প্রচ্ছদ
সিরাজুল ইসলাম আবেদ
প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৮:১৬ পিএম
আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২০:৪৩ পিএম
মডেল : তামান্না, সজীব ও শারমিন; পোশাক ও গয়না : সাদাকালো; মেকআপ : বিন্দিয়া; ছবি : ফারহান ফয়সাল
একুশ আমার চেতনার রঙ, রক্তে জাগা টঙ্কার... একুশ আমার শিরদাঁড়াটা ঋজু করে রাখা অহংকার…
বছর ঘুরে দুয়ারে দাঁড়িয়ে মহান একুশে। প্রাণের বিনিময়ে মাতৃভাষা বাংলা রক্ষা করার দিন। শিমুল, পলাশ, অশোকে রাঙানো এ বসন্ত সেদিন আরও রাঙিয়ে দিয়েছিলেন বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার, শফিউর, আউয়াল, অহিউল্লাহসহ নাম না-জানা শহীদরা।
১৯৫২-এর মায়ের ভাষা রক্ষার সেই আন্দোলন আমাদের পথ দেখিয়েছিল হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার। শ্বাস নিতে মুক্ত বাতাসে, নিজের মতো করে। একুশ আমাদের শিখিয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধেপ্রতিবাদী হতে, অসাম্প্রদায়িক হতে; জাতিসত্তার প্রতীক হিসেবে নিজ সাহিত্য-সংস্কৃতি-কৃষ্টি সমুন্নত রাখতে। এটাই একুশের চেতনা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির জাগ্রত সেই চেতনার পথ ধরেই ১৯৭১ সালে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা। তাইতো একুশ আমাদের চেতনার রঙ।
একুশে ফেব্রুয়ারি দীর্ঘদিন আমাদের কাছে ছিল শহীদ দিবস। জাতিসংঘের ঘোষণার পর এখন সেখানে যুক্ত হয়েছেনতুন মাত্রা, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সারা বিশ্বের মানুষ যার যার মাতৃভাষার প্রতি সম্মান জানিয়ে দিনটিপালন করছে। আমরাও বেশ ঘটা করেই দিনটি পালন করি।ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি এলেই শুরু হয়ে যায় তার প্রস্তুতি। নানা আয়োজন, আলোচনা, সভা। তার সঙ্গে দিনটিরভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চাই পোশাক। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশজ পোশাকশিল্পের নকশাকাররাএক ধরনের বিপ্লবই নিয়ে এসেছেন। শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি নয়, প্রতিটি দিবস-উৎসবে তাদের সৃজনশীলতা রাঙিয়েদেয় আমাদের।
একসময় একুশে ফেব্রুয়ারি মানেই ছিল সাদা-কালো। দিনটির ভাবগাম্ভীর্য, সেই সঙ্গে শোক শক্তিতে রূপান্তরিত করে জ্বলে উঠবার শপথে সাদা-কালোর চেয়ে ভালো রঙ আর কী হতে পারে! সাদা-কালো শাড়ি-পাঞ্জাবিতে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...’ গাইতে গাইতে ভোরের প্রভাতফেরি, সে তো আমাদের একান্ত আপন।
সময়ের স্রোত আর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বমাঝে একুশের স্বীকৃতি দিনটি বর্ণিল করে তোলে। আমাদের নকশাকাররা তাদের পোশাকে ছড়িয়ে দেন আলপনার কারুকাজ। শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, কুর্তা কিংবা পাঞ্জাবি বা ফতুয়া-পোশাকের জমিনে ঠাঁই করে নিয়েছে বর্ণমালা, কবিতার পঙ্ক্তি, শহীদ মিনার কিংবা ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’য়ের মিছিল। সাদা-কালোর সৌম্যকান্তি রূপরেখার সঙ্গে অল্পবিস্তর জায়গা করে নিয়েছে বিপ্লব, বিজয় আর ভালোবাসার লাল। শিল্পীরা বসনে ফুটিয়ে তুলছেন আমাদের সংগ্রাম ও গৌরবের ইতিহাস। আমরা সে গৌরবগাথা গায়ে জড়িয়ে নিচ্ছি।
স্বাধীনতার পর একুশের চেতনা প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতে যুক্ত হয় বইমেলা। শুরুটা মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহার একক উদ্যোগ হলেও পরে বাংলা একাডেমি দায়িত্ব নেয়। দিন দিন বাড়তে থাকে বইমেলার ব্যাপ্তি। মাসব্যাপী বইমেলা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল চত্বর হয়ে দেশের নানা প্রান্তে; জেলায়, উপজেলায়। প্রতি বছর লেখক-প্রকাশকের সঙ্গে লাখ লাখ পাঠক অপেক্ষা করে একুশে বইমেলার জন্য। বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্পের সবচেয়ে বড় উৎসব যেন ‘অমর একুশে বইমেলা’। মা-বাবার হাত ধরে শিশুরা মেলায় আসছে। বেছে বেছে নিজের পছন্দের ব্যাগ ভর্তি বই নিয়ে মেলা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে!
তার পরও প্রশ্ন থেকে যায় যখন দেখি ভাষা আন্দোলনের ৭১ এবং স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও আমাদের উচ্চশিক্ষার বইগুলো বাংলা ভাষায় লেখা হয়নি। তাইতো এ যুগের মায়েরা বাংলা শেখানোর চাইতে সন্তানকে ভিনদেশি ভাষা শেখাতে বেশি মনোযোগী। দূর থেকে লক্ষ করি, এক মা তার সন্তানকে ছোটদের ইংরেজি শিক্ষা বিষয়ক বইটি কিনে দিতে বেশি আগ্রহী। আর শঙ্কাটা এখানেই।
প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের মানুষের অনুভূতি প্রকাশের ভাষা এক নয়। পাশ্চাত্য যেমন প্রদর্শনবাদী, আমরা প্রাচ্যের মানুষ তেমনটা নই। ইউরোপ-আমেরিকানরা জাতীয় পতাকার প্রতি ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে ব্যবহার্য জিনিসপত্র এমনকি পায়ের জুতায়ও জাতীয় পতাকা আঁকতে দ্বিধা করেন না। কিন্তু আমরা আমাদের জাতীয় পতাকা বুকে ধারণ করি, মাথায় তুলে রাখি। সেটাই আমাদের ভালোবাসার প্রকাশ, সম্মান দেখানোর প্রথা। আমাদের প্রজন্মও দিন দিন প্রদর্শনের দিকে ঝুঁকছে। একই সঙ্গে আমাদের চেতনাও তারা বুকে লালন করছে তো? সেটা যদি না হয়, এ দিবস উপলক্ষে পোশাক একদিন ব্যঙ্গবিদ্রূপে রূপ নেবে। শোক শক্তিতে রূপান্তর করে আমাদের পূর্বপুরুষরা যে অনন্য রূপকথার জন্ম দিয়েছেন, তা দিনে দিনে পল্লবিত হবে আপন চেতনার রঙে-এটুকুই চাওয়া। আর সেটা জীবনযাপনে আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে।