মোহসীন উল হাকিম
প্রকাশ : ৩০ মার্চ ২০২৪ ১২:১১ পিএম
আপডেট : ৩০ মার্চ ২০২৪ ১২:১২ পিএম
সুন্দরবনের একটি দস্যু দলের সঙ্গে লেখক। সুন্দরবন ঘিরে এমন অনেক দস্যু আত্মসমর্পণ করে ফিরেছেন স্বাভাবিক জীবনে
সুন্দরবন উপকূলের জেলে ও সাধারণ মানুষের জীবনে স্বস্তি ছিল না একটা সময়। বনদস্যু-জলদস্যুদের আতঙ্ক ছিল সাগরজুড়ে। আত্মসমর্পণ করে সেই দস্যুদের অনেকেই ফিরেছেন স্বাভাবিক জীবনে। তারা কেউ মাছ ধরেন কেউবা বনজীবী। কাজ করতে চান সুন্দরবনের সুরক্ষায়। তাদের নিয়ে বিশেষ লেখা...
তিনি ফরিদ। দস্যু জগতে তার নাম ছিল কিস্তেন ফরিদ। বাড়ি বাগেরহাটের রামপাল। প্রায় এক যুগ তার কেটেছে সুন্দরবনের দস্যু জগতে। সশস্ত্র সেই জীবন ছিল অভিশাপের। ফরিদ বললেন, ‘ওই জঙ্গলের ভেতরে কত অন্যায়-অপরাধ করেছি ভাই। কত মানুষের ক্ষতি করছি, হরিণ মারছি, শিকার করছি। সরকার ওই অপরাধ মাফ করেছে। আমাদের মনেও বুঝ এসেছে। এখন বুঝি, সুন্দরবনের কত ক্ষতি করেছি আমরা।’ বললাম, আর ক্ষতি করবেন না।
ফরিদের সেই হাসি মনে গেঁথে গেছে। মনে পড়ছে তার দস্যুজীবনের কথা। তখন তিনি সুঠাম-দেহী এক যুবক। হাতে বন্দুক, চোখ ছিল শীতল, নিষ্ঠুরতায় ভরা। বছরের পর বছর বনে কেটেছে দস্যুজীবন। সেই জীবনের কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। জীবন বাঁচাতে শুধু জেলেদের ওপর অত্যাচার করেনি তারা, সুন্দরবনের মতো একটি প্রাণবৈচিত্র্যপূর্ণ বনকেও করেছিল বিপদসংকুল। দিনের পর দিন তারা শিকার করেছে, সুন্দরবনের হরিণ আর পাখি হত্যা ছিল প্রতিদিনের ব্যাপার। শখে নয়, প্রতিদিনের খাবার জোগাড় করতে শিকার করত তারা। শুনেছি বাঘ শিকারিরাও তাদের সহযোগী ছিল। কখনও নিজেরাও বাঘ মেরেছে কারণে, অকারণে।
সাগরে গায়ে গা লাগিয়ে ভাসছে দুটি ট্রলার। হাত ধরে ফরিদ আমাকে নিয়ে গেলেন তাদের ট্রলারে। পাতিল থেকে একটু ঠান্ডা ভাত আর চিংড়ি ভুনা তুলে নিলেন। প্লেট বাড়িয়ে বললেন, একটু খান ভাই। খেতে বসলাম। সাবেক বনদস্যু ফরিদ বললেন, ‘আগে আমরা শুধু ক্ষতিই করেছি। এখন নিয়ম মেনে মাছ ধরি। সুন্দরবনের ক্ষতি করি না। আমাদের চারপাশে কাউকে বনের ক্ষতি করতে দেই না।’
সুন্দরবন এখন দস্যুমুক্ত। একসময় কমবেশি দেড় ডজন দস্যু দল দাপিয়ে বেড়াত বনে। তাদের ছত্রছায়ায় চলত বনের ওপর অত্যাচার। অবৈধ মাছ শিকারিদের দৌরাত্ম্য ছিল বনজুড়ে। বন্য প্রাণী শিকারিরাও ঘুরত বুক ফুলিয়ে। এ ছাড়া অভয়াশ্রমে মাছ শিকার, অবৈধ জালের ব্যবহার এবং বিষ দিয়ে মাছ শিকারের পৃষ্ঠপোষক ছিল এই দস্যুরা। এখন সময় বদলেছে। দস্যুতা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু বনের অন্য অপরাধগুলো চলছে এখনও। শিকার আর অবৈধ জায়গায় নিষিদ্ধ পদ্ধতিতে মাছ আহরণের তাণ্ডব চলছে এখনও। যার প্রভাবে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সুন্দরবন।
আত্মসমর্পণ করে বনদস্যু জীবন থেকে ফিরে আসা অনেকেই এখন বনজীবী। নিয়ম মেনে বন বিভাগ থেকে অনুমতি নিয়ে তারা মাছ-কাঁকড়া ধরে। মৌসুমে গোলপাতা আর মধু আহরণও করে কেউ কেউ। সুন্দরবনে ফিরে আসার ইচ্ছা না থাকলেও পেট চালাতে তারা সুন্দরবনে আসে। জেলে হিসেবে বনে এসে তারা অনুভব করে মাছ কমেছে, কাঁকড়াও আগের মতো পাওয়া যায় না। তারা অনুভব করে সুন্দরবনের ওপর অত্যাচার বন্ধ না হলে ভেঙে পড়বে এর বাস্তুসংস্থান। সবাই জানে সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান ভেঙে পড়লে বিপন্ন হবে সুন্দরবন। আর এই ম্যানগ্রোভ বন বিপর্যস্ত হলে টান পড়বে তাদের পেটে, বিপন্ন হবে উপকূলের বনজীবীদের জীবন। সাবেক দস্যুরা তাই একটু বেশি সতর্ক। নিজেরা আর সুন্দরবনের ক্ষতির কারণ হতে চায় না, কাউকে ক্ষতি করতে দিতেও চায় না। তাই মাছ ধরতে এলে তারা চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখে, যাতে বনের ক্ষতি, মাছের ক্ষতি কেউ না করতে পারে।
ফরিদ কিংবা কিবরিয়ার মতো সাবেক দস্যুদের অনেকেই সুন্দরবন রক্ষায় বাড়তি কাজ করতে চান। সাবেক দস্যুনেতাদের মধ্যে মাস্টার, জাহাঙ্গীর, নোয়া মিয়া কিংবা সাত্তার এখন সুন্দরবনের জেলে। বিভিন্ন দস্যু দলের সাবেক সদস্যদের অনেকেই মৎস্যজীবী। মৌসুম ভেদে তাদের কেউ মাছ ধরেন সুন্দরবনসংলগ্ন বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবনের খাল-নদীতে। একসময় নিজেরাও অপরাধ জীবনে থাকায় বনের অপরাধীদের গতিবিধি তারা ভালো বোঝেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তারা নিজেদের মতো করে চেষ্টা করেন। কিন্তু একজন সাধারণ বনজীবী কতটুকু করতে পারে? তারা চেষ্টা করে, কেউ বিষ দিয়ে মাছ শিকার করতে এলে সাহস করে তাড়া দেয়। এসব নিয়ে লোকালয়ে ফিরে চাপের মধ্যেও পড়তে হয়েছে কাউকে কাউকে। অনিয়মের প্রতিবাদ করায় সাবেক দস্যুনেতা মোস্তফা শেখ (সাবেক দস্যু দল মাস্টার বাহিনীর প্রধান) একবার কিছু অসাধু জেলের তোপের মুখে পড়েন। স্থানীয়ভাবে ছড়ানো হয় বিভ্রান্তি। সেই দস্যুনেতা মাস্টার আবারও দস্যুতায় নেমেছেন, এমন অপপ্রচার রটানো হয়। অবশ্য পরে বন বিভাগ বিষয়টি জানতে পারে, অসাধু জেলেদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। এমন অনেক ঘটনাই ঘটছে সুন্দরবনে।
সাবেক দস্যুদের কেউ কেউ আবার বন বিভাগ ও কোস্ট গার্ডকে সহযোগিতা করেন। সোর্স হিসেবে তারা বন অপরাধের খোঁজখবর দেন সংশ্লিষ্টদের। দুর্গম বনের খাল-উপখালগুলো ভালো করে চেনা বলে অপরাধীদের ধরিয়ে দিতে পারেন। সেজন্য অনেকে বলেন, দস্যুতা ছেড়ে ফিরে আসা সাবেক বনদস্যুদের বনরক্ষায় কাজে লাগানো হোক। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আমিও তাই মনে করি। তবে দস্যুজীবন থেকে জীবনে ফেরা এই মানুষদের অপরাধ দমনে ব্যবহারে ঝুঁকি আছে।
দস্যুমুক্ত হওয়ায় সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সুরক্ষিত। অন্যদিকে শক্ত আইন হয়েছে, বেড়েছে সংশ্লিষ্টদের তৎপরতা। বাঘ শিকার চলে এসেছে শূন্যের কোটায়। আগের চেয়ে কমলেও হরিণ শিকার চলছে। তবে নিষিদ্ধ এলাকায় অবৈধ পদ্ধতিতে মাছ-কাঁকড়া শিকারের প্রবণতা বেড়েছে। বন উপকূলের মানুষরাই এই ক্ষতি করছে। প্রান্তিক জেলেদের দিয়ে এই অপকর্ম করাচ্ছে কিছু অসাধু মহাজন। দাদন আর সুদের চক্রে দিশেহারা সুন্দরবনের প্রান্তিক জেলেরা। তাদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।
একটি কথা মাথায় রাখা উচিত, বন উপকূলের মানুষদের ক্ষুধার্ত রেখে সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা সম্ভব নয়। সেজন্য জেলেদের দাদন-সুদের চক্র থেকে বের করতে হবে। আহরিত মাছ-কাঁকড়ার বাজারমূল্য দিতে পারলে জেলেরা নিজেরাই গড়তে পারবে পুঁজি। পণ্যের বাজারমূল্য পেলে তাদের আর অতিরিক্ত মাছ শিকারের প্রয়োজন হবে না। নিজের পুঁজি গড়তে পারলে তারা বন অপরাধে জড়াবে না। তারপরও কিছু অপরাধী থাকবেই। তাদের দমনে বন বিভাগসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্বাভাবিক তৎপরতাই যথেষ্ট। এক্ষেত্রে সাধারণ জেলেরাও সহযোগিতা করবে। কারণ উপকূলের মানুষরা জানে এই সুন্দরবন তাদের খাবার জোগায়, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে তাদের রক্ষা করে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক