জন্মদিন
রেজাউল করিম গাজীপুর, জিয়াউর রহমান নেত্রকোণা
প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০২৩ ১০:১১ এএম
আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৪:৪৬ পিএম
গাজীপুর সদর উপজেলার পিরুজালী গ্রামে হুমায়ূন আহমেদের গড়া নুহাশপল্লীতে তার ম্যুরাল। প্রবা ফটো
অজস্র সৃষ্টির গৌরবে অম্লান জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক, নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ। আজ তার ৭৫তম জন্মদিন। এমন দিনে হুমায়ূন আহমেদের পরশ পেতে দেশ-বিদেশ থেকে ভক্তরা ছুটে আসেন নুহাশপল্লীতে। এই পল্লীর নির্জন প্রকৃতি, লিচুতলা, টিনের চালে ঝরে পড়া বৃষ্টির ফোঁটা আর ঘাস ও মাটির প্রতিটি বিন্দুতে নোঙর পেতেছে হুমায়ূনের হৃদয়।
১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলায় কুতুবপুর গ্রামে জন্ম নেন হুমায়ূন আহমেদ। তবে জন্মস্থান থেকেও হুমায়ূন ভক্তদের কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তার গড়ে তোলা এই নুহাশপল্লী। গাজীপুর সদর উপজেলার পিরুজালী গ্রামে ৪০ বিঘা জমির ওপর রয়েছে লেখকের নিজ হাতে গড়া স্বপ্নের নুহাশপল্লী। যেখানে লিচুতলায় চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছেন তিনি।
নুহাশপল্লীর মূল ফটক পেরুতেই সবুজ ঘাসে আবৃত বিরাট মাঠ। পাশেই পাকা বসতঘর-বাংলো। হুমায়ূন আহমেদের ম্যুরাল ও অর্গানিক ফর্মে ডিজাইন করা ডিম্বাকৃতির একটি সুইমিংপুল। একটু সামনে এগোলেই হাতের ডান পাশে রয়েছে বিভিন্ন গাছের বড় উদ্যান। এ পল্লীর অন্যতম আকর্ষণ প্রাচীন আদলের দুটি ঘাট বাঁধানো ‘লীলাবতী দীঘি’। যার চারপাশের পাড়জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের গাছ। এ ছাড়াও রয়েছে দাবা খেলা ও নামাজ পড়ার কক্ষ। বৃষ্টি বিলাসের সামনের দিকে সবুজ মাঠের মাঝ বরাবর একটি বড় গাছের ওপর কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ছোট ছোট দুটি কুটিরঘর, যেগুলোতে ওঠার জন্য রয়েছে বিভিন্ন রঙে রাঙানো সিঁড়ি। পানির সরোবরে পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে রূপবতী মৎস্যকন্যা। পাশেই বিরাট রাক্ষসের মূর্তি। এ ছাড়াও রয়েছে কনক্রিট দিয়ে তৈরি ডাইনোসরের মতো প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীদের অনুকীর্তি, দাবার গুটির প্রতিকৃতি, হরেকরকম কবুতর ও মাটির তৈরি ঘর।
হুমায়ূন আহমেদের ঘনিষ্ঠজন ও বইয়ের প্রকাশক, অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলাম জানান, নুহাশপল্লী হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্নের জায়গা। এখানকার প্রতি ইঞ্চি মাটি, প্রতিটি স্থাপনাই তার পছন্দের। তিনি তার বইয়ের রয়্যালিটির টাকা দিয়ে এই নুহাশপল্লী করেছিলেন। বিশেষ করে বলা যায়, সেখানে রয়েছে নানা ধরনের বৃক্ষ। তিনি প্রায়ই গাছের সঙ্গে কথা বলতেন। আমরা জিজ্ঞেস করতাম, একা একা কী কথা বলছেন স্যার? বলতেন, কেন, একা না তো, এই যে গাছ আছে। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছিস তোরা, খাবারদাবার দিচ্ছে তো? এরকম নানা মজার মজার কথা বলতেন গাছের সঙ্গে।
মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘স্যার ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভারসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে গাছ সংগ্রহ করতেন। কর্কট রোগের চিকিৎসার বিরতিতে তিনি ঢাকা এসেছিলেন এক মাসের জন্য, তখনও তিনি খামারবাড়ি নার্সারিতে যান, অনেকগুলো গাছ কিনে আনেন, তারপর ঘুরে ঘুরে সেগুলো লাগান। সম্ভবত সেটাই তার শেষবারের মতো নার্সারিতে যাওয়া।’
নুহাশপল্লীর তত্ত্বাবধান করেন সাইফুল ইসলাম বুলবুল। নুহাশপল্লীর সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘স্যারের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা ছিল নুহাশপল্লী। লেখালেখির জন্য এখানে আসতেন। নাটকের শুটিংয়ের জন্য আসতেন। বন্ধুদের নিয়ে এসে এখানে আড্ডা দিতেন। মাসে ৮-১০ বার তিনি নুহাশপল্লীতে আসতেন। তার হাতে লাগানো বৃক্ষ ও ঔষধিগাছগুলো সবসময় তার কথা মনে করিয়ে দেয় আমাদের।’
১৯৭২ সালে হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশের পরই তিনি পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠেন। উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, চলচ্চিত্র পরিচালনাসহ নানা ক্ষেত্রেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিলেন তিনি।
নুহাশপল্লীতে হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন ও মৃত্যুদিন নানা আয়োজনে পালন করা হয়ে থাকে। সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে নন্দিত এ লেখকের প্রতি শ্রদ্ধা জানান তার পরিবার, স্বজন ও ভক্ত-পাঠকরা। প্রতিবারের মতো এবারও নুহাশপল্লীতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। এর বাইরে দুপুর ২টা থেকে চ্যানেল আইয়ের উদ্যোগে হবে হুমায়ূন মেলা।
তা ছাড়া জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিবছর ১০ নভেম্বর ‘হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার’ প্রদান করা হয়Ñ যা এরই মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
নেত্রকোণায় নানা আয়োজন
নেত্রকোণা প্রতিবেদক জানান, হুমায়ূন আহমেদের ৭৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নেত্রকোণা জেলা শহরে দিনব্যাপী কর্মসূচির আয়োজন করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘হিমু পাঠক আড্ডা’। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আলপনা বেগম জানান, দিনব্যাপী কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে কেক কাটা, বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি। শোভাযাত্রায় হিমু-রুপা সেজে হুমায়ূন ভক্তরা অংশ নেবেন।
এ ছাড়া হুমায়ূন আহমেদের পিতৃভূমি নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুর গ্রামে হুমায়ূন আহমেদ প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ দিনব্যাপী কর্মসূচির আয়োজন করেছে।
হুমায়ূন আহমেদ হিমু ও মিসির আলির মতো অসংখ্য জনপ্রিয় চরিত্র আর নন্দনকানন খ্যাত স্বপ্নের নুহাশপল্লীর মাধ্যমে ভক্ত ও পাঠকের মনে বেঁচে আছেন। প্রতিবছরই তাই ভক্তদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় নতুন করে সিক্ত হন হুমায়ূন আহমেদ।