প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১২:৩৬ পিএম
আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০২৩ ১২:৫৭ পিএম
কুখ্যাত ইন দিন গণহত্যায় মিয়ানমারে তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করে জান্তা বাহিনী। ইন দিনে ১০ জন রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়। সংগৃহীত ফটো
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দেশটির জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য যে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র তৈরি করছে, তার নেপথ্যে রয়েছে ১৩টি দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানগুলো অস্ত্র তৈরির কাঁচামাল সরবরাহ করছে মিয়ানমারকে। এ দাবি করেছেন জাতিসংঘের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তারা।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সাবেক বিশেষ প্রতিবেদক ইয়াংহি লি, ক্রিস সিডোতি এবং মারজুকি দারুসমান সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন, যেখানে তারা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কর্তৃক গণহত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রের উৎসের খোঁজ দিয়েছেন।
কয়েক দশক ধরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছে; কিন্তু তারা অস্ত্র উৎপাদন বন্ধ করেনি। বরং অস্ত্র তৈরির কারখানার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ১৯৮৮ সালে প্রায় ছয়টি কারখানা ছিল, সেখানে এখন সেটির সংখ্যা ২৫টির মতো।
মিয়ানমারকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ভারত এবং জাপানের বিভিন্ন কোম্পানি মিয়ানমারের সামরিক সহায়তায় রয়েছে বলে সাম্প্রতিক ওই প্রতিবেদনে জানা গেছে।
ইয়াংহি লি ব্যাখ্যায় বলেছেন, মিয়ানমার কখনই অস্ত্র রপ্তানি করে না। ১৯৫০ সাল থেকে দেশটি অস্ত্র তৈরি করেছে নিজের জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সাম্প্রতিকতম অভ্যুত্থানের পর থেকে সামরিক বাহিনীর হাতে এ পর্যন্ত ২,৬০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। তবে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা ১০ গুণ বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিবিসির বার্মিজ সার্ভিসের প্রধান সো উইন টান বলেছেন, যখন গণতন্ত্রপন্থিদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়েছিল, তখন মনে করা হয়েছিল, সামরিক সরকারবিরোধী আন্দোলনগুলোকে নস্যাৎ করতে পারবে। কিন্তু সাম্প্রতিক মাস এবং সপ্তাহগুলোতে জোয়ার কিছুটা ঘুরে গেছে। সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে জান্তাবিরোধীদের যে অভাব রয়েছে, তা হলো বিমান শক্তি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন মিয়ানমারকে স্নাইপার রাইফেল, বিমানবিধ্বংসী বন্দুক, ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার, গ্রেনেড, বোমা এবং ল্যান্ডমাইনসহ অন্যান্য অস্ত্র তৈরিতে বাধার মুখে ফেলতে পারেনি। যারা সেনাশাসনের বিরোধিতা করছে, তাদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা চালাতে স্বদেশে উৎপাদিত অস্ত্রই ব্যবহার করছে মিয়ানমার।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে সহিংসতা চলছে। দেশটির গণতন্ত্রপন্থি অভ্যুত্থানবিরোধীরা নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা সামরিক শাসন প্রতিরোধে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগ দিয়েছে। মিয়ানমারে সহিংসতাবিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা পরিষদ উল্লেখ করেছে যে, জাতিসংঘের বেশ কয়েকটি সদস্য রাষ্ট্র সামরিক বাহিনীর কাছে অস্ত্র বিক্রি অব্যাহত রেখেছে।
ওই বিশেষ উপদেষ্টা পরিষদ বলেছে, বিভিন্ন দেশ ও কোম্পানি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে কাঁচামাল, প্রশিক্ষণ এবং মেশিন সরবরাহ করছে। কিন্তু এর দ্বারা উৎপাদিত অস্ত্রগুলো সীমান্ত রক্ষায় ব্যবহৃত হয় না মিয়ানমারে। দেশটির সশস্ত্র বাহিনী এসব বেসামরিক লক্ষ্যবস্তু ধ্বংসে ব্যবহার করছে।
জাতিসংঘের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তারা দেশটির সাবেক সেনাদের সাক্ষাৎকার এবং কারখানার স্যাটেলাইট চিত্রসহ বেশকিছু সামরিক নথি ফাঁস করেছে। ২০১৭ সালে তোলা ওই ছবিগুলো প্রমাণ করে যে, অভ্যুত্থানের আগে দেশে তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করা হতো। ইন দিন গণহত্যার সময় সেনাদের মেড ইন মিয়ানমার রাইফেল বহন করতে দেখা যায়। ওই অভিযানে মিয়ানমারের সেনারা ১০ জন নিরস্ত্র রোহিঙ্গা পুরুষকে হত্যা করেছিল।
ক্রিস সিডোতি ব্যাখ্যায় বলেন, অতিসম্প্রতি সাগাইং অঞ্চলে গণহত্যা হয়েছে। বিশেষ করে একটি স্কুলে বোমা হামলা এবং গোলাবর্ষণের ঘটনা এখানে উল্লেখযোগ্য। ওই হামলার ফলে অনেক শিশু এবং বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছিল। হামলাস্থলে পাওয়া সামরিক আর্টিলারি গোলার খোসাগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, এগুলো মিয়ানমারের নিজস্ব উৎপাদন প্ল্যান্ট থেকে আসা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে-- নিজ ভূখণ্ডে অস্ত্র তৈরি করলেও কাঁচামাল কোথা থেকে পাচ্ছে মিয়ানমার। এর উত্তরও রয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
জাতিসংঘের বিশেষ উপদেষ্টা পরিষদ বলছে, বন্দুকের ব্যারেল তৈরি করতে এবং অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত কিছু সরঞ্জাম অস্ট্রিয়া থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অস্ট্রিয়ান সরবরাহকারী কোম্পানি জিএফএম স্টেয়ার দ্বারা তৈরি উচ্চ-নির্ভুল অস্ত্রগুলো বিভিন্ন হামলায় ব্যবহার করা হচ্ছে। যখন অস্ত্রগুলোর মেরামতের প্রয়োজন হয়, তখন সেগুলো তাইওয়ানে পাঠানো হয়। যেখানে জিএফএম স্টেয়ার প্রযুক্তিবিদরা তাইপেতে বসেই সেসব অস্ত্র মেরামত করে ফের মিয়ানমারে প্রেরণ করেন। তবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ওই অস্ট্রিয়ান প্রতিষ্ঠানটির টেকনিশিয়ানরা এটা জানেন কি না তা নিশ্চিত নয় যে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে যে এই অস্ত্রগুলো ব্যবহার করা হবে। কারণ এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে জিএফএম স্টেয়ার কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
প্রতিবেদনের লেখকরা স্বীকার করেছেন যে, তারা অস্ত্র উৎপাদন নেটওয়ার্কের একটি ভগ্নাংশ উন্মোচন করেছেন, তবে বেশ কয়েকটি দেশ জড়িত বলে মনে করা হয়।
ওই প্রতিবেদন মোতাবেক চীন থেকে কাঁচামাল মিয়ানমারে অস্ত্র উৎপাদনের জন্য পাঠানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে তামা এবং লোহার জোগানদাতা চীন এবং সিঙ্গাপুর। ফিউজ এবং বৈদ্যুতিক ডেটোনেটরের মতো মূল উপাদানগুলো মিয়ানমার পাচ্ছে ভারত এবং রাশিয়ার কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে। মিয়ানমারের অস্ত্র কারখানার যন্ত্রপাতি আসছে জার্মানি, জাপান, ইউক্রেন এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে। মেশিনগুলোকে কার্যকর করার সফটওয়্যার দিচ্ছে ইসরায়েল এবং ফ্রান্স। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, পুরো প্রক্রিয়ায় ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে কাজ করছে সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠানগুলো মিয়ানমারের সামরিক ক্রেতা এবং বহিরাগত সরবরাহকারীদের মধ্যস্থতার কাজ করছে।
ক্রিস সিডোতি বলেছেন, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাগুলো ব্যর্থ হয়েছে। এর কারণ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ দ্বারা করা হয়নি, বরং শুধু পৃথক রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের গোষ্ঠী দ্বারা করা হয়েছে। সুতরাং অনেক কোম্পানির জন্য নিষেধাজ্ঞাগুলো এড়ানো তুলনামূলকভাবে সহজ হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি এমন দেশগুলোর কোম্পানির কাছ থেকে প্রাপ্ত কাঁচামালের মাধ্যমে তারা অস্ত্র তৈরি করেই চলেছে।
লন্ডনের লফবরো ইউনিভার্সিটির ডক্টরাল লেকচারার রোনান লি বলেছেন, মিয়ানমারে সাধারণ মানুষের জীবন অবিশ্বাস্যভাবে কঠিন। মিয়ানমারকে একটি কার্যকর দেশ হিসেবে দেখা যাচ্ছে না এবং আমি মনে করি, এটি পতনের কাছাকাছি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, যারা মিয়ানমারের জনগণের কথা চিন্তা করে, তাদের এখন সুযোগ এসেছে সামরিক বাহিনীকে বলার যে, তারা বেসামরিক মানুষের বিরুদ্ধে যে অস্ত্র ব্যবহার করতে চলেছে, তা তারা চালিয়ে যেতে পারবে না। সূত্র : বিবিসি।