× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

পাঁচ ভাষাশহীদের কবর কোথায়, জানে না কেউ

সেলিম আহমেদ

প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৯:১১ এএম

আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৯:২২ এএম

ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে ভাষাশহীদদের কবর জিয়ারতে জনতার ঢল। ফটো সংগৃহীত

ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে ভাষাশহীদদের কবর জিয়ারতে জনতার ঢল। ফটো সংগৃহীত

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে আটজন প্রাণ হারিয়েছিলেন বলে ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়। কারও কারও মতে এ সংখ্যা আরও বেশি। ভাষাশহীদদের রাতের আঁধারে রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয় বলে ধারণা ইতিহাসবিদদের। কিন্তু সেখানে তিনজনের কবর চিহ্নিত রয়েছে। বাকি পাঁচজনের কবর কোথায়, কেউ জানে না।

জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়াসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের একাংশে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রদের সভা হয়। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ কয়েকজন শিক্ষক ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্য ছাত্রদের প্রতি অনুরোধ জানান। তবে ছাত্রনেতারা বিশেষ করে আবদুল মতিন ও গাজীউল হক নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকেন।

ঢাকা শহরের স্কুল-কলেজের হাজার হাজার ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হয়। ছাত্ররা পাঁচ-সাত জনের ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। এ সময় পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। ছাত্রছাত্রীরা পুলিশকে লক্ষ করে ইটপাটকেল ছুড়লে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতাকে সামলাতে ব্যর্থ হয়ে গণপরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসররত মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি চালায়।

গুলিতে নিহত হন জগন্নাথ কলেজের (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) শিক্ষার্থী মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার পারিল গ্রামের রফিক উদ্দিন আহমদ, ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার পাঁচুয়া গ্রামের আবদুল জববার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বিভাগের শিক্ষার্থী আবুল বরকত। ওই দিন পুলিশের গুলিতে আহত পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ডিরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজ বিভাগের পিয়ন ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার লক্ষণপুর গ্রামের (সালামনগর) আবদুস সালাম ঢাকা মেডিকেলে প্রায় দেড় মাস চিকিৎসাধীন থেকে ৭ এপ্রিল মারা যান।

ওই ঘটনার পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি বিক্ষুব্ধ জনতা নিহতদের গায়েবানা জানাজা পড়ে শোকমিছিল বের করে। ওই মিছিলেও পুলিশ-মিলিটারি লাঠিচার্জ, গুলি ও বেয়নেট চালায়। এতে হাইকোর্টের হিসাবরক্ষণ শাখার কর্মচারী শফিউর রহমান, আবদুল আওয়াল, কিশোর অহিউল্লাহ ও সিরাজুদ্দিন নামে চারজন প্রাণ হারান।

ভাষাসৈনিক আহমদ রফিকের ‘একুশ থেকে একাত্তর’ নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, আব্দুল আওয়াল ছিলেন পেশায় রিকশাচালক। তার বাসা ছিল ঢাকার ১৯ হাফিজুল্লাহ রোডে। তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র নয় বছরের কিশোর অহিউল্লাহ ছিল ঢাকার নবাবপুর রোডের ১৫২ লুৎফর রহমান লেনের বাসিন্দা। পুরান ঢাকার নবাবপুরের খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে অহিউল্লাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আর সিরাজুদ্দিন নবাবপুরে নিশাত সিনেমা হলের বিপরীত দিকে মিছিলে থাকা অবস্থায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন। সিরাজুদ্দিন থাকতেন তাঁতীবাজারের বাসাবাড়ি লেনে।

নাম-পরিচয় নিশ্চিত হওয়া আট ভাষাশহীদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছেন আব্দুস সালাম, রফিক উদ্দিন আহমদ, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার ও শফিউর রহমান। এ পাঁচজনকে ২০০০ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।

কবর চিহ্নিত করা হয়েছে মাত্র তিনজনের

ভাষাশহীদদের সেনাপ্রহরায় অতি গোপনে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে বলে সে সময়ের প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে জানা যায়। তবে আজিমপুর কবরস্থানে গিয়ে দেখা যায়, আব্দুল জব্বার, আবুল বরকত ও শফিউর রহমান ছাড়া আর কোনো শহীদের কবর চিহ্নিত করা বা সংরক্ষিত নেই। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের লাশ দাফনের খাতায় চারজনের নাম রয়েছে। অন্যজন হলো কিশোর অহিউল্লাহ। নাম পাওয়া গেলেও তার কবর চিহ্নিত নেই। ফলে তিনজন ছাড়া বাকিদের কবর কোথায় রয়েছে, জানে না কেউ।

আজিমপুর কবরস্থানে গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি কবরের মধ্যে আবুল বরকত, আব্দুল জব্বার ও শফিউর রহমানের কবর অনেকটা কাছাকাছি কালো টাইলসে বাঁধাই করা। প্রতিটি কবরের পশ্চিম দিকে সাদা মারবেল পাথরের ফলকে লেখা রয়েছে নাম-পরিচয়, জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ। তবে এখানে হাজার হাজার কবরের ভিড়ে এ তিনজনের কবর খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। এখানে যে তিনজন ভাষাশহীদের কবর রয়েছে, এ তথ্যও দর্শনার্থী বা স্বজনদের কবর জিয়ারত করতে আসা লোকজনের অনেকেই জানেন না।

আজিমপুর কবরস্থানের ইনচার্জ মাওলানা হাফিজুর রহমান বলেন, তিনজনের কবর এখানে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাকিদের কবর নিয়ে কোনো ফয়সালা নেই। তখনকার সময় সব কবর চিহ্নিত না করার কারণে তাদের কোন পাশে সমাহিত করা হয়েছিল, তা এখন আর জানা সম্ভব নয়।

গত শুক্রবার সকালে ফুপুর কবর জিয়ারত করতে এসেছিলেন হৃদয় নামে এক তরুণ। তিনি নিয়মিতই তার ফুপুর কবর জিয়ারত করতে আসেন। হৃদয়কে জিজ্ঞেস করলে বলেন, এখানে তিন ভাষাশহীদের কবর আছে তা তিনি জানতেনই না। সোহান চৌধুরী নামে আরেক তরুণ বলেন, এখানে হাজার হাজার মানুষের কবর। কার কবর কোন দিকে চিহ্নিত করা খুবই কঠিন। তাই প্রতিটি কবরের সারিতে নির্দেশক বা সাইনবোর্ড দেওয়া থাকলে ওই সারিতে এসব বিখ্যাত ব্যক্তির যে কবর আছে, তা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের বুঝতে সুবিধা হতো।

এক যুগ ধরে কবরস্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব পালন করছেন আবু সালাম। তিনি বলেন, ‘শহীদ দিবস ছাড়া খুব বেশি লোকজন ভাষাশহীদদের সমাধির খোঁজে আসেনÑ এমনটা আমার চোখে পড়েনি।’

কবরস্থানের নিরাপত্তারক্ষী মনির হোসেন বলেন, ‘এখানে অনেক মানুষের কবর। কার কবর কোন দিনে তা সাধারণ মানুষ কী, আমরাও জানি না। তবে শহীদ দিবস ছাড়াও মাঝেমধ্যে কিছু মানুষ এসে ভাষাশহীদদের কবরের খোঁজ করলে আমরা দেখিয়ে দিই।’

আজিমপুর কবরস্থানের মোহরার (রেজিস্ট্রার) মাওলানা নুরুল হুদা বলেন, ‘কবরস্থানের উন্নয়নে একটি মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় কোন সারিতে কোন বিখ্যাত মানুষকে সমাহিত করা হয়েছে, তা চিহ্নিত করার জন্য ডিজিটাল ইন্ডিকেটর স্থাপন করা হবে। চলতি বছরই এ কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি।’

যা বলছেন ইতিহাসবিদরা

অনেকটা আক্ষেপ নিয়েই ইতিহাসবিদ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন এমন ছয়জনের নাম বেশি আলোচিত হলেও আমার ধারণা অন্তত ৫০ জন জীবন দিয়েছেন। তবে ঠিক কতজন মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন, সে হিসাব দেয়নি তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। বাংলাদেশ সরকারও কোনো পরিসংখ্যান নেওয়ার চেষ্টা করেনি।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ইতিহাসবিমুখ একটি দেশ। এখানে ইতিহাস সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ কোনো সময় নেওয়া হয়নি।’

আরেক ইতিহাসবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘আজিমপুরে আসলে কতজনকে দাফন করা হয়েছিল, তার সুস্পষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে তথ্যগুলো বের হওয়া জরুরি।’

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা