হাসনাত মোবারক
প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০২৪ ১৩:৩৪ পিএম
আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৩:৩১ পিএম
আর কদিন পরেই শুরু হবে অমর একুশে বইমেলা। মাসব্যাপী এই উৎসবে দেখা মিলবে সব বয়সি বইপ্রেমীর ছবি : আলী হোসেন মিন্টু
দরজায় কড়া নাড়ছে ‘অমর একুশে বইমেলা’। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন শুরু হবে বাঙালির প্রাণের এ মেলা। বই উৎসবের সঙ্গে জড়িত লেখক, পাঠক, প্রকাশক, মুদ্রাকর, বাঁধাইকর থেকে শুরু করে পুস্তক ব্যবসায়ী, স্টল নির্মাণশ্রমিকসহ নানা পেশা- শ্রেণির মানুষ। এ মুহূর্তে যেন তাদের দম ফেলার অবকাশটুকু নেই। বইমেলা প্রস্তুতি নিয়ে বিশেষ লেখা...
বুধবার সকালে সদরঘাট এলাকার নর্থব্রুক হল রোডের মাথায় গিয়ে রিকশা থেমে গেল। চালক বললেন, ‘আর যাওন যাইব না, অহন হাঁট্টাই যান।’ হাত তুলে তিনি বাংলাবাজার মোড় ইঙ্গিত করলেন। মিনিট দুইয়ের হাঁটাপথ। রিকশা থেকে নেমে চোখে পড়ল কাগজ বহনকারী ভ্যানের বহর। সবাই ভ্যানগুলো পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। চালকদের চোখেমুখে রাজ্যের ব্যস্ততা। ভ্যান কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছানোর পর তারা নিঃশ্বাস ফেলবে। তাদের কাছে আছে বই ছাপানোর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সেগুলো নিয়ে গেলে তবেই তো ছাপাখানার মেশিন চলবে।
‘মামা পেরেশে (প্রেস) মাল না ধরাইলে আজ বড়ই ক্ষতি অইব। সকাল ১০টার সময়ও জ্যাম পাকাইল। দিন তো পইড়াই আছে। মেলার আগে খুচরা পেরাইভিট কারগুলো কেন যে ঢুকতে দেয় এই গিঞ্জি রাস্তায়!’ ভ্যানের পেছনে থাকা এক লোক নাগাড়ে এ কথাগুলো বলেই হাঁক ছাড়লেন। আমার উদ্দেশ্য জানিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে হেসে বললেন, ‘বুঝবার পারছি। সামনে এগোতে থাকেন, মালিক-মহাজন পাইবেন বহুত। তারা অবশ্য অহনও আইসা পৌঁছায় নাই। মালিকদের সঙ্গে কথা কইয়া নিয়েন।’ বলে আবারও হাসতে হাসতে তার গাড়ি ঠেলার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলেন। সামনের দিকে হাঁটা দিলাম। মুহূর্তে হইহই ধ্বনি তোলা কয়েকজনের একটি দল দেখা গেল। বইবোঝাই টুকুরি মাথায় নিয়ে প্যারিদাস রোড ধরে বাংলাবাজার মোড়ের দিকে যাচ্ছেন। এ পেশাজীবীদের বলে মিনতি। মিনতিদের সঙ্গে বাংলাবাজার মোড়ে পৌঁছালে নুর ইসলাম এগিয়ে আসেন। মিনতিদের বইয়ের টুকুরির সঙ্গে আমাকে দেখে তার মনে হলো আমি বুঝি এখান থেকে বই প্যাকেট করে পাঠাব। বইয়ের প্যাকেট সেলাই পেশার সঙ্গে জড়িত নুর ইসলামের হাতে এখন কাজ কম। জানালেন, দেশের বিভিন্ন জেলায় বইমেলা শুরু হলে তার ব্যস্ততা বাড়ে।
বাংলাবাজার মোড় থেকে দক্ষিণ গলির ভেতরে এগোনোর পর চোখে পড়ল থরে থরে সাজানো বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার সাইনবোর্ড। অনেক প্রকাশনা সংস্থার অবস্থান মান্নান মার্কেটে। এ ভবনের তৃতীয় তলায় সময় প্রকাশনে গিয়ে চোখে পড়ে একজন নিবিষ্টমনে পেস্টিং করা ট্রেসিং পেপারে পৃষ্ঠা নম্বর মেলাচ্ছেন। কাজটি পরীক্ষা করে দেখছিলেন সময় প্রকাশনের ব্যবস্থাপক আনিস আহমেদ। মেলার প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ‘দেখতেই তো পাচ্ছেন কেমন ব্যস্ততায় আছি। কারও সঙ্গে কথা বলার সময় পাই না। এর নাম বইমেলা। মেলা কাজ হাতে।’
বাংলাবাজারের প্রায় প্রতিটি প্রকাশনায় এখন এমন ব্যস্ততার চিত্র। কর্মীরা দায়িত্ব ভাগ করে নিয়ে কাজে ছুটছেন। কেউ বইয়ের ট্রেসিং পেপার হাতে। কেউ ছাপা বই বুঝে নিচ্ছেন প্রেসের লোকদের থেকে। কারও বইয়ের বাঁধাই কমজোরি হওয়ায় তর্ক জুড়ে দেওয়ার দৃশ্যও চোখে পড়ল। বই নিয়ে আসায় বাঁধাইখানার লোকদের উত্তর- ‘বই দেবেন পরে, কাজ চাইবেন সবার আগে! হাতের পাঁচ আঙুল তো সমান না।’
এরপর গেলাম পাশের ভবন ৩৮ বাংলাবাজারের মার্কেটে। এক চিলতে ঘরের মধ্যে লম্বা একটা টেবিলের ওপর ট্রেসিং পেপার পেস্টিংয়ে ব্যস্ত মনিরুজ্জামান। এক হাতে চাকু দিয়ে পলিথিন কাটছেন, আরেক হাত দিয়ে ফোন ধরে আছেন। অনুমান করলাম বুঝি ফোনে কোনো প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলছেন। ফোন রাখার পর আক্ষেপ করে বললেন, ‘শুনলেন তো ভাই। প্রকাশকরা মনে করে আমরা মেশিন। সারা বছর কোনো কাজ দেয় না। বইমেলা এলেই আমাদের ঘাড়ে এসে পড়ে সবাই।’ তার মতো সব পেস্টারই এমন ব্যস্ত সময় পার করছেন। তাদের পেস্টিং করা পেপার যাবে ছাপাখানায়। তাই চাপ দিচ্ছেন প্রকাশকরা।
ওখান থেকে বেরিয়ে গেলাম শিরিশ দাস লেনে মা কালার প্রিন্টার্সের কারখানায়। বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে ছাপা মেশিনের ঘটঘট আওয়াজ। ভেতরে ঢুকে দেখি গড়গড় করে কাগজ ছাপা হয়ে বেরিয়ে আসছে। এক মেশিনে চলছে বইয়ের মলাট ছাপার কাজ, আরেক মেশিনে ছাপার কাজ। অন্য একটিতে কাভার ল্যামিনেটিংয়ের কাজ। ছাপার পর সেগুলো বয়ে নিয়ে নিরাপদে রাখছেন আরও একজন। এমনি করে যে-যার মতো ব্যস্ত। তাদের কর্মযজ্ঞ দেখে স্বত্বাধিকারী কবির আহমেদের রুমে প্রবেশ করলাম। এ মুদ্রাকরের সঙ্গে কথা বলার সময় কয়েকজন প্রকাশনা কর্মী এলেন কাজ বুঝিয়ে দিতে। বাকি কাজগুলো কী অবস্থায় আছে সেসবের খোঁজও নিলেন। এ সপ্তাহের মধ্যেই যেন সব বই ছাপা হয়ে যায়Ñ মুদ্রাকরের কাছে এমন দাবি জানিয়ে চলে গেলেন। কবির আহমেদ হাসতে হাসতে বললেন, ‘বইমেলা সামনে, এসব চাপ তো আসবেই। তাদেরও চাপ, বই বিক্রি করেই তো আমাদের বিল দেবেন, বাইন্ডারের বিল দেবেন। নিজেদের সংসার চালাবেন। একটা মাসের ওপর নির্ভর করে আছে কত মানুষের রুজি।’ শেষে জানালেন, আজ রাতে ৩০টি বই ছাপার জন্য মেশিনে তুলবেন। এ বছর তিনি ৪০টি প্রকাশনার কাজ হাতে নিয়েছেন। কাজের এমন চাপ ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত থাকবে। তার মতো সব ছাপাখানাই ব্যস্ত। সময়মতো বই পাঠকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রাণপণ পরিশ্রম করে যাচ্ছেন সবাই।
এস এস ব্রাদার্স বুক বাইন্ডিংয়ের স্বত্বাধিকারী শাহারুল ইসলামের রূপচান দাস লেনের কারখানায় ঢুকে দেখি একজন কাগজ ভাঁজ করছেন। আরেকজন পৃষ্ঠা নম্বর মেলাচ্ছেন। অন্যজন আঠা লাগাচ্ছেন। বই কাটিংয়ে ব্যস্ত একজন। আরেকজন পলিগ্রাফ মেশিনে বই সেলাই করছেন। পাশের স্তূপ করা বইয়ের আড়ালে কয়েকজনকে শুয়ে থাকতে দেখে জানতে চাইলাম ভরদুপুরের ঘুমিয়ে আছে কেন? শাহারুল হেসে বললেন, ‘এখন তো কাজের চাপ। রাত ২টা পর্যন্ত কাজ চলে। শিফট অনুযায়ী কাজ করছি।’ শাহারুলের মতো বইপাড়ার সব কারখানায় দারুণ ব্যস্ততা।
বাংলাবাজার মোড়ে এসে দাঁড়াতে চোখ গেল উত্তরণ প্রকাশনার অফিসের ভেতরে। দেখি সিভি হাতে বসে আছেন প্রকাশক আহমেদ মাসুদুল হক এবং মুক্তদেশ প্রকাশনার প্রকাশক জাবেদ ইমন। বইমেলার স্টলে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করার জন্য দুজন মেয়ে এসেছেন। তারা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাদের মতো আরও অনেকেই বইমেলায় বিক্রয়কর্মীর কাজ করার উদ্দেশ্যে সিভি নিয়ে বাংলাবাজারে এসেছেন।
বাংলাবাজার থেকে যাই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। সেখানে এলাহি কারবার। একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলার স্টল সাজানোর জন্য বাঁশকাঠ আর লোহলক্কড়ের ঠোকাঠুকি চলছে। প্রকাশকরা ছোটাছুটি করছেন। দামদর চালাচ্ছেন উদ্যানের ভেতরে পসরা সাজিয়ে বসে থাকা স্টল নির্মাণ সামগ্রী বিক্রির ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলোয়। কেউ বসেছেন কাঠের পার্টিশন নিয়ে, কেউবা তারকাঁটা, রঙসহ ইলেকট্রিক সামগ্রী নিয়ে।
মেলাপ্রাঙ্গণ নান্দনিক রূপে সাজানোর জন্য স্টল নির্মাণে হাজারো কারিগর জড়িত থাকেন। কেউ নকশা করে দিচ্ছেন। অন্যরা বাঁশকাঠ-প্লাইউড দিয়ে গড়ে তুলছেন অপরূপ একেকটি স্টল। মেলা ঘিরে আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির প্রত্যাশা অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার একটু বেশি।
মেলার আয়োজন ও প্রস্তুতি সম্পর্কে আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক এবং ‘অমর একুশে বইমেলা’ পরিচালনা কমিটির সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গণি বলেন, ‘এবার অন্য বারের চাইতে ভালো মেলা হবে। কেননা রাত পর্যন্ত মেট্রোরেল চলবে।’ মেলা শেষ হওয়া পর্যন্ত ক্রেতারা থাকবেন বলে প্রত্যাশা করেন এ প্রকাশক। তিনি বলেন, ‘মেট্রোরেল শুক্রবারও চালু রাখার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি করেছি।’
শব্দশৈলী প্রকাশনার প্রকাশক ইফতেখার আমিন বলেন, ‘প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে। নবীন-প্রবীণ লেখকের নতুন বই থাকছে। কাগজের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে প্রতিবার কথা বলি। আসলে কর্তৃপক্ষ বই ছাপানোর কাগজের ক্ষেত্রে ভর্তুকি না দিলে ভবিষ্যতে আমরা কত দূর যেতে পারব, সে শঙ্কায় আছি।’
বইমেলার বিন্যাস অনেকটা গতবারের মতোই থাকছে। প্যাভিলিয়ন ও স্টলের জন্য রাখা হয়েছে আলাদা সারি। মেলার আয়োজনে থাকছে না স্পন্সর কিংবা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান। বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘মেলার প্রস্তুতি কার্যক্রম ৯০ শতাংশই শেষ। গত মেলার বিন্যাস সবাই পছন্দ করেছেন, তাই এবার খুব একটা পরিবর্তন আনা হয়নি।’
এবার মেলার প্রবেশদ্বার থাকবে চারটি। টিএসসির উল্টোদিক, বাংলা একাডেমির উল্টোদিক ও রমনা কালীমন্দিরের নিকটবর্তী প্রবেশপথ। গত বছর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের দিকের প্রবেশপথটি সপ্তাহে পাঁচ দিন বন্ধ থাকত। এবার তা পূর্ণ সময় খোলা থাকবে।’
টিএসসির প্রবেশদ্বার থেকেই শুরু হবে মেলা। এ অংশের ডান দিকের অংশজুড়ে থাকবে সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানসমূহের প্যাভিলিয়ন ও স্টল। উদ্যানের বাঁ দিকের অংশ থাকবে ফায়ার সার্ভিসসহ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের জন্য। এখানেই থাকবে মোড়ক উন্মোচন মঞ্চ। লিটলম্যাগ চত্বরের জায়গা বদলে মুক্তমঞ্চের পাশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রমনা কালীমন্দিরের নিকটবর্তী মেলার অংশটুকু হবে শিশুচত্বর। এবারের মেলায় তালিকাভুক্ত ৬২৪টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আরও ২৩ প্রতিষ্ঠান।