ফসিহ উদ্দীন মাহতাব
প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ ১৬:৩৮ পিএম
আপডেট : ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ ১৭:০৫ পিএম
সাগর পথে মানব পাচারের কথা প্রায় শিরোনাম হচ্ছে সংবাদ মাধ্যমে। ফাইল ফটো
কানাডায় আকর্ষণীয় বেতনে চাকরির গল্প শুনিয়েছিল মানব পাচারকারীরা। এভাবে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার উচ্চাঙ্গা গ্রামের কয়েকজনের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছিল লাখ লাখ টাকা। ২০১৭ সালে জনপ্রতি ১৯ লাখ টাকায় বিদেশে যাওয়ার জন্য তাদের সঙ্গে একে একে চুক্তিবদ্ধ হন উচ্চাঙ্গা গ্রামের রাজেন্দ্র চন্দ্র রায়, হারাধন পাল, সমীর পাল ও মনোরঞ্জন দাস। চুক্তির শর্তানুযায়ী প্রত্যেকে অগ্রিম ৪ লাখ টাকা করে দেন পাচারকারীদের।
কানাডায় পাঠাতে ভারত থেকে ভিসা ইস্যু করা হবে- এমন আশ্বাস দিয়ে বিদেশে যেতে ইচ্ছুক সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতে। কিন্তু ভিসা না করেই তাদের পুনরায় নিয়ে আসা হয় ঢাকায়। এরপর বছর পেরিয়ে গেলেও তারা আর কানাডায় যেতে পারেননি। পরে ২০২১ সালের ১৫ মার্চ রাজধানীর রমনা থানায় মানব পাচার আইনের ৬, ১১ ও ১৪ ধারায় তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন রাজেন্দ্র। পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও মামলা করা হয়।
তদন্ত শেষে সম্প্রতি পুলিশ তিনজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করে। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে গত ১১ জানুয়ারি মামলাটি খারিজ করে দেন ঢাকা বিভাগীয় মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল।
মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো গুরুতর, চাঞ্চল্যকর ও অজামিনযোগ্য হলেও নানা ত্রুটি, দুর্বল তদন্ত ও যথাযথ সাক্ষী উপস্থিত না করায় অধিকাংশ আসামিই জামিন পেয়ে যাচ্ছে।
মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি কে এম সাজ্জাদুল হক শিহাব এ মামলায় জামিন পাওয়ার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, মামলাটি ভুলভাবে করায় গুরুতর অপরাধ হলেও সেটি মানব পাচার আইনের আওতায় আসেনি। তাই বিচারক মামলাটি খারিজ করে দিয়েছেন। কারণ মামলায় মানব পাচারের পরিবর্তে প্রতারণার কথা বলা হয়েছিল।
তিনি মন্তব্য করেন, মামলাটি বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসন আইনে করা উচিত ছিল। সেটি না করে মামলা হয়েছে অন্যভাবে।
মানব পাচার আইনে মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার জন্য সাতটি বিভাগীয় শহরে সরকার মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছিল। সারা দেশে রয়েছে ৫ হাজার ৯৭০টি (তদন্তাধীনসহ) মানব পাচার অপরাধ সংক্রান্ত মামলা। এর মধ্যে পুলিশি তদন্ত শেষে বিচারের জন্য বিভিন্ন আদালতে এসেছে ৫ হাজার ৭৭টি। এ মামলায় এ পর্যন্ত ১১ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়েছে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছে ৩০৬ জন। বিভিন্ন মেয়াদে ৮৬ জনের সাজা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ আসামিই পলাতক রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে বেসরকারি একটি সংস্থার দেওয়া তথ্য প্রতিবেদন মতে, মানব পাচার আইনে করা যেসব মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর ৯৬ শতাংশই আদালতে বিচারাধীন। এসব মামলা নিষ্পত্তির হার মাত্র ৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আর বিচার শেষে দেখা গেছে, ১৫ শতাংশ মামলায় আসামির সাজা হয়েছে, বাকি ৮৫ শতাংশ মামলা থেকে খালাস পেয়েছে।
খালাস দেওয়া একাধিক মামলার রায়ে আদালত উল্লেখ করেছেন, সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে ব্যর্থতার কারণে একটি ফৌজদারি মামলা বছরের পর বছর বিচারাধীন থাকা আইনগত সিদ্ধ নয়। মামলার বিচারে দেরি করাও ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। আবার উপযুক্ত ক্ষেত্রে আসামিদের খালাস দেওয়া ন্যায়বিচার ও যুক্তিযুক্ত।
সংস্থাটির তথ্যমতে, বিভিন্ন আদালতে মানব পাচারের অধিকাংশ মামলার বিচার কার্যক্রম চলছে ধীরগতিতে। মামলার উপাদান, সাক্ষ্য ও তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করতে না পারায় তদন্ত কর্মকর্তারা যথাসময়ে তদন্ত শেষ করতে পারছেন না। মানব পাচার আইনে করা মামলায় ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে অভিযোগ গঠন এবং ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে বিচার শেষ করার বিধান রয়েছে। কিন্তু তদন্ত ধীর হওয়ায় নির্দিষ্ট সময়ে বিচার সম্ভব হচ্ছে না; ঝুলে থাকছে মামলার কার্যক্রম।
অধিকাংশ বাংলাদেশিই পাচার হয়ে থাকেন ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, গ্রিস, ইতালি, সাইপ্রাস, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, ইরাক, বাহরাইন ও লিবিয়ায়। এসব দেশে কাজের জন্য গিয়ে বিপদে পড়ছেন রেমিট্যান্সযোদ্ধারা।
একটি প্রতিবেদন মতে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মানব পাচারের মামলা হয়েছে ৭ হাজার ২৩৩টি। সেগুলোর মধ্যে বিভিন্ন আদালতে ৩৬৮টির নিষ্পত্তি হয়েছে আর বিচারাধীন রয়েছে ৫ হাজার ৯৭০টি। এ ধরনের মামলায় কারোর কঠোর সাজা হওয়ার নজির খুবই কম। মানব পাচারের অপরাধে নজির নেই কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকের সাজা হওয়ার।
২০২০ সালের মার্চ মাসে স্থাপন করা হয় ঢাকা বিভাগীয় মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল। বর্তমানে এখানে নতুন-পুরোনো ৯৩৪টি মামলা বিচারাধীন। প্রতিবছর এ ট্রাইব্যুনালে করা হয় ৩০০ থেকে ৪০০ মামলা। ২০২২ সালে নিষ্পত্তি হয়েছে ৬৪৮টি মামলা। এর মধ্যে ১১টি মামলায় যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে, কিন্তু কোনো মৃত্যুদণ্ডাদেশ নেই।
এছাড়া অর্থদণ্ড সাজাসহ বিভিন্নভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে আরও ৯৩টি মামলা। সাক্ষীদের অনুপস্থিতির কারণে বাকি পাঁচ শতাধিক মামলার আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালে ৪০৮টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি মামলায় সাজা হয়েছে। খালাস পেয়েছে ৩৫৩ মামলার আসামি। ২০২০ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নিষ্পত্তি হওয়া ৩৯টি মামলার মধ্যে কোনো আসামির সাজা হয়নি। সবাই খালাস পেয়েছে। এই ট্রাইব্যুনালে ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের পুরোনো মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
ঢাকা বিভাগীয় মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর সাজ্জাদুল হক শিহাব বলেন, অনেক মামলারই নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে সাজার পরিমাণ কম। মামলা বিলম্বে নিষ্পত্তি হওয়ার প্রধান কারণ যথাসময়ে আদালতে সাক্ষী না আসা। মামলার বাদী ও সাক্ষীর ঠিকানাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের মোবাইল বন্ধ থাকে। তদন্ত প্রতিবেদনেও অনেক ত্রুটি থাকে।
তিনি বলেন, অনেক মামলায় সাক্ষীরা আদালতে এসে আপসের কথা বলেন। আবার অনেকে এসে আসামির পক্ষে সাক্ষী দেন। দীর্ঘদিন সাক্ষীর অভাবে অনেক মামলা নিষ্পত্তি হয়ে যায় এবং আসামিরাও খালাস পেয়ে যায়। সন্দেহাতীতভাবে অপরাধ প্রমাণিত না হলে কোনো আসামির সাজা হয় না। এতে নষ্ট হয় রাষ্ট্রের অর্থ, আদালতের সময়।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, মানব পাচারের মামলার ফলাফল খুবই হতাশাব্যঞ্জক। সাক্ষী সুরক্ষা আইন না থাকায় মামলার সাক্ষীরা আদালতে যেতে ভয় পান। বাদীকে বিবাদীপক্ষের লোকজন প্রভাব ও ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থের মাধ্যমে আপস-মীমাংসা করে ফেলে।
তিনি বলেন, পুলিশ কেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে পারে না, সেটা জানতে সরকারকে ‘নিরপেক্ষ তদন্ত সেল’ গঠন করতে হবে। সাক্ষীকে আনার লক্ষ্যে রাষ্ট্রকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে ঘটনার ভিডিও ফুটেজ যুক্ত করে মামলার তদন্ত শেষ করতে হবে।