× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

গরিবের পুষ্টিতে টান

সোহেল চৌধুরী

প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৩ ১০:০৭ এএম

আপডেট : ০৩ মার্চ ২০২৩ ১৬:৩৬ পিএম

গরিবের পুষ্টিতে টান

নিত্যপণ্যের চড়া দামের বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে গরিব মানুষের ওপর। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়ে গেছে; তাই খরচ সংকোচন বা কম খেয়ে টিকে থাকার পথ বেছে নিচ্ছে নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ। খাদ্য, বাসাভাড়া, সন্তানের পড়াশোনাসহ অন্যান্য ব্যয় মেটাতে পারছে না তারা। ফলে টান পড়তে শুরু করেছে পুষ্টির জোগানেও।

পুষ্টিবিদদের মতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিনের সুষম খাদ্যতালিকায় ২৭০ থেকে ৪৫০ গ্রাম ভাত, ৩০০ থেকে ৬০০ গ্রাম শাকসবজি, ১৫০ থেকে ৩৫০ গ্রাম মাছ অথবা মাংস, ৩০ থেকে ৩৫ গ্রাম তেল এবং ৩০ থেকে ৬০ গ্রাম ডালের প্রয়োজন রয়েছে।

এখন চলতি বাজারদর অনুযায়ী মোটা চাল ৫৫ টাকা কেজি ও সবজি গড়ে ৬০ টাকা কেজি ধরলে আর মাংস দূরে রেখে শুধু ৩০০ টাকা কেজি দরের তেলাপিয়া ও ১৩০ টাকা কেজির মসুর ডাল হিসাবে নিলে, একজনের খাওয়ার পেছনে ন্যূনতম প্রয়োজন দাঁড়ায় প্রতিদিন ১৫৫ থেকে ১৮১ টাকা। এক বছর আগেও এই প্রয়োজন ছিল ১১৮ থেকে ১৩৬ টাকা।

একজন দিনমজুর, রিকশাচালক, চর্মকার কিংবা গৃহস্থালির কাজে নিযুক্ত মানুষসহ যেকোনো নিম্ন আয়ের গরিব মানুষ এখন প্রতিদিন যে আয় করছে, তাতে এই পুষ্টি জোগানো প্রায় অসম্ভব। যেমন রাজধানীর গাবতলীর মাজার রোড এলাকার বস্তিতে দুই সন্তান আর স্ত্রী নিয়ে বসবাস করেন চর্মকার সবুজ দাস। গাবতলী থেকে মোহাম্মদপুর পর্যন্ত পায়ে হেঁটে কাজ করেন তিনি। পুষ্টিবিদদের হিসাবে তার এই চার সদস্যের পরিবারের খাবারের জন্য প্রয়োজন মাসে ১৮ হাজার ৬০০ টাকা। তা ছাড়া বাসাভাড়া তো আছেই! 

সবুজ দাস বললেন, ‘সারা দিন হাঁইটা হাঁইটা জুতা রঙ-সেলাই করি। এটাই আমার আয়ের পথ। কোনোদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয়। এই আয় দিয়ে আর চলে না। অথচ বাজারও তেমন করতে পারি না। চাল, ডাল আর আলুই বেশি কেনা-খাওয়া হয়। সপ্তাহে এক দিন মাছ অথবা মাংস কিনি। বাসাভাড়া, সন্তানের পড়ালেখার খরচ আর খাওয়া নিয়ে মাসে লাগে ১৫ হাজার টাকা। এদিকে আমার আয় মাসে দাঁড়ায় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। মানে খাওয়ার খরচ জোটাতেই ধারদেনা করা লাগে। গত বছর বাসাভাড়া ছিল ৩ হাজার ২০০ টাকা। এবার নতুন বছর থেকে দিতে হচ্ছে ৩ হাজার ৫০০ টাকা করে। আর কুলাতে পারছি না। চলতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।’

একই প্রশ্নের উত্তরে শ্যামলী এলাকার ডাব বিক্রেতা রুবেল মিয়া বললেন, প্রতিদিন ডাব বেচে যা পাই তা বাজার আর বাসাভাড়া দিতেই শেষ হয়ে যায়। ওদিকে গ্রামের বাড়িতে বউ-বাচ্চাদের জন্যও টাকা পাঠাতে হয়। এই আয়ে আসলে ভবিষ্যৎ বলতে কিছু নাই। এর মধ্যে যদি শরীর খারাপ হয়, তাহলে তো মাথায় হাত।

রিকশাচালক আনারুল মিয়া বসবাস করেন সাভার এলাকায়। অতিরিক্ত আয়ের আশায় রিকশা চালান মোহাম্মদপুর এলাকায় এসে।

তিনি বলেন, আয় যা করি তাতে আর চলা যায় না। আয় করি প্রতিদিন ৬০০ টাকার মতো। এর মধ্যে রিকশা ভাড়ায় চালানো বাবদ খরচ দিয়ে আর সারা দিন নাশতা বা এক বেলা ভাত খেয়ে পকেটে থাকে ৪০০ টাকার মতো। মাসে আয় থাকে গড়ে ১২ থেকে ১৩ হাজারের মতো। পরিবারে আমরা আছি তিনজন। বাসাভাড়া দিয়ে, দৈনিক এই বাজার খরচের পর মাস শেষে হাতে আর কোনো টাকাই থাকে না। মাছ, মাংস বা ডিম বাজারের তালিকা থেকে উধাও হয়ে গেছে। তেল, ডাল, চাল, আলু আর খানিকটা সবজি কিনতে পারলেই আমি খুশি।

বাসায় গৃহস্থালির কাজ করেন রহিমা বেগম। মাস শেষে বেতন পেয়ে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে এসেছিলেন সাপ্তাহিক বাজার করতে। সারা মাসের আয়-ব্যয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘তিনটা বাসায় রান্নাবান্নার কাজ করে দিই। ৯ হাজার টাকা পাই। এই টাকা দিয়ে আমি আর পুলায় চলি। পুলা ক্লাস টেনে পড়ে। ওর পড়ার খরচ অনেক। ওর খরচ চালাইতে গেলে বাজার ঠিকমতো করা হয় না। তারপরও মনে চায় সপ্তাহে এক দিন মাছ-মাংস খাই। ফলে ধারদেনা হয়্যা যায়।’

রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় ইট-বালু ভেঙে উপার্জনকারী দিনমজুর নাজু হোসেন বললেন, ‘আগে দৈনিক ৫০০ টাকার আয়ে বেশ ভালোভাবেই চলতাম। কিন্তু করোনার পর সব জিনিসপত্রের দাম বাইরা গেলো। এদিকে আয়টা আগের মতোই থাইকা গেলো। তাই বেজায় প্রেশারে পড়ছি। এই ধরেন, গত দুই মাস ধরে গরুর মাংস খাই নাই। খিলক্ষেতে থাকি। বাসা ভাড়ায় চইলা যায় ৩ হাজার টাকা। বউ আর আমার খাওয়ার খরচ লাগে ৭ হাজার টাকা। আয় কিন্তু ওই দৈনিক ৫০০ টাকাই।’

বিশেষজ্ঞের অভিমত

শরীরে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. খুরশিদুল জাহিদ বলেন, মূল্যস্ফীতির প্রভাব সরাসরি পড়ে গরিব মানুষের ওপর। কেননা বাজার খরচের সঙ্গে যদি তার আয়ের ভারসাম্য না থাকে, তাহলে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য সে নিতে পারবে না। এতে শরীরের ওজন কমে যাবে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। পাশাপাশি বড় শঙ্কা হলো, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের ঘাটতিতে কাজের ক্ষমতা কমে যাবে।

ড. জাহিদ বলেন, বাজার ঠিকমতো করতে না পারায় একজন মানুষের মানসিক ক্ষতি হতে পারে। নিজে না খেতে পারায় অথবা বাচ্চাকে খাওয়াতে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি মানসিক সংকটে পড়তে পারেন। স্বাস্থ্যের ওপর এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে।

টিসিবির তথ্যেও উচ্চমূল্য

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য জানাচ্ছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক কেজি মোটা চালের দাম ছিল ৪৬ থেকে ৫০ টাকা। বর্তমানে যার বাজারদর ৪৮ থেকে ৫২ টাকা। এক বছর আগে মানভেদে এক কেজি সবজি মিলেছে ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। এখন তার দর ৫০ থেকে ৬০ টাকা। প্রতি কেজি ভোজ্যতেল খোলা সয়াবিন এক বছর আগে বিক্রি হতো ১৬০ থেকে ১৭০ টাকায়। বর্তমানে যার বাজারদর ১৬৮ থেকে ১৭২ টাকা। এক কেজি মসুর ডাল এক বছর আগে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে এর দর ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা। এক বছর আগে এক কেজি ফার্মের সাদা মুরগি ১৪৫ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হতো। বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ২১০ থেকে ২৩০ টাকায়। এক বছর আগে এক হালি ডিম ৩৬ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা দরে।

গতকালের বাজারদর

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দুই দিনের ব্যবধানে ফার্মের মুরগির দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত। বাজারে প্রতি কেজি ফার্মের সাদা মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৪০ থেকে ২৪৫ টাকায়। যার দর দুই দিন আগেও ছিল ২২০ থেকে ২৩০ টাকা। একইভাবে সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩৩০ টাকা কেজি দরে। দুই দিন আগেও এটি বিক্রি হয়েছে ২১০ থেকে ২২০ টাকায়।

বাজারে বড় তেলাপিয়া মাছ বিক্রি হয়েছে প্রতিকেজি সর্বোচ্চ ২৩০ টাকা। মাঝারিগুলো ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা কেজি। পাঙাশ মাছের কেজি ছিল ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা।

কারওয়ান বাজারের বিক্রেতা মো. শাহীন মিয়া বলেন, ‘মুরগির সরবরাহ তেমন কমেনি। তারপরও সপ্তাহ ঘুরলে দাম বাড়তাছে। হয়তো খামারে খরচ বাড়ছে। যেমন খাবারের দাম, পরিবহন খরচ, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়তে পারে। মুরগির উৎপাদন খরচ বাইরা গেলে দাম তো বাড়বই।’

এদিকে শীত মৌসুম শেষ হয়ে আসায় সরবরাহ সংকটে চড়া হয়ে উঠছে সবজির বাজার। সপ্তাহের ব্যবধানে মানভেদে প্রতি কেজি সবজিতে দাম বেড়েছে ৫ টাকা পর্যন্ত। প্রতি কেজি শসা ৪০ টাকা, খিরাই ৩০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, পটোল ৮০ টাকা, ঢেঁড়শ ৮০ টাকা, সিম ৫০ টাকা, টমেটো ৩০ টাকা, বেগুন ৬০ টাকা, পেঁপে ৩০ টাকা, চিচিঙ্গা ৫০ টাকা, মিষ্টিকুমড়া ৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকায়।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা