রোকনুজ্জামান
প্রকাশ : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১২:৪২ পিএম
যাওয়ার পথে দেখা মেলে হরিণ, বানর ও বন্য শূকরের
ভোরের আলো ফোটেনি তখনও। ঝিরিঝিরি হাওয়া গা ছুঁয়ে জানান দিচ্ছে শীতের। কিছু দূরে খানজাহান আলী সেতুতে প্রজ্বলিত মৃদু আলো এসে জমা হচ্ছে চোখে। সারা রাত বাস ভ্রমণে সবার চোখে-মুখে একরাশ ক্লান্তি। ঠান্ডা পানি আর কুয়াশার চাদর ভেদ করে জাহাজ ছুটে চলে সুন্দরবন অভিমুখে। অজানাকে জানার অপার বাসনা আর পেটভরা ক্ষুধা নিয়ে শেষ হয় রাতের খাবার। শুরু হয় নদীপথের দীর্ঘ যাত্রা।
মনোমুগ্ধকর এমন যাত্রার মাধ্যমেই শুরু হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির (চবিসাস) এবারের গ্র্যান্ড ট্যুর। গত ৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে যাত্রা করে ফেরা হয় ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে।
আন্ধারমানিক
সড়ক ছেড়ে নৌপথে যাত্রা শুরু হয় ৬ ফেব্রুয়ারি ভোরে। জাহাজের মন্থরগতির সঙ্গে ফুটতে থাকে ভোরের আলো। সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য নজরকাড়ে ক্রমেই। প্রথম গন্তব্য আন্ধারমানিক ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র। রূপসা নদী থেকে জাহাজ প্রবেশ করে পশুর নদে। সেখান থেকে শ্যালা নদী। এই শ্যালা নদীর পাড়ঘেঁষেই অবস্থান আন্ধারমানিকের। আন্ধারমানিকে যখন পৌঁছাই, ঘড়ির কাঁটা তখন দুপুর একটা পেরিয়েছে। মাঝনদীতে জাহাজ নোঙর করে আমরা পাড়ে যাই ট্রলারে করে। নামার আগে বিস্তারিত নির্দেশনা দেয় গাইড। নিরাপত্তার জন্য সঙ্গে ছিল গানম্যান। আন্ধারমানিকে সুন্দরবনের গোলপাতা, কেওড়া, গেওয়া আর সুন্দরী গাছের মাঝে ট্রেইল ধরে এগিয়ে চলি আমরা। বাঘ মামাদের কোনো সন্ধান না পেয়ে কাদায় পড়া তাদের পায়ের ছাপ দেখেই সান্ত্বনা নিতে হয় আমাদের। প্রথম দিন আর কোথাও যাওয়ার সুযোগ হয় না আমাদের। পুরো দিনই লোনাপানির গা ছুয়ে মৃদু তরঙ্গ তুলে জামতলা বিচের দিকে এগিয়ে যায় জাহাজ।
জামতলা বিচ ও কটকা
রাতেই জামতলা পৌঁছাই আমরা। খুব ভোরে গাইডের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙে সবার। নাশতা সেরে রওনা হই জামতলা সি-বিচের উদ্দেশে। যেতে হয় হেঁটে। দুই কিলোমিটারের মতো দূরত্ব। যাওয়ার পথে দেখা মেলে হরিণ ও বন্য শূকরের। আমাদের দেখে ভোঁ দৌড় দেয় একদল হরিণ। এ যেন এত দিনের কল্পিত দৃশ্যেরই রূপায়ণ। এখানে কিছু সময় কাটিয়ে নদীর অপর পাশের কটকা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে যাই সবাই। সেখানে দেখা মেলে অসংখ্য হরিণের। দীর্ঘ সময় পর মোবাইলে নেটওয়ার্ক পাই এই কটকাতে। একটিমাত্র টেলিটক সিমের টাওয়ার রয়েছে এখানে। ঘোরাঘুরি শেষে জাহাজে ফিরি। জাহাজেই সকালের নাশতা ও দুপুরের খাবার শেষ হয়। এবার ছুটে চলি দুবলার চরের দিকে। জাহাজ যখন বনের মাঝের সরু খাল ধরে এগিয়ে চলেছে, নিকট দূরত্বের পুরো পথজুড়ে দেখা মেলে হরিণ-বানর আর বিচিত্র সুরে স্লোগান তোলা নাম না-জানা অসংখ্য পাখি। মাঝেমধ্যে উঁকি দিয়ে যায় কুমির আর শুশুকেরা।
দুবলার চর
সেদিনের জ্বালানি শেষ করে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়বে। এ রকম সময় দুবলার চরে গিয়ে পৌঁছায় আমরা। এখানে গড়ে ওঠা শুঁটকি পল্লীতে প্রবেশ করি। কেউ কূপ থেকে পানি তুলছে। কেউবা নৌকা থেকে মাছ বয়ে এনে রোদে শুকাচ্ছে। কেউ ব্যস্ত শুঁটকি প্রস্তুতের অন্যান্য কাজে। তবে দেখা মেলে না কোনো নারী বা শিশুর। কারণ হিসেবে জানা যায় জীবিকার তাগিদে অস্থায়ীভাবে এখানে বাস করে শুধু পুরুষরা। নদীর পাড় ধরে হাঁটতে গিয়ে দেখা মেলে মৃত কাছিমের। জেলেরা জানান, জালে ধরা পড়ে মারা গেছে এগুলো। পরে পানিতে ভাসতে ভাসতে ঠাঁই হয়েছে এ তীরে। যখন ফেরার সময় হয় ততক্ষণে সূর্যমামা ডুব দিয়েছে পশ্চিম আকাশে। অস্থায়ী মসজিদগুলো থেকে ভেসে আসে মাগরিবের সুমধুর আজান।
দুবলার চর থেকে আমরা যাই কুমির প্রজননকেন্দ্র করমজলে। করমজল থেকে মোংলা বন্দর হয়ে সড়কপথে খানজাহান আলীর (রহ.) মাজার, ষাট গম্বুজ মসজিদ ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। পরিদর্শন শেষে ফের জাহাজে ফিরি। রাতের খাবার শেষে জাহাজ থেকে বিদায় নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে যাত্রা। গান আর আড্ডায় মুখরিত থাকে জাহাজে কাটানো তিনটা দিন আর দুটি রাত।
ইচ্ছা হয় সুন্দরবনের গহিন বন আর জলরাশির বিশালতায় আত্মসমর্পণ করি। থেকে যায় আরও কটাদিন। উপায় নেই, ফিরতেই হয়। যান্ত্রিকতার জাঁতাকলে পিষ্ট এ দেহ-মন যেন এখনও পড়ে আছে সুন্দরবনের পশুর আর শ্যালা নদীতে কিংবা গোলপাতা, কেওড়া, গরান আর সুন্দরী গাছের আবছায়া শীতল বনে।