× ই-পেপার প্রচ্ছদ জাতীয় রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত ফিচার শিল্প-সংস্কৃতি ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লাইভ লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনে বাধা কোথায়

প্রবা প্রতিবেদক

২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১১:৩৯ এএম । আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৬:১৫ পিএম

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। প্রবা ফটো

 যে উদ্দেশ্য নিয়ে ভাষা আন্দোলন করা হয়েছিল, তা এখনও পূর্ণ হয়নি। তখন দাবি তোলা হয়েছিল, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, উচ্চশিক্ষা ও বিজ্ঞানশিক্ষা বাংলা ভাষায় করতে হবে, উচ্চ আদালতের ভাষাও বাংলায় হতে হবে; এক কথায় সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করতে হবে। কিন্তু এসবের অনেক কিছুই এখনও হয়নি। বলছিলেন ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক। চীন, জাপান ও উত্তর কোরিয়া চিহ্ন বা ছবি দিয়ে নিজেদের বিজ্ঞান ও উচ্চশিক্ষায় বিরাট সাফল্য অর্জন করেছে; কিন্তু এখানে এখনও তেমনটি না হওয়ায় আক্ষেপ করছিলেন তিনি।

ভাষা আন্দোলনের পরপরই ডা. সাঈদ হায়দার ও আহমদ রফিক ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিয়ে চিকিৎসাশিক্ষার জন্য ড্যাভিডসনের টেস্ট বুক অব মেডিসিন ও কানিহ্যামের অ্যানাটমি কয়েকজনকে দিয়ে অনুবাদ করিয়েছিলেন। ঢাকা মেডিকেলের প্রিন্সিপালের কাছে ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক বলেছিলেন, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমান বুয়েট) বাংলায় উত্তর দেওয়ার স্থান রেখেছে। আপনারা সেই সুযোগটা রাখলে ভালো হয়। যাতে শিক্ষার্থীরা ইচ্ছা করলে বাংলাতে উত্তর দিতে পারে। মেডিকেলের পরীক্ষাগুলো অনেক কঠিন। এমন করলে শিক্ষার্থীদের সুবিধাই হবে। কিন্তু তারা তা করেননি।

এভাবে সদিচ্ছা, উদ্যোগের অভাব ও ঔপনিবেশিক মানসিকতার কারণে থমকে আছে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট আইন ও হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকার পরও তার তোয়াক্কা করছেন না কেউ। ভাষাসংগ্রামী, বুদ্ধিজীবী ও বিশ্লেষকরা বলছেন, সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন না হওয়ার জন্য রাষ্ট্রের উদাসীনতাই দায়ী।

বিভিন্ন রাষ্ট্রের উদাহরণ দিয়ে তারা বলেন, রাষ্ট্র চাইলে সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন করতে বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু রাষ্ট্র ও সরকার সক্রিয় নয় বলেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি আদায়ের ৭১ বছর পরও সর্বস্তরে নিশ্চিত হয়নি বাংলার ব্যবহার। প্রণীত হয়নি ভাষানীতি। এমনকি ভাষা আন্দোলনের পর স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরোলেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম থেকে শুরু করে সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার-ফেস্টুন, বিজ্ঞাপনসহ সবখানেই ইংরেজির দাপটের মুখে বাংলা অসহায় হয়ে পড়েছে। 

ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক বলেন, ১৯০ বছর আমরা ঔপনিবেশিক শাসনে ছিলাম। তাই ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে এখনও বেরোতে পারিনি। মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা চালু করা পরিশ্রম ও সময়সাপেক্ষ কাজটি করতে হলে সদিচ্ছা থাকতে হবে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। অর্থাৎ ব্যক্তি, পরিবার, শিক্ষার্থী-শিক্ষক ও সরকার সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। 

রাষ্ট্রীয় নথিপত্রগুলো বাংলায় করতে হবে জানিয়ে আহমদ রফিক বলেন, এসব তো অনেক আগেই করার কথা ছিল। এখনও হয়নি। আন্দোলন করে আমরা কিছুই পেলাম না একটিমাত্র দেশ ও সংবিধান ছাড়া। সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলা চালু হলো না। 

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন হয়নিÑ এটা হবেও না। কারণ যারা দেশ চালায় সেই রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের সন্তানরা তো বিদেশে লেখাপড়া করে। তাই এটা নিয়ে তাদের মাথাব্যথাও নেই।’ 

তবে সবকিছুর আগে‘সর্বস্তরে বাংলা’ কথাটার অর্থ নির্ধারণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ শাহরিয়ার রহমান। 

তিনি বলেন, ‘শব্দটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। যেখানে জ্ঞানচর্চার বিষয় থাকে, সেখানে যদি জ্ঞানচর্চার সুযোগ বাংলায় না থাকে, সেক্ষেত্রে তো ইংরেজিতেই পড়তে হবে। তবে সাধারণ মানুষ যারা ইংরেজি ভাষায় দক্ষ নয় বা একেবারেই জানেন না, তাদের সঙ্গে যুক্ত কাজে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সেটা হতে পারে কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রজ্ঞাপন, হতে পারে বিজ্ঞাপন। সরকার কিছু বিধিমালা দিলেই হবে না। এ পর্যায়ে ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা বুঝবে আবার দক্ষও হবে এমন একটি প্রজন্ম তৈরি করতে হবে। ওপর থেকে চাপিয়ে দিলে দেখা যাবে কখনও হচ্ছে, কখনও হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে খুব উদ্ভটভাবে হবে। যেমন নাম প্রকাশ না করে বলছি, একটি প্রতিষ্ঠানে বাধ্যবাধকতা আছে বাংলা পরিভাষা করতেই হবে। সেখানে ফরোয়ার্ড-এর বাংলা করা হয়েছে অগ্রআয়ন, যা যথাযথ না।’

সরেজমিন গত কয়েকদিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মাতৃভাষা রক্ষার জন্য যে শহরে প্রথম রক্ত ঝরেছিল, সেই শহরের রাস্তাঘাট, ব্যাংক-বীমা, দেশি-বিদেশি কোম্পানি, বেসরকারি সংস্থা, সরকারি-বেসরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, বিপণিবিতানগুলোর পরিচয়ফলকে ইংরেজির আধিপত্য। শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশের চিত্রও একই রকম। অথচ বাংলায় সাইনবোর্ড লেখা বাধ্যতামূলক করে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে।

২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এক আদেশে সরকারকে দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বর প্লেট, সরকারি দপ্তরের নামফলক এবং গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধের ব্যবস্থা নিতে বলেন। আদালতের কয়েক দফা নির্দেশনার পর গত ২০১৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এক চিঠির মাধ্যমে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বর প্লেটে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করার অনুরোধ জানায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর আগে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন হয় ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ। 

দেশের গণমাধ্যমেও রয়েছে ইংরেজির একক দাপট। দেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যমের নাম ইংরেজিতে। এফএম রেডিওগুলোয় এখনও বাংলা-ইংরেজি-হিন্দি মিশ্রণে অদ্ভূত এক ভাষা ব্যবহার হচ্ছে। বাংলা ভাষার প্রচলন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজগুলোর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। 

এদিকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ব্যবহারের ব্যাপকতা বাংলা মাধ্যমের শিক্ষাকে গ্রাস করে চলেছে। প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষায়ও রয়েছে নানা বিভাজন। দেশে বর্তমানে তিনটি ধারার শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন রয়েছে। এগুলো হলো ইংরেজি, মাদ্রাসা ও সাধারণ ধারা। শিক্ষাবিদরা বলছেন, দেশে একক ধারার শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা না করা গেলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ও চাকরিক্ষেত্রে যেমন বৈষম্য আরও বাড়বে, তেমনি বাংলা প্রচলনও বিঘ্নিত হবে। বাংলায় জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার পথ সুগম করার লক্ষ্যে এ ধরনের বই বাংলায় অনুবাদের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন তারা। 

এদিকে নিম্ন আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলন হলেও উচ্চ আদালতের রায় লেখা হচ্ছে ইংরেজিতে। ফলে বিচারপ্রার্থীদের নানা ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। উচ্চ আদালতে রায় বা আদেশ পাওয়ার পর আর্থিক ব্যয় ও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে ইংরেজি রায়কে বাংলায় রূপান্তর করতে হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মো. আবদুল মতিন বলেন, চাইলে রাতারাতিই আদালতের সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন সম্ভব। এটা সবাইকে আন্তরিকভাবে চাইতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতেও বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। 

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখের যে, স্বাধীনতার ৫১ বছর পর আমরা বলছি আমাদের আইন বাংলায় হতে হবে। কারণ বাংলা এখনও রাষ্ট্রের ভাষা হয়ে ওঠেনি। 

বাংলা ভাষা ছাড়াও দেশে রয়েছে আরও ৪০টি ভাষা। এর মধ্যে আটটি ভাষার রয়েছে নিজস্ব বর্ণমালা। বাকিরা ব্যবহার করেন বাংলা অথবা রোমান লিপি। এসব ভাষা মূলত সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা। সঠিক চর্চা না থাকায় প্রাথমিক শিক্ষায় এসব ভাষা ব্যবহার উপযোগী বর্ণমালা না থাকায় এবং বাংলা ও ইংরেজি ভাষার আধিপত্যে মাতৃভাষা হারাতে বসছে এসব সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী। এক জরিপে দেখা গেছে, এই ৪০টি ভাষার মধ্যে ১৪টি বিপন্নপ্রায়। তবে কতসংখ্যক মানুষ মাতৃভাষা হিসেবে এসব ভাষা ব্যবহার করে, তার সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। শিগগির সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিলে এসব ভাষা হারিয়ে যাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এ প্রসঙ্গে আদিবাসী নেত্রী ফ্লোরা বাবলী তালাং বলেন, ‘কিছু পুঞ্জিতে নিজেদের উদ্যোগে মাতৃভাষা শেখানো হচ্ছে। তবে মাতৃভাষা এখনও টিকে আছে মৌখিক ব্যবহারেই। সরকারি বা সামাজিকভাবে এখনও কিছু হচ্ছে না। বইপত্র পড়া বা সংরক্ষণের সুযোগ নেই। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন যেখানে বেশি, সেখানে মূলধারার সঙ্গে অন্যদের মাতৃভাষাও চালু করা দরকার। তা না হলে আমাদের মাতৃভাষা রক্ষা করা কঠিন হবে।’

অন্যদিকে বাংলা ভাষা এখনও বাণিজ্যিক রূপ নিতে পারেনি বা এ ভাষার বাজার তৈরি হয়নি বলে জানিয়েছেন অনেক ভাষাবিশেষজ্ঞ। ফলে এর প্রচলনও ব্যাহত হচ্ছে। তারা বলছেন, বাংলাদেশে চাকরি-পড়াশোনা কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে অসংখ্য বিদেশি নাগরিক বাস করেন। কিন্তু এ দেশে থাকলেও তারা বাংলা তেমন শিখছেন না। কখনও সহযোগী দোভাষী, কখনওবা গুগলের মাধ্যমে দৈনন্দিন কাজগুলো সেরে নিচ্ছেন তারা। যেসব প্রতিষ্ঠানে বিদেশিরা কাজ করছেন, সেগুলোও বিদেশিদের বাংলা ভাষাশিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করছে না। 

বিশেজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য যোগাযোগে বাংলা ভাষার অপরিহার্যতা সৃষ্টি হচ্ছে খুব ধীরগতিতে। যতদিন না বাংলা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমের ভাষা হয়ে উঠবে, ততদিন এটি কেবল আমাদের মাতৃভাষাই হয়ে থাকবে। সাহিত্যের ভাষা হিসেবে তা এই জনগোষ্ঠীতে সমাদৃত হলেও সার্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে না।

শেয়ার করুন-

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯, +৮৮০১৮১৫৫৫২৯৯৭ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা