মুহাম্মদ তাসনিম আলম
প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৪ ১৫:২১ পিএম
আপডেট : ০১ জানুয়ারি ২০২৪ ১৭:৩৩ পিএম
জন পিলজার। ছবি : সংগৃহীত
অস্ট্রেলিয়ান বংশোদ্ভূত লন্ডনপ্রবাসী সাংবাদিক জন পিলজার শনিবার ৮৪ বছর বয়সে মারা গেছেন। ১৯৭০ এর ঘূর্ণিঝড়, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে তিনি ধারাবাহিক প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে তার তৈরি তথ্যচিত্র ‘অ্যান আনফ্যাশনেবল ট্র্যাজেডি’ সারা দুনিয়ায় তোলপাড় তৈরি করেছিল।
লেখক, গবেষক, সাংবাদিক ও তথ্যচিত্র নির্মাণকারী হিসেবে ১৯৬০ ও ৭০ এর দশকে সারা বিশ্বে পিলজারের পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধ, কম্বোডিয়ার স্বৈরশাসন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর ও বায়াফ্রা নিয়ে প্রতিবেদন ও তথ্যচিত্র তৈরিই ছিল তার পরিচিতির মূল কারণ।
কর্মজীবনে রয়টার্স ও যুক্তরাজ্যের ডেইলি মিররসহ বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা ও সংবাদমাধ্যম এবং টেলিভিশন নেটওয়ার্কে কাজ করেছেন পিলজার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ডেইলি মিররের প্রথম পাতায় ‘ডেথ অব আ নেশন’ নামে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন লিখেছিলেন তিনি।
মূলত কলকাতা থেকেই এসব প্রতিবেদন লিখতেন পিলজার। তবে সময় পেলেই শরণার্থী শিবিরে যেতেন। যুদ্ধচলাকালে তিনি কয়েকবার বাংলাদেশেও প্রবেশ করেছেন বলে শোনা যায়।
তার প্রতিবেদন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল।
১৯৭০ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় নিয়ে পিলজারের তৈরি প্রতিবেদনের মূল কথা ছিল, যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা পাকিস্তানের জেনারেলদের বিরক্ত করতে চায় না। তাই পূর্বপাকিস্তানে ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০ লাখ মানুষ নিহত হলেও তা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। পাকিস্তান সরকারের উপহাসমূলক ত্রাণ নিয়ে কারও কোনো প্রতিবাদ নেই।
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে তৈরি প্রায় ২৮ মিনিটের তথ্যচিত্র অ্যান আনফ্যাশনেবল ট্র্যাজেডিতে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মহল কীভাবে সংশ্লিষ্ট তা তুলে ধরা হয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের ত্রাণ বরাদ্দ নীতিকে অত্যন্ত অমানবিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ বিষয়ক তথ্যচিত্র আনফ্যাশনেবল ট্র্যাজেডি থেকে নেওয়া।
তথ্যচিত্রটিতে পিলজার তার নিজের এক্সপেন্ড্যাবিলিটি বা মরণ/ব্যয়যোগ্যতা তত্ত্ব প্রথমবারের মতো ব্যাখ্যা করেন। এক্সপেন্ড্যাবিলিটি বলতে পিলজার বোঝাতেন, তেল, গ্যাস বা অন্য প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকা, অথবা ভূরাজনৈতিক, সামরিক গুরুত্ব না থাকার কারণে বাংলাদেশের মতো দেশকে অগুরুত্বপূর্ণ মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। তাই এসব দেশে দুর্ভিক্ষ চললে তারা নিজেদের বাড়তি খাবার পাঠায় না। চক্ষুলজ্জার খাতিরে পাঠালেও তা অতিসামান্য।
আনফ্যাশনেবল ট্র্যাজেডি তৈরি করা হয়েছিল যুক্তরাজ্যের এটিভি নেটওয়ার্কের জন্য। ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি এটি সম্প্রচার করা হয়। সম্প্রচার থেকে পাওয়া প্রায় ৩০ হাজার পাউন্ড বাংলাদেশে সহায়তা হিসেবে পাঠানো হয়েছিল।
কম্বোডিয়ার স্বৈরশাসক পোল প্লট ও খেমার রুজের শাসনামল নিয়ে ১৯৭৯ সালে ‘ইয়ার জিরো : দ্য সাইলেন্ট ডেথ অব কম্বোডিয়া’ তৈরি করেছিলেন পিলজার। তার এ কাজটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়েও তার অনেক কাজ রয়েছে। আমৃত্যু অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন কিংবদন্তি এ সাংবাদিক।
১৯৩৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের বন্ডিতে জন্মগ্রহণকারী পিলজার ১৯৬০ সালে স্থায়ীভাবে যুক্তরাজ্যে চলে যান।
১৯৯০ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, যুদ্ধে হতাহতদের করুণ অবস্থা আমাকে টানে। তারা বিকল্পভাবে যেভাবে বাঁচতে চেষ্টা করে তা আমাকে ভাবায়।
সাংবাদিকতা সম্পর্কে পিলজার মনে করতেন, মানবিকতা নিয়ে যদি কিছু করা না যায়, তাহলে সাংবাদিকতার কোনো মূল্য নেই। আমার কাছে মানুষের জীবন গুরুত্বপূর্ণ।
২০১৯ সালে ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পিলজার বলেছিলেন, প্রকৃত সাংবাদিকরা সরকার বা ক্ষমতার নয়, বরং জনগণের এজেন্ট বা শক্তি হিসেবে কাজ করে।
শনিবার লন্ডনে মারা যাওয়ার পর এক বিবৃতিতে পিলজারের পরিবার জানায়, তার সাংবাদিকতা ও তথ্যচিত্র বিশ্বজুড়ে নন্দিত। তবে পরিবারের কাছে তিনি ছিলেন একজন প্রিয় বাবা, দাদা এবং সঙ্গী। আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন জন পিলজার। তথ্যচিত্রের জন্য পেয়েছেন আমেরিকান টেলিভিশন একাডেমি অ্যাওয়ার্ড, এমি অ্যাওয়ার্ড, ব্রিটিশ একাডেমি অ্যাওয়ার্ড। তার ইয়ার জিরো : দ্য সাইলেন্ট ডেথ অব কম্বোডিয়াকে ২০ শতকের শীর্ষ ১০টি তথ্যচিত্রের একটি বলে স্বীকৃতি দিয়েছে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট।
পিলজারের বিখ্যাত বইগুলোর মধ্যে হিরোস, আ সিক্রেট কান্ট্রি, আ নিউ রুলার অব দ্য ওয়ার্ল্ড এবং হিডেন এজেন্ড অন্যতম।
সূত্র : বিবিসি, গার্ডিয়ান, জনপিলগারডটকম