× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

ক্ষমতা যখন নারী নিপীড়নের কারণ

বাসন্তি সাহা

প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:৩৬ পিএম

গত ৪ ফেব্রুয়ারি শনিবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত ধর্ষণের প্রতিবাদে সরব হয়ে ওঠে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা

গত ৪ ফেব্রুয়ারি শনিবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত ধর্ষণের প্রতিবাদে সরব হয়ে ওঠে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে মনে করা হতো নারীর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ। সেখানে এমন একটি দুর্ঘটনা তার ‘সিগনেচার নেম’ কেড়ে নেওয়ার শামিল। সারা দেশেই এমন দুয়েকটি ঘটনা ঘটছে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা দেশে যে ক্ষমতার অপব্যবহার হচ্ছে, তারই দৃষ্টান্ত তুলে ধরে। আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র হিসেবে একই সঙ্গে লজ্জিত, শঙ্কিত ও ক্ষুব্ধ। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। ক্ষমতা কার কাছে কতটুকু দিতে হবে তা নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে ভাবতে হবে। কথাগুলো বলছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তেমুজিন রায়হান তপু।

দেশের সব জায়গায়ই এমন দুর্ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। সব পত্রিকায় বা গণমাধ্যমে উঠে আসে না। আমি যখন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলাম। তখন ১৯৯৮ সালে এমন একটি দুর্ঘটনা ও তার প্রতিবাদের আন্দোলনে আমিও ছিলাম। আসলে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলেই ধর্ষণের মতো এমন অবমাননাকর ভয়ংকর অপরাধ করা যায়। আজকের মতো সেদিনও সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা এ অপরাধের শাস্তি দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। কথাগুলো বলছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী ও এনসিটিবির কর্মকর্তা নুরুন্নেছা সিল্কী।

চার্লি চ্যাপলিনের একটা বক্তব্য আছে এ রকম, ‘তোমার তখনই পাওয়ার দরকার হয় যখন তুমি ক্ষতিকর কিছু কর না হলে ভালোবাসা দিয়েই সবকিছু করা যায়।’ বাংলাদেশে ধষর্ণসহ নারীর বিরুদ্ধে সব অবমাননার পেছনে রয়েছে এ ক্ষমতার অপচর্চা।

৪ ফেব্রুয়ারি শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের পাশের জঙ্গলে এ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এরই মধ্যে এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর স্বামী বাদী হয়ে ছয়জনের বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় একটি গণধর্ষণ মামলা করার পর পুলিশ প্রধান অভিযুক্তসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। প্রধান অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর রহমান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। তবে অভিযোগ ওঠার পর তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলে শাখা ছাত্রলীগ জানিয়েছে।


বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত মোস্তাফিজকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা ও তার সনদ স্থগিত করা হয়েছে। তাকে সহযোগিতাকারী একই বিভাগের শিক্ষার্থী মুরাদ হোসেনকে সাময়িক বহিষ্কার ও সনদ স্থগিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে।

এর আগে ৩১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান অনুষদের একটি বিভাগের অধ্যাপকের বিরুদ্ধে ধর্ষণ-চেষ্টার অভিযোগ আনেন ওই বিভাগেরই এক ছাত্রী। লিখিতভাবে উপাচার্যের কাছে ওই অধ্যাপক সম্পর্কে যৌন হয়রানি, যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণ-চেষ্টার অভিযোগ করেছিলেন ওই ছাত্রী।

বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতাদের হাতে বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।

এর প্রতিবাদে সে সময় বড় রকমের আন্দোলন হয়েছিল ক্যাম্পাসে। প্রায় একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ঘটেছিল ছাত্রী নিপীড়ন। এ দুটি ঘটনার প্রেক্ষাপটে সে সময় শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটি তৈরির ব্যাপারে জনমত গড়ে ওঠে।

এ অবস্থায় ২০০৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে অ্যাডভোকেট সালমা আলী এক রিট আবেদন করেন। পরের বছর ২০০৯ সালে হাইকোর্ট কর্মস্থলে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বন্ধে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠনসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে কোনগুলো যৌন হয়রানি, কোনগুলো নয় তা নির্দিষ্ট করে একটি ভারডিক্ট প্রদান করেন হাইকোর্ট। এটাই এখন পর্যন্ত যৌন হয়রানি বন্ধের মামলায় ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।


বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। ২০০০ সালের অক্টোবরে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের ফলে সংশোধিত আইনটি কার্যকর হিসেবে জারি হয়। ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের পর আইনের সংশোধনটি অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। এ আইনে বলা হয়, ‘যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ-পরবর্তী তাহার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিতা নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।’

সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী দীপা বিশ্বাস বলেন, ‘ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সব যৌন হয়রানির বিচার বা এ আন্দোলনের অর্জন এবং প্রাপ্তিগুলো অনেক ক্ষেত্রেই আপাতভাবে এত অল্প যে আলাদা করে চোখে আঙুল দিয়ে না দেখিয়ে দিলে নজরে আসে না। সামাজিক কারণে প্রথমত ধর্ষণের ঘটনা নির্যাতিতার পরিবার আইনের আশ্রয় নিতে চায় না। নিলেও বিচার পাওয়ার দীর্ঘসূত্রতা, প্রমাণ না থাকা, সাক্ষীর অভাবে বাদীপক্ষ নিরুৎসাহ হয়। আইনের আশ্রয় নিলে বাদীপক্ষকে নানা রকম হয়রানি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাদের দমিয়ে রাখা হয় অথবা আদালতের বাইরে টাকাপয়সা দিয়ে মিটমাট করে নেওয়া হয়। ফলে ধর্ষণের ঘটনা কমছে না।’

অন্যায় দেখে, অবমাননা দেখে, নিপীড়ন দেখে আমরা রাগতে ভুলে গিয়েছি। কিছুতেই কিছু আমাদের যায় আসে না। খেতে না পেয়ে, কর্মহীন হয়ে কত লোক সপরিবার নিজেদের শেষ করে দিচ্ছে। আমাদের কিছু যায় আসে না। পাশের বাড়িতে, পাশের ফ্ল্যাটে তা ঘটলেও আমাদের কিছু যায় আসে না। যতক্ষণ না আমাদের নিজেদের গায়ে আগুন লাগছে ততক্ষণ আমরা এ যন্ত্রণার আঁচ পাই না। প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ ও বিচার না হওয়ার কারণে চলতে থাকে নারীর বিরুদ্ধে এ নিষ্ঠুর বঞ্চনা। কথাগুলো বলছিলেন উন্নয়নকর্মী ফারহানা আফরোজ।

ধর্ষণসহ নারীর বিরুদ্ধে সব অবমাননা ঘটনার বেশিরভাগ ঘরের বাইরে আসে না। কখনও কখনও সেগুলো ছিটকে আসে বাইরে, কখনও ধীরে, কান পেতে চেষ্টা করে শুনতে হয়। প্রতিবাদের শব্দগুলো বাক্য হয়ে ওঠার সম্ভাবনা সব সময় থাকে না। আন্দোলন, প্রতিবাদ সব সময় আলোর মুখ দেখে না। কখনও শাস্তি হয়, কখনও হয় না। ফলে যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর ক্ষমতাধর মানুষ ক্ষমতার চর্চা করে যায়। নির্যাতিতার জীবন-প্রত্যাশা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন, বেদনা বা ব্যাকুলতা এগুলো চাপা পড়ে থাকে কোথাও। সব দেশে বা সমাজে নারীর মর্যাদা ও ক্ষমতায়ন একটা চর্চা। পরিবারে, সমাজে এবং রাষ্ট্রীয় চর্চায় নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার একটা শিক্ষা ও অভ্যাস তৈরি হয়। না হলে এ গল্পের নটে গাছটি কখনও মুড়োবে না।

লেখক : কোঅর্ডিনেটর, রিসার্চ অ্যান্ড ডকুমেন্টেশন, দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা