আদানি গ্রুপের কর্ণধার গৌতম আদানি। ছবি: সংগৃহীত
তিন দশকের বেশি সময়ে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে আদানি গ্রুপের সাম্রাজ্য। গ্রুপটির কর্ণধার গৌতম আদানির সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠতা সবার জানা। গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিনডেনবার্গ রিচার্সের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে আদানি গ্রুপ। এ অবস্থায় বিরোধীদের পাশাপাশি ভারতের সাধারণ মানুষও গ্রুপটির কর্মকাণ্ড, তাদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
হিনডেনবার্গের অভিযোগ
আদানি গ্রুপ যে মূলধন দেখাচ্ছে, তাদের প্রকৃত মূলধন তার চেয়ে অনেক কম। কোম্পানিটি রাজনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠানের থেকে বিপুল ঋণ করেছে, যা যথাযথ প্রক্রিয়ায় করা হয়নি। তা ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারবাজারভুক্ত সাতটি কোম্পানির হিসাব স্বচ্ছ নয়। অর্থাৎ বড় অঙ্কের ঋণের বোঝা নিয়ে বড় ধরনের সংকটে রয়েছে আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো।
অভিযোগের ফল
হিনডেনবার্গের প্রতিবেদন প্রকাশের পর বুধবার থেকে আদানি গ্রুপের শেয়ারবাজারভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম কমতে শুরু করে। সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে আদানি গ্রুপ ঋণ নিয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানেরও দরপতন হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার শেয়ারবাজার বন্ধ ছিল। শুক্রবার বাজার চালু হলে ওই দরপতনের ধারা অব্যাহত থাকে।
আদানি গ্রুপের সাতটি তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে আদানি ট্রান্সমিশন, আদানি টোটাল গ্যাস এবং আদানি গ্রিন এনার্জির শেয়ারের দাম গত শুক্রবার ২০ শতাংশ কমেছে। আদানি এন্টারপ্রাইজের শেয়ারের দাম কমেছে সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হিনডেনবার্গের প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর গতকাল শনিবার পর্যন্ত আদানি গ্রুপের সাতটি তালিকাভুক্ত কোম্পানির বাজার মূলধন কমেছে ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিবিসির প্রতিবেদনে।
আদানি গ্রুপের প্রতিক্রিয়া
হিনডেনবার্গের প্রতিবেদন প্রকাশের পর বুধবার আদানি গ্রুপের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা জুগেসিন্দর সিং বলেন, ‘হিনডেনবার্গের প্রতিবেদনে আমরা স্তব্ধ। এই প্রতিবেদনের কোনো ভিত্তি নেই। সামগ্রিক বিষয় হিসাবে না নিয়ে তারা একপেশে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে।’
গত বৃহস্পতিবার গৌতম আদানির মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠান জানায়, তারা হিনডেনবার্গের বিরুদ্ধে কীভাবে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া যায় তা ভাবছে। এর প্রতিক্রিয়ায় হিনডেনবার্গ রিসার্চ জানায়, তাদের প্রতিবেদন সত্য। তাদের বিশ্বাস, যেকোনো ধরনের আইনি পদক্ষেপ ভিত্তিহীন হবে।
তদন্তের দাবি কংগ্রেসের
ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস গত শুক্রবার এক বিবৃতিতে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে দেশটির সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহ্বান জানায়। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আদানি গ্রুপ ও বর্তমান সরকারের সম্পর্ক সবার জানা। আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে তা গুরুতর। তা খতিয়ে দেখতে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (এসইবিআই) এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে (আরবিআই) আহ্বান জানাচ্ছে ভারতের কংগ্রেস পার্টি।’
গতকাল রবিবার কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট মল্লিকার্জুন খাড়গে এক টুইটে লেখেন, আদানি গ্রুপ নিয়ে গুরুতর অভিযোগ ওঠার পরও সরকার নীবর কেন? কাজের কাজ না করে দিকপ্রান্ত হয়ে মোদি সরকার আবোল-তাবোল বকছে।
সাধারণের উদ্বেগ
গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকা থেকেই নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আদানি গ্রুপের কর্তাব্যক্তি গৌতম আদানির বন্ধুত্ব। গুজরাট মডেলেই ভারতের ভাগ্য বদলে দেওয়ার স্লোগান দিয়ে ২০১৪ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাদের মধ্যে মোদি ও আদানির বন্ধুত্ব আরও ঘনিষ্ঠ হয়।
ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো প্রধানমন্ত্রী বা রাজনৈতিক দল এবং বড় ব্যবসায়ী বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক নতুন কিছু নয়। আদানি গ্রুপ নিয়ে ভারতের সাধারণ মানুষের উদ্বেগের কারণও সেটা নয়। কারণটা অন্যত্র।
আজ সাধারণ ভারতীয়দের প্রশ্ন, আদানি গ্রুপ যতগুলো রাস্তা নির্মাণের টেন্ডার পেয়েছে, তারা কি তা শেষ করতে পারবে? ভারতের নদীবন্দরগুলো আধুনিকায়নের সক্ষমতা কি তাদের রয়েছে? তারা কি ভারতের বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে? ভারতের অধিকাংশ মানুষের ধারণা, এসব বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা আদানি গ্রুপের নেই।
আদানি গ্রুপের সক্ষমতা না থাকাটা যতটা না তাদের পুঁজিগত সমস্যা, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। এ সমস্যার দুইটা দিক রয়েছে। একদিকে, ভারতের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সীমাহীন অদক্ষতা। অন্যদিকে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ।
কারণ কোনো বেসরকরি প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য যে পরিমাণ অবকাঠামোগত সুবিধার দরকার, তা ভারতে নেই। অন্যদিকে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে নজরদারি করার মতো সেসব সরকারি প্রতিষ্ঠান থাকা লাগে তা মোদির ভারতে নেই।
এ অবস্থায় আদানি গ্রুপ যেভাবে ফুলেফেঁপে বড় হয়েছে, তাতে গ্রুপটির পতন অনিবার্য। কিন্তু গ্রুপটির যে পতন হতে পারে তা বিশ্বাস করেন স্বয়ং গৌতম আদানি। কারণ তারা ভারত ও নিজে কোম্পানিকে এক করে ফেলেছে। তারা মনে করে, আদানি গ্রুপের উন্নতি মানে ভারতের উন্নতি। আর আদানি গ্রুপ ব্যর্থ হওয়া মানে ভারত ব্যর্থ হওয়া। এ ধরনের মানসিকতা ও উন্নয়ন মডেল ভারতের সাধারণ মানুষের জন্য সত্যিই সীমাহীন উদ্বেগের।
ব্লুমবার্গ বিলিয়নেয়ার্স ইনডেক্স অনুসারে, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এশিয়ার শীর্ষ ধনী গৌতম আদানি, যার ব্যক্তিগত সম্পদ ১১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। যা আরেক ভারতীয় উদ্যোক্তা মুকেশ আম্বানির চেয়ে তিন হাজার কোটি ডলার বেশি। তবে দরপতন অব্যাহত থাকায় এশিয়ার শীর্ষ ধনীর মুকুট শিগগির হারাতে পারেন গৌতম আদানি।
সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি
প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু
রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯
যোগাযোগ
প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]
বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]
বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯, +৮৮০১৮১৫৫৫২৯৯৭ । ই-মেইল: [email protected]
সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]
2023 Protidiner Bangladesh All Rights Reserved. Developed By Protidiner Bangladesh Team.