শহিদুল ইসলাম রাজী
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৩ ০৯:৫১ এএম
আপডেট : ২১ আগস্ট ২০২৩ ০৯:৫২ এএম
ফাইল ফটো
নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে মোটরসাইকেলে বাসায় ফিরছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক ওমর সানি। তার সঙ্গে ছিলেন রাব্বী শেখ নামে এক আত্মীয়। মোটরসাইকেলটি শান্তিনগর বটতলায় পৌঁছার পর সাদাপোশাকে পুলিশ পরিচয় দিয়ে তাদের গতিরোধ করা হয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের ধরে নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন সানির স্বজনরা।
গত শনিবার রাত পৌনে ১১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। সারা রাত আটক রেখে গতকাল রবিবার দুপুরে যাত্রাবাড়ী থানার পুরোনো একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাদের আদালতে পাঠিয়েছে পুলিশ। ওই রাতে বিএনপি কার্যালয় থেকে অন্তত ১৫ জন নেতাকর্মীকে সাদাপোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে দলটির পক্ষ থেকে। তবে গোয়েন্দা পুলিশের ওয়ারী বিভাগ গতকাল ১১ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায়।
এর আগে গত শুক্রবার রাজধানীর আজিমপুর থেকে ছাত্রদলের ৬ নেতাকে সাদাপোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। তারা হলেনÑ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সহসভাপতি হাসানুর রহমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক জহির উদ্দিন বাবর, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সহসাংগঠনিক সম্পাদক শাহাদাত হোসেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা আরিফ বিল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ. এফ. রহমান হল ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক শরীফুল ইসলাম শাবীব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক এবং অমর একুশে হল ছাত্রদলের সভাপতি আব্দুল্লা আল রিয়াদ।
পুলিশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য না পাওয়ায় শনিবার সারা দিন তাদের নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় ছিলেন বিএনপি নেতাকর্মী ও স্বজনরা। অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দেয়। শেষ পর্যন্ত গতকাল ৬ জনের খোঁজ মিলেছে। তাদের গ্রেপ্তারের বিষয়টি স্বীকার করে গতকাল সংবাদ সম্মেলন করেছে পুলিশ।
ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম পুলিশ কমিশনার খোন্দকার নুরুন্নবী বলেন, ডিবির লালবাগ বিভাগের একটি টিম বিশেষ অভিযান চালিয়ে লালবাগ এলাকার একটি বাসা থেকে ওই ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৩টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও ৩৬ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। তিনি আরও বলেন, গ্রেপ্তার নেতারা বিএনপির শীর্ষনেতাদের নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শক্তি বৃদ্ধি করতে ছাত্রদলের অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়া করতে চেয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি এবং আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন।
এদিকে বিভিন্ন সূত্রে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে যে রাজধানী ও দেশের অন্যান্য স্থান থেকে বিএনপিসহ বিরোধীমতের নেতাকর্মীদের আটক ও গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। ফলে রাজপথের প্রধান এই বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে এখন ‘সাদাপোশাকের পুলিশ আতঙ্ক’ বিরাজ করছে। বিএনপির দাবি, গত ২৮ জুলাইয়ের পর থেকে এ যাবৎ বিএনপির ৬ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন মামলায় আসামি করা হচ্ছে তাদের কর্মীদের। গ্রেপ্তারও হচ্ছেন অনেকে। কোথাও কোথাও পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর ঘটনা ঘটছে। যারা জামিনে ছিলেন তারাও আবার গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কা করছেন। অনেকের বাসায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব অভিযান চালানো হচ্ছে রাতের বেলায়। গ্রেপ্তার আতঙ্কে অনেক নেতাকর্মী বর্তমানে ঘরবাড়ি কিংবা এলাকাছাড়া।
জানা গেছে, গত শনিবার রাতে নয়াপল্টন এলাকা থেকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব তানভীর আহমেদসহ ১৫ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সূত্রমতে, সরকার পতনের দাবিতে চলমান এক দফার আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে বিএনপির বহু নেতাকর্মীকে সাদাপোশাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যদিও পরে তাদের বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি নেতাদের দাবি, বিএনপি কোনো নিষিদ্ধ দল নয়। আন্দোলন কর্মসূচি দিয়েই তাদের নেতাকর্মীরা রাজপথে রয়েছেন। তাহলে তাদের গ্রেপ্তারে সাদাপোশাকের পুলিশ লাগবে কেন? পোশাক পরা পুলিশ সদস্যরা তাদের পরিচয় এবং সংস্থার নাম বললে পরিবারের সদস্যরা অন্তত একটু চিন্তামুক্ত থাকতে পারেন। সাদাপোশাকে তুলে নেওয়ার পর তাদের অবস্থান জানতে না পেরে একেকটি পরিবার দিশাহারা হয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে হয়রানির শিকার হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন গতকাল প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, এ ধরনের অভিযোগ সঠিক নয়। কোনো ব্যক্তিকে আটকের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই আদালতে হাজির করা হয়। এখানে আইনের ব্যত্যয় হওয়ার সুযোগ নেই। সারা দেশেই পুলিশ অত্যন্ত পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করছে।
পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গণগ্রেপ্তারের কোনো নির্দেশনা নাই। কাউকে হুটহাট গ্রেপ্তার না করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ নেওয়া হয়েছে। সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার পরেই কেবল গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এখানে বিভিন্ন সংঘর্ষের ঘটনায় সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে তা খতিয়ে দেখা হয়েছে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যারা সক্রিয় রয়েছেন তাদের শনাক্তে কাজ করছে পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগ।
বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে জানানো হয়, ২৮ জুলাইয়ের পর থেকে সারা দেশে বিএনপির প্রায় ৭০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, শনিবার বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচির আগে ও পরে ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা, নাটোর থেকে অন্তত ১০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি মন্তব্য করেন, নতুন করে নয়, আগে থেকেই তাদের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করছে সরকার। এটা সরকারের একটি ধারাবাহিক কার্যক্রমের অংশ।
বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আন্দোলন যখন তেতে উঠছে, ঠিক সেই সময় সরকার তার পুরোনো কায়দায় গুম, গ্রেপ্তার, নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে ২৮ জুলাইয়ের পর থেকে প্রতিদিনই গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে সরকার নিজেদের প্রার্থীদের বিজয়ী করার জন্য বিরোধী পক্ষকে নির্বাচনে অযোগ্য এবং নেতাকর্মীদের নির্বাচনী মাঠ থেকে তথাকথিত আইনি প্রক্রিয়ায় বিতাড়িত করার সব অপকৌশল গ্রহণ করে চলেছে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম বলেন, ঢাকায় প্রতিদিনই তাদের নেতাকর্মীদের আটক করছে সাদাপোশাকধারী পুলিশ। এজন্য নেতাকর্মীরা রাতে বাসায় থাকতে পারছেন না। সরকার একরকম ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির (দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত) আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সাইদুর রহমান মিন্টু বলেন, ২৯ জুলাইয়ের পর এখন পর্যন্ত প্রায় আড়াইশ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পোশাকধারী ও সাদাপোশাকের পুলিশ সদস্যরা তাদের গ্রেপ্তার করেছে।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক বলেন, ২৯ জুলাইয়ের পর থেকে গতকাল পর্যন্ত তার থানা পল্লবী থেকেই ৫৫ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর উত্তরের বিভিন্ন থানা থেকে সব মিলিয়ে দুই শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন।