× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতির এক দশক

সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কতটুকু বদলাল

বনশ্রী মিত্র নিয়োগী

প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১১:৫০ এএম

হিজড়াদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে এগিয়ে আসতে তাদের নিজদেরও                                                                 ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

হিজড়াদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে এগিয়ে আসতে তাদের নিজদেরও ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ঝিনাইদহের ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের নজরুল ইসলাম ঋতু, কোটচাঁদপুর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করেছেন সাদিয়া আখতার পিংকী। তা ছাড়া সংবাদপাঠিকা তাসনুভা আনান শিশিরকেও আমরা সবাই চিনি।

প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় লিঙ্গ যা-ই বলি না কেন, লিঙ্গ কখনও কোনো ব্যক্তির পরিচিতির মাপকাঠি বা মানদণ্ড হতে পারে না। প্রয়োজন অনুকূল পরিবেশ আর সুযোগ, তাহলে যেকোনো মানুষই সামর্থ্য ও যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে।

প্রায় এক দশক হয়েছে হিজড়া জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয়ভাবে তৃতীয় লিঙ্গ (হারমাফ্রডাইট) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, প্রণয়ন করা হয়েছে তাদের জীবনমান উন্নয়ন সহায়ক নীতিমালা। খতিয়ে দেখার সময় এখন বাস্তবায়ন পর্যায়ে কোথায় আছে, বাধাগুলো কী, এসব বাধার মোকাবিলায় কতটুকু প্রস্তুত আমরা, কীভাবে আরও এগিয়ে যাওয়া যায়। রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে বিভিন্নভাবে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠার নিরন্তর লড়াইয়ের পাশাপাশি হিজড়া জনগোষ্ঠী মানুষের সংগ্রামে নাগরিক সংগঠনও সোচ্চার রয়েছে, তবে সামগ্রিকভাবে আরও জোরালো ভূমিকার সুযোগ রয়েছে।

হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করার বৈজ্ঞানিক বা আইনি ব্যাখা আলোচনায় আসা উচিত          ছবি: জাকির হোসেন চৌধুরী

পেশা, ধর্ম, শ্রেণি, গ্রাম, শহর, ভৌগোলিক অবস্থান, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, জাতিসত্তা, অর্থনৈতিক অবস্থা যেভাবেই চিহ্নিত বা সংজ্ঞায়িত করি না কেন, সবাই কিন্তু মানুষ। এ সহজ সত্যিটাই আমরা মানতে পারি না বা মানতে চাই না, সৃষ্টি করি বিভাজন। অথচ জন্মগতভাবে প্রতিটি মানুষের সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। ‘নারীর অধিকার মানবাধিকার’ প্রতিষ্ঠায় নানান আয়োজনে আন্দোলনে এগিয়ে যাওয়ার সংগ্রাম তো চলছেই। সেখানে হিজড়া জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের পথ আরও কঠিন, কিন্তু রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তিই পারে এ কঠিন পথ অতিক্রম করতে।

হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করার বৈজ্ঞানিক বা আইনি ব্যাখা কী তা পরিষ্কারভাবে আলোচনায় আসা উচিত। প্রসঙ্গক্রমেই প্রশ্ন এসে যায় তাহলে প্রথম বা দ্বিতীয় লিঙ্গ হিসেবে কাদের চিহ্নিত করছি। নিশ্চয় নারী ও পুরুষের মধে আরেকটা সামাজিক ক্ষমতা বা সম্পর্ক বড় বা ছোট করছি কি না তা-ও ব্যাখ্যার দাবি রাখে। জৈবিক ভিন্নতা কেন্দ্র করে এ বিভাজনে বা সংজ্ঞায় ক্ষিতিগ্রস্ত হয় সকল পর্যায়ের মানুষ, লঙ্ঘিত হয় মানবাধিকার।

ভিন্নতা, বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যময়তা গ্রহণ করার মানসিকতা না থাকার পেছনে অনেক কারণের একটি হলো খোলাখুলিভাবে এসব সহজ বিষয় নিয়ে যথেষ্ট আলোচনার সুযোগ না থাকা বা না করা। স্কুলের পাঠ্যবইতে এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্তির দাবি দীর্ঘদিনের। বর্তমানে এর প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। সেজন্য কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। বাংলাদেশে জনসংখ্যার বিভিন্ন অংশের অপরিহার্য চাহিদা এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য এ বৈচিত্র্যের প্রেক্ষাপট, বৈজ্ঞানিক ভিত্তি, সামাজিক কারণ ও সম্পর্কগুলো সবার জানা এবং বুঝতে আগ্রহী করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। তা না হলে অস্বচ্ছতা থেকেই যাবে, অকারণ-অযৌক্তিক প্রচারে বিভ্রান্তির শেষ হবে না। সেই সঙ্গে সমাজে সচেতনতা বাড়াতে এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সম্মান রক্ষায় সামাজিক, নাগরিক সংগঠন, প্রচারপ্রসার মাধ্যম এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে সহায়ক হতে পারে।

ছবি: কাইজার চৌধুরী 

এবার আসি হিজড়া জনগোষ্ঠীর অধিকারবঞ্চনা ও অধিকার প্রাপ্তি বিষয়ে। দীর্ঘদিনের দাবিদাওয়া আন্দোলনের মাইলফলক হিসেবে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ আইনি স্বীকৃত পায় ২০১৩ সালে এবং ২০১৪-এর জানুয়ারিতে এর গ্যাজেট প্রকাশিত হয়। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো রাষ্ট্রীয়ভাবে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত এবং নাগরিকত্বের সনদ বা জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট করার বাধা দূর হওয়া। কিন্তু সম্পত্তিতে হিজড়াদের উত্তরাধিকারের বিধান নেই। তেমনই যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনায় আইনি প্রতিকার পাওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা জটিলতা, প্রতিবন্ধকতা।

সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা মানসিকতায়। আমাদের মানসিক দীনতা যতদিন না দূর হবে ততদিন হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষ তাদের যথাযথ অধিকার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিতই থাকবে, পাবে না সম্মান ও মর্যাদা। একই সঙ্গে বৈষম্য বিলোপ আইন চূড়ান্তকরণ ও কার্যকরের পদক্ষেপ গ্রহণ ও অনিবার্য।

হিজড়া জনগোষ্ঠীর মনোজগৎ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের স্পষ্ট ধারণা নেই। আজও অনেক পরিবারে বাবা-মাসহ অন্যরা মানসিক নির্যাতন করছেন। এ দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো জরুরি। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও অবস্থার পরিবর্তন নিশ্চয়ই হচ্ছে। পরিবারের সচেতনতা দৃশ্যমান হচ্ছে। বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানো হচ্ছে। কিছু কিছু পরিবার অন্য সন্তানের সঙ্গেই বড় করে গড়ে তুলছে। সামাজিক স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। তবে খুব ধীরগতিতে।


সামাজিক পরিবর্তন ধীরে নীরবেই ঘটতে থাকুক; কিন্তু হিজড়া জনগোষ্ঠীর মনস্তত্ত্ব বুঝে দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা তাদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে করা প্রয়োজন। যা অনগ্রসর এ জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত হতে, অর্থনৈতিক কাজে যুক্ত হতে, সামাজিক কাজে যুক্ত হতে বা যে যে পেশায় বা কাজে যুক্ত হতে চায় সে সুযোগ তৈরি করতে সরকারি, বেসরকারি, প্রাইভেট সেক্টর, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে এলে হয়তো দ্রুততার সঙ্গে এ পরিবর্তনে অবদান রাখতে পারবে। আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদা বোধ গড়ে তুলতে পরিবার, শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানের করণীয় বিষয়ে ব্যাপক প্রচারে হয়তো আমাদের নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ শানিত হবে।

সরকারি সেবার মাধ্যমে হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষ পাচ্ছে প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষাবৃত্তি। বয়স্ক ভাতা, বিভিন্ন ট্রেডে/কারিগরি প্রশিক্ষণ, প্রশিক্ষণ শেষে অনুদান, যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। প্রয়োজন সদিচ্ছার, তা হলেই হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব।

হিজড়াদের প্রতি প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে এগিয়ে আসতে তাদের নিজদেরও নিজ উদ্যোগে আওয়াজ তুলতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে; তা না হলে তাদের প্রতি মানবিক আচরণ নিশ্চিত করাতে অনেক সময় সম্ভব হবে না। সমাজে এমন দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন আনার জন্য হিজড়াদের সাংবিধানিক ও আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই। আশার কথা, ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় হিজড়াদের নিজস্ব সংগঠন গড়ে উঠছে। তাদের দাবি আদায়ের আন্দোলন আরও সোচ্চার হয়ে উঠবে সেটাই প্রত্যাশা।

লেখক: পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা