামের আর কেউ না খেলেও আমি হুক্কার প্রেমে কাটিয়ে দিয়েছি ৬৫ বছর। আমার বাড়িতে এসে অনেকেই শখ করে হুক্কায় টান দিয়ে যান। এতেই আমার প্রশান্তি।’