ঈদের ছুটিতে মোটরসাইকেলে গ্রামে ফিরছে হাজারো মানুষ। বৃহস্পতিবার পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তের টোল প্লাজার সামনে আরোহীদের দীর্ঘ সারি। ছবি : রুবেল রশীদ
আজ শুক্রবার (২১ এপ্রিল) চাঁদ দেখা গেলে কাল ঈদ। তাই পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে গতকাল বাস, রেল ও নৌপথে রাজধানী ছেড়েছে লাখো মানুষ। যাত্রী ও পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এ বছরের ঈদযাত্রা তুলনামূলক স্বস্তিদায়ক ছিল।
ঈদের সরকারি ছুটি শুরুর দিন থেকেই রাজধানীর প্রধান নদীবন্দর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে যাত্রীর চাপ বেড়েছে। যাত্রীবোঝাই করে ঘাট ছাড়ছে দক্ষিণাঞ্চলের লঞ্চগুলো। একেবারেই ভিন্ন চিত্র বাস টার্মিনালগুলোতে। রাজধানীর কয়েকটি বাস টার্মিনালে মাইকে ডেকে ছাড় দিয়েও যাত্রী পাচ্ছে না অনেক বাস।
তবে স্বস্তির জায়গায় আছে রেলস্টেশন। স্টেশনে প্রবেশে কড়াকাড়ি থাকায় ট্রেনে অতিরিক্ত যাত্রী নেই। এবার টিকিট ছাড়া কাউকে স্টেশনে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত এবারের ঈদযাত্রা তুলনামূলক স্বস্তির। তবে কয়েক দিনের দাবদাহে কিছুটা ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা।
সদরঘাটে যাত্রীর ঢল
সেহরির পর থেকেই গতকাল বৃহস্পতিবার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের পন্টুনে যাত্রীদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। ভোরের আলো বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে যাত্রীর চাপ। চাঁদপুর, ভোলা, বরগুনা, হাতিয়া, পটুয়াখালীগামী পন্টুনে যাত্রীদের ভিড় থাকলেও বরিশাল রুটে যাত্রীর চাপ তুলনামূলক কম। যাত্রীর চাপ থাকায় নির্দিষ্ট সময়ের আগেই অনেকে লঞ্চঘাট ছেড়ে যাচ্ছে।
একাধিক লঞ্চের সুপারভাইজর ও টিকিট কাউন্টার থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, লঞ্চগুলোতে ডেকের যাত্রীসংখ্যাই বেশি। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারগুলোই লঞ্চে যাচ্ছে। সড়কের চেয়ে তুলনামূলক ভাড়া কম ও যাত্রাপথ আরামদায়ক হওয়াতেই যাত্রী চাপ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন তারা।
সুরভী-৯ লঞ্চের কেরানি মারুফ হোসেন জানান, এবারের ঈদে ছুটির প্রথম দিন সবচেয়ে বেশি যাত্রী হয়েছে। তবে গত ঈদের মতো যাত্রী এখনও দেখছেন না। গত বুধবার ৪০০ যাত্রী নিয়ে গেছেন, ১৫০ যাত্রী নিয়ে এসেছেন।
বিআইডব্লিউটিএ জানিয়েছে, যাত্রীদের চাপ বাড়লে ভোগান্তি কমাতে ও নিরাপদ ভ্রমণের লক্ষ্যে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী লঞ্চের সংখ্যা গত দুদিনের তুলনায় বাড়ানো হবে।
সার্বিক বিষয়ে নৌপুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি শফিকুল ইসলাম বলেন, ঈদযাত্রা সুন্দর ও সহজ করতে আমরা সব ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। আমরা সর্বদা যাত্রীদের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকব। ঈদের সময় চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা মাথায় নিয়ে আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি।
বাস টার্মিনালে চাপ কম
এবার ঈদে সরকারি ছুটি আগেভাগে শুরু হওয়ায় শেষদিকে এসে যাত্রীর চাপ কম দেখা গেছে রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলোতে। পদ্মা সেতুর কল্যাণে এবার ঈদযাত্রা সহজ হয়েছে দক্ষিণের ২১ জেলার মানুষের। এদিকে পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দেওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের কয়েক লাখ যাত্রী মোটরসাইকেলে যাত্রা করেছে। সিলেট-চট্টগ্রাম রুটও রয়েছে স্বাভাবিক। বিমানবন্দর এলাকায় একটি উড়ালসড়ক খুলে দেওয়ায় উত্তরাঞ্চলগামী যাত্রীদের ভোগান্তি কমেছে।
তবে উত্তরবঙ্গের যাত্রীদের কিছুটা ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুর অংশের কিছু কিছু স্থানে গতকাল বিকাল থেকে যানজট সৃষ্টি হয়েছে।
গাবতলী ও কল্যাণপুরে মাইক দিয়ে ডেকে ছাড় দিয়েও যাত্রী পাচ্ছে না অনেক বাস। গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর কল্যাণপুর ও টেকনিক্যালে বাস কাউন্টারগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, সময়মতো কাউন্টার থেকে গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যাচ্ছে বাস। তবে অধিকাংশ কাউন্টার খালি। হাঁকডাক করতে দেখা যাচ্ছে কাউন্টারের টিকিট বিক্রেতাদের।
গাবতলীতে একাধিক বাসের টিকিট কাউন্টারে কথা বলে জানা গেছে, ২৭ রমজান অর্থাৎ ১৯ তারিখ থেকে সরকারি অফিস-আদালতে ছুটি শুরু হয়েছে। সেই কারণে ১৮ তারিখ ছিল যাত্রীদের সর্বোচ্চ ভিড়। এরপর থেকে ভিড় তেমন একটা নেই। তবে এখন ভিড় কিছুটা বাড়তে পারে।
দুপুর ১টার দিকে রংপুর-সৈয়দপুরগামী আসাদ পরিবহনের বাস ছেড়ে যাচ্ছিল। যাওয়ার সময় ডেকে ডেকে যাত্রী তুলছিলেন বাসটির সহকারী ফরিদ আহমদ। তিনি বলেন, ‘এখনও ১১টি সিট খালি। তাই ডেকে নির্ধারিত ভাড়া থেকে কমে যাত্রী তুলছি।’
এই বাসের কাউন্টার ম্যানেজার মুরাদ শেখ বলেন, ব্যবসার অবস্থা খুবই খারাপ। স্বাভাবিক সময়েও এর থেকে বেশি যাত্রী বাড়িতে যায়।
একই কথা জানালেন শ্যামলী পরিবহনের ম্যানেজার মোহাম্মদ মামুন। তিনি বলেন, অন্য ঈদের সময় গাবতলীতে যাত্রী গিজগিজ করত। মানুষের ভিড়ে পা ফেলার সুযোগ থাকত না। এবারের মতো এত খারাপ পরিস্থিতি আগে কখনও দেখিনি। করোনার সময় এর থেকে বেশি যাত্রী বাড়িতে গেছে।
পদ্মা সেতুর কারণে গাবতলীতে যাত্রী কম বলে মনে করেন খুলনাগামী দ্রুতি পরিবহনের কাউন্টার ম্যানেজার মহাবুল হোসেন। তিনি বলেন, আগে দক্ষিণবঙ্গের যাত্রীরা গাবতলী হয়ে বাড়িতে যেত। কিন্তু পদ্মা সেতু হওয়ার পর গাবতলীতে যাত্রী কমতে শুরু করেছে।
তবে গাজীপুরের ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত স্বস্তি থাকলেও বিকাল থেকে নামে যাত্রীদের ঢল। অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে সৃষ্টি হয় যানজট ও ভোগান্তি। শিল্প অধ্যুষিত গাজীপুরের বেশিরভাগ শিল্পকারখানা গতকাল দুপুরের পর ছুটি হয়েছে। একসঙ্গে শ্রমিকদের উপচে পড়া ভিড়ে মহাসড়কে দেখা যায় যানজট। অভিযোগ ওঠে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়েরও।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কোনাবাড়ী, মৌচাক, সফিপুর থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত বেলা ৩টা থেকে যানজট সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া জিরানি থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত মহাসড়কে কোথাও স্থায়ী, কোথাও থেমে থেকে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এ সময় মহাসড়কে পাশ দিয়ে ৫-৭ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে চন্দ্রা ত্রিমোড়ে যেতে দেখা গেছে অনেককে। সেখানেও গাড়ির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।
অপরদিকে ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভোগরা বাইপাসের আগে থেকে সালনা হয়ে রাজেন্দ্রপুর পর্যন্ত ময়মনসিংহগামী রাস্তায় যানজট লাগে।
কালিয়াকৈরের সফিপুরের একটি কারখানার শ্রমিক শরিফুল বলেন, ‘আমাদের কারখানা আজ (বৃহস্পতিবার) লাঞ্চের পর ছুটি হয়েছে। আমাদের মতো শত শত কারখানা আজ ছুটি হয়েছে। রাস্তায় যানজট, এজন্য সফিপুর থেকে হেঁটে চন্দ্রায় এসেছি। দীর্ঘক্ষণ গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে আছি। ভালো কোনো গাড়ি নেই, যা আছে ভাড়া চায় অতিরিক্ত।’
সালনা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতিকুল ইসলাম বলেন, দুপুরের পর কারখানা একসঙ্গে ছুটি হওয়ায় মহাসড়কে যাত্রীর চাপ বেড়েছে। মহাসড়কের কিছু জায়গায় থেমে থেমে গাড়ি চলছে। পুলিশ যানজট নিরসনে কাজ করছে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক) আলমগীর হোসেন বলেন, গাজীপুরে ৭৭ শতাংশ শিল্পকারখানা গতকাল ছুটি হয়েছে। ফলে মহাসড়কে যাত্রীদের চাপ কয়েকগুণ বেড়েছে। যানবাহন থেমে থেমে ধীরগতিতে চলছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন সাভারের বাইপাইল ও গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তায় যানজট পরিস্থিতি পরিদর্শন করে বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালু ও মহাসড়ক ভালো থাকা এবং পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে যানজট পরিস্থিতি এবার স্বাভাবিক রয়েছে।’
এদিকে যানজট নিরসনে গাজীপুরে মহাসড়কের পাঁচটি এলাকায় ৬০ জন রোভার সদস্য কাজ করছেন। তারা গত বুধবার থেকে ভোগরা বাইপাস, চৌরাস্তা, কোনাবাড়ী, টঙ্গী ও রাজেন্দ্রপুরে রোভার দায়িত্ব পালন করছেন। রোভার সদস্যরা শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত কাজ করবেন।
রেলস্টেশনে প্রবেশে কড়াকড়ি, ট্রেনে চাপ নেই
আনুষ্ঠানিক ঈদযাত্রার চতুর্থ দিনেও মোটামুটি স্বস্তির যাত্রা ছিল ট্রেনযাত্রীদের। স্টেশনে ভিড় থাকলেও টিকিট ছাড়া কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে ঈদের আগে কমলাপুরের চিরচেনা ভিড়, অতিরিক্ত যাত্রী- কোনোটাই নেই। রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে গতকাল ৫৫টি ট্রেন প্রায় ৫০ হাজার যাত্রী নিয়ে ছেড়ে গেছে বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া চট্টগ্রামগামী সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেন ছাড়া বড় যাত্রা-বিলম্ব নেই কোনো ট্রেনের। এবার ট্রেনগুলোতে যাত্রীর চাপাচাপি ও ছাদে ভ্রমণের বিষয়টি দেখা যায়নি।
রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান, টিকিট কালোবাজারিমুক্ত করতে অনলাইনে শতভাগ টিকিট বিক্রি ও ঈদে বিনা টিকিটের যাত্রীদের স্টেশনে ঢুকতে না দেওয়ার সিদ্ধান্তে এসেছে এই পরিবর্তন।
গতকাল সকাল ৯টার দিকে কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, চতুর্থ দিনেও রয়েছে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও টিকিট চেকারদের কড়াকড়ি। কমলাপুর রেলস্টেশনে তিন দফা চেকিং শেষে যাত্রীদের প্ল্যাটফর্মে ঢোকানো হচ্ছে।
যাদের কাছে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না, তাদের কাউন্টারে স্ট্যাডিং টিকিটের জন্য পাঠানো হচ্ছে। যারা তাও পাচ্ছেন না, তারা যাচ্ছেন কমিউটার ও লোকাল ট্রেনের কাউন্টারে। তাই স্টেশনের কমিউটার ট্রেনের কাউন্টারে যাত্রীদের বড় লাইন দেখা গেছে। দিনাজপুরের যাত্রী মো. মহিউদ্দিন জানান, তিনি ও তার দুই বন্ধু একতা এক্সপ্রেসের স্ট্যান্ডিং টিকিটের জন্য দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন, কিন্তু লাভ হয়নি। কড়াকড়ি থাকায় এখন বাসায় ফিরে যাচ্ছেন। অনলাইনে টিকিট কাটার বিষয়ে ভালো না বোঝার কারণে এবার টিকিট নিতে পারেননি তিনি।
মহিউদ্দিনরা ফিরে গেলেও যারা টিকিট পেয়েছেন তাদের স্বস্তির কারণ আজকের প্রায় সব ট্রেনই নির্ধারিত সময়ে ছেড়েছে। দিনের প্রথম ট্রেন রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেস সকাল ৬টায় ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও ৩৫ মিনিট দেরিতে রাজধানীর কমলাপুর স্টেশন ত্যাগ করে। এ ট্রেন দেড় ঘণ্টা দেরিতে রাজশাহী পৌঁছাবে বলে জানা গেছে।
দিনাজপুরগামী একতা এক্সপ্রেস চার মিনিট দেরিতে ১০টা ১৪ মিনিটে কমলাপুর রেলস্টেশন ত্যাগ করেছে। সোনার বাংলা ট্রেনটি প্রায় তিন ঘণ্টা দেরি করেছে। সকাল ৭টায় ছাড়ার কথা থাকলেও সকাল ১০টার সময় ট্রেনটি ছেড়েছে। এ ছাড়া রংপুর এক্সপ্রেস ৪৫ মিনিট দেরিতে ছেড়েছে। অন্য ট্রেনগুলো ৫-১০ মিনিট দেরিতে ছেড়েছে।
সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি
প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু
রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯
যোগাযোগ
প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]
বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]
বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯, +৮৮০১৮১৫৫৫২৯৯৭ । ই-মেইল: [email protected]
সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]
2023 Protidiner Bangladesh All Rights Reserved. Developed By Protidiner Bangladesh Team.