× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন

আজমতের পরাজয়ের নেপথ্যে

শাকিল ফারুক ও দীপক দেব

প্রকাশ : ২৭ মে ২০২৩ ০৮:২৫ এএম

আপডেট : ২৭ মে ২০২৩ ১০:৫৯ এএম

আজমত উল্লাহ খান। প্রবা ফটো

আজমত উল্লাহ খান। প্রবা ফটো

অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ২০১৫ সালে নগরের দায়িত্ব পাওয়ার আগে দীর্ঘকাল গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আগে টঙ্গী পৌরসভায় টানা তিন মেয়াদে চেয়ারম্যান ও মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। জনপ্রতিনিধি হিসেবে জনপ্রিয়তাও ছিল বিপুল। দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ পৌর মেয়র সমিতির সভাপতি হিসেবে। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ত্যাগী ও পরীক্ষিত হিসেবে সুপরিচিত এই নেতার স্বচ্ছ ভাবমূর্তি রয়েছে স্থানীয় পর্যায়েও। কিন্তু গাজীপুর সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কোনো নির্বাচনে ভাগ্য সহায় হয়নি আজমত উল্লার। 

২০১৩ সালে গাজীপুর সিটির প্রথম নির্বাচনেও মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী এমএ মান্নানের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন বিপুল ভোটের ব্যবধানে। এরপর ২০১৮ সালে দলীয় মনোনয়ন না পেলেও এবার ফের মেয়রপ্রার্থী হিসেবে আজমতকেই বেছে নেয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু এবার তিনি পরাজিত হলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনের কাছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী হয়েও একজন অরাজনৈতিক গৃহিণীর কাছে আজমতের এমন পরাজয়ে বিস্মিত অনেকেই। তার পরাজয়ের কারণ নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে চলছে নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। স্থানীয়দের মতে, এবারের ভোটের ফল আজমতের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে অস্তিত্বের সংকটে ফেলতে পারে। 

এদিকে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর ফল বিপর্যয় নিয়ে মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করছে আজমতের দল আওয়ামী লীগও। দলের নেতারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে নানা কারণে গাজীপুর সিটির ভোটকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। প্রার্থী হারায় দল ক্ষতিগ্রস্ত হলেও গাজীপুরের ভোটের ফল সরকারের জন্য ভালো হয়েছে। এই নির্বাচনের ভুলত্রুটি থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তী কর্মপ্রক্রিয়া নির্ধারণের সুবিধা হবে। সব মিলিয়ে জাতীয় নির্বাচনের আগে গাজীপুরের ফল শাপে বর হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা। 

গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ছিলেন গাজীপুর সিটিতে দলীয় প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনার জন্য গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা। ফল বিপর্যয় প্রসঙ্গে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়ন বাতিল হয়ে যাওয়ার পর তার মা জায়েদা খাতুনকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিসেবে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নেই ভেবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অতি আত্মবিশ্বাসী ও আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে যেভাবে মাঠে থাকা উচিত ছিল, সেভাবে থাকেননি। এসব ভুল পর্যালোচনা করে জাতীয় নির্বাচনের কৌশল ও কর্মপ্রক্রিয়া নির্ধারণের বড় শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে বলেও মনে করেন মোজাম্মেল হক। 

আজমতের পরাজয় নিয়ে নানাজন নানা মত দিলেও গাজীপুর মহানগরের বাসিন্দাদের রয়েছে ভিন্ন পর্যবেক্ষণ। জায়েদা খাতুনের জয় নিয়ে তারা খুব একটা বিস্মিত হননি। বরং এমন ফল প্রত্যাশিত ছিল বলেই মনে করেন তারা। গাজীপুর সিটির বিভিন্ন ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা হয় বিষয়টি নিয়ে। তারা বলছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে জায়েদা জয়ী হবেন তা নিশ্চিত ছিলেন অনেকেই। কারণ কাগজকলমে জায়েদা সামনে থাকলেও এবারের ভোট ছিল মূলত আজমত ও জাহাঙ্গীরের দ্বৈরথ। মায়ের ছায়া হিসেবে ভোটের মাঠে ছিলেন জাহাঙ্গীর। মেয়র হিসেবে তার জনপ্রিয়তা এবং রাজনৈতিক দক্ষতার কাছে পরাস্ত হয়েছেন আজমত। হেরেছেন জাহাঙ্গীরের ছায়ার সামনে। 

‘ছদ্মবেশী’ সমর্থকে বিপত্তি 

আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের পরও দলটির তৃণমূলে জাহাঙ্গীরের অবস্থান খুব একটা দুর্বল হয়নি কখনও। গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে তিনি ওয়ার্ড ও থানা কমিটিতে নিজের লোকদের পদায়ন করেছেন। এ ছাড়া স্থানীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার পর থেকেই তরুণ সমাজের মধ্যে একটি আলাদা গ্রহণযোগ্যতা তৈরিতে সমর্থ হয়েছেন জাহাঙ্গীর। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, জাহাঙ্গীরকে বহিষ্কার করার পর দলীয় চাপের কারণে তার অনুসারীরা আজমতের পক্ষে প্রকাশ্যে মাঠে নামলেও আড়ালে তারা ঠিকই জাহাঙ্গীরের মায়ের পক্ষে কাজ করেছেন। আওয়ামী লীগে ‘ছদ্মবেশী সমর্থক’ হিসেবে পরিচিত পাওয়া এই অংশটিকে নিয়ে ভোটের আগে থেকেই শঙ্কা থাকলেও বিষয়টি সমাধানে আজমত উল্লা কিংবা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এই কর্মী-সমর্থকদের কারণে আজমতের বিপদ ঘটেছে বলে মনে করেন অনেকে। 

এ বিষয়ে গাজীপুর মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম দীপ বলেন, ছদ্মবেশী সমর্থকরা ব্যস্ত ছিল লোকদেখানো প্রচারে। তাদের মধ্যে ছিল গা-ছাড়া ভাব। আবার অনেকে প্রকাশ্যে নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করলেও দলীয়ভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই সুযোগে এসব লোকজন নৌকার এজেন্ট হিসেবে মাঠে থেকে কাজ করেছেন নৌকার বিরুদ্ধে। এজেন্ট নির্বাচনের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সঙ্গে কেন্দ্র কমিটির কাজে সমন্বয়হীনতা ছিল বলেও দাবি করেন তিনি। 

ভোটের আগে জাহাঙ্গীরের পক্ষে কাজ করছেন এমন নেতাকর্মীদের বারবার হুঁশিয়ার করেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। কিন্তু অভিযুক্তদের প্রতি শক্ত ব্যবস্থা না নেওয়ায় অনেকেই জাহাঙ্গীরের জন্য মাঠে নামার সাহস পেয়েছে। এতেই চরম খেসারত দিতে হয়েছে বলে দাবি আজমত অনুসারীদের। 

এ ছাড়া কাউন্সিলর পদের প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের নেতা হয়েও দলের মেয়র প্রার্থীর জয় নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাননি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আবার কোনো কোনো কাউন্সিলর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কাজ করেছেন জায়েদা খাতুনের জন্য। 

ভোটে পরাজিত হওয়ার পর গতকাল শুক্রবার এ প্রসঙ্গে আজমত উল্লা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দলীয় নেতাকর্মীরা আমার সঙ্গে গাদ্দারি করেছেন। নিশ্চয়ই দোষী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দল ব্যবস্থা নেবে।’

আছে জনবিচ্ছিন্নতার অভিযোগ

গাজীপুর আওয়ামী লীগের একাংশের নেতাকর্মীরা বলছেন, আজমত উল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েও প্রথম সিটি নির্বাচনে পরাজয়ের পর থেকে তৃণমূলের রাজনীতিতে খুব একটা সক্রিয় ছিলেন না। সম্প্রতি মহানগরের আটটি থানা কমিটিতে যাদের তিনি নেতা বানিয়েছেন তাদের সঙ্গেও তৃণমূলের খুব একটা যোগাযোগ নেই। 

শুধু দলীয় নেতাকর্মী নন, স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগের ঘাটতি রয়েছে আজমতের। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, টানা ১৮ বছর টঙ্গী পৌরসভার দায়িত্ব পালনকালে আজমত উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন কাজ করেননি। দলীয় অনুষ্ঠানের বাইরে সামাজিক কর্মকাণ্ডে সহজে তার দেখাও মেলে না। নিজ এলাকা টঙ্গীর বাইরে সিটির অন্যান্য এলাকার তার বিচরণ কম। এসব এলাকার অনেক ভোটার আজমতকে কখনও দেখেননি। 

টঙ্গী এলাকার বাসিন্দা মাহবুব কবীর এ প্রসঙ্গে বলেন, গত ১০ বছর জনপ্রতিনিধির দায়িত্বে না থাকায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের দূরত্ব তৈরি হয়েছে আজমতের। জনপ্রতিনিধি থাকতে তিনি কী কী করেছেন নতুন প্রজন্মের ভোটাররা সে সম্পর্কে অবগত নন। 

আজমতের ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, মেয়র পদে এবার দলের মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন না আজমত নিজেও। তাই তেমন প্রস্তুতিও ছিল না তার। বরং নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে জাহাঙ্গীরের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করায় অনেকে ভেবেছিলেন ২০১৮ সালের মতো আবারও নৌকার প্রার্থী হবেন তিনি। তাই মনোনয়ন পাওয়ার পর সেভাবে গুছিয়ে উঠতে পারেননি আজমত। এ ছাড়া ছদ্মবেশী সমর্থকদের কারণে ভোটারদের দুয়ারে নিজের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ও ভোট প্রার্থনার আহ্বান পৌঁছে দিতে পারেননি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী। 

নগরীর বেশ কিছু এলাকার ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্বাচনী প্রচারে জাহাঙ্গীরের মায়ের জন্য ভোট চাইতে এসেছেন অনেকে। কিন্তু আজমত উল্লা কিংবা তার লোকজনকে তারা দেখননি একবারও। আজমতের কেবল নামই শুনেছেন তারা। 

যদিও এমন দাবি মানতে নারাজ আজমতের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ মণ্ডল। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘আজমত উল্লার জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই, সেটি এখনই আমরা বলব না। আমরা বিষয়টি নিয়ে আমাদের সব নেতার সঙ্গে বৈঠক করব। কী কী কারণে দলের প্রার্থী হেরে গেলেন, সেগুলো খুঁজে বের করা হবে।’

বিএনপি ও অন্য দলের ভোট 

গাজীপুরে বিএনপির রাজনীতিতে প্রভাবশালী সরকার পরিবারের সন্তান সরকার শাহ নূর ইসলাম ওরফে রনি সরকার এবার গাজীপুর সিটি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তার চাচা হাছান উদ্দীন সরকার বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। বিএনপি এবার দলীয় প্রার্থী না দিলেও রনির সরকার ভোটের মাঠে বারবার নিজেকে বিএনপির পরিবারের সন্তান পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। রনির দাবি ছিল, দলীয় প্রার্থী না হলেও বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের তিনি পাশে পাবেন। কিন্তু নির্বাচনে রনি মাত্র ২৩ হাজার ভোট পেয়েছেন। অথচ দশটি ওয়ার্ডে বিএনপির নেতারা কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন।

স্থানীয় রাজনীতিকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের একটি অংশের পাশাপাশি বিএনপি ও অন্যান্য দলের ভোটও গেছে জায়েদার ভাগে। কারণ আওয়ামী লীগের পাশাপাশি অন্যান্য দলের নেতাদের সঙ্গেও সব সময় সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন জাহাঙ্গীর। হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মীয় নানা দল ও সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন তিনি। মায়ের ভোটে এই সুসম্পর্কের প্রতিদান পেয়েছেন জাহাঙ্গীর। নৌকাকে হারাতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ভোটও গেছে জায়েদার পক্ষে। 

তবে গাজীপুর জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি হাছান উদ্দিন সরকারের দাবি, সুষ্ঠু ভোটে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে দাঁড়াবে সেই পাস করবে। বিএনপির বর্ষীয়ান এই নেতা আরও বলেন, জাহাঙ্গীরের মাকে আওয়ামী লীগের লোকজনই ভোট দিয়েছেন। কাউন্সিলর প্রার্থীদের জন্য বিএনপির কিছু ভোটার ভোটকেন্দ্রে গেছেন। তারা আজমত উল্লাকে ভোট দেয়নি। গাজীপুরের মানুষ আজমত উল্লাকে পছন্দ করেন না বলেও মন্তব্য করেন হাছান সরকার। 

এদিকে দলীয় মনোয়নবঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন জাহাঙ্গীর। কিন্তু ঋণখেলাপির জামিনদার হওয়ায় তার মনোনয়ন বাতিল হয়েছে। এরপর আদালতে গিয়ে সুরাহা পাননি। এমনকি দল থেকেও তাকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে প্রার্থী হতে চাওয়ার পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তৎপর হয়ে ওঠে। আজমত উল্লা খানও তার নির্বাচনী প্রচারে জাহাঙ্গীরের সমালোচনাই করেছেন বেশি। নৌকার প্রচারে অতি উৎসাহী তরুণ ও কয়েকজন নেতা ভোট নিয়ে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়ায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। আবার মা জায়েদা খাতুনকে নিয়ে জাহাঙ্গীর নির্বাচনী প্রচারে যাওয়ার পর একাধিকবার তাদের ওপর হামলা হয়েছে, বাধা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শুরু থেকেই একটি গুজব ছিল নিকট অতীতে অন্যান্য নির্বাচনের মতো গাজীপুরেও কোনো না কোনো কৌশলে নৌকার প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করা হবে। এসব ঘটনাবলী ও গুঞ্জনের কারণে আওয়ামী লীগের একটি অংশ ও সাধারণ ভোটারদের কাছে মনে হয়েছে, জাহাঙ্গীর ও তার মায়ের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে। তারা ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়েছেন এমন প্রচারের কারণে সরকারবিরোধী মনোভাব পোষণ করেন এমন ভোটারদের কাছেও সহানুভূতি পেয়েছেন মা-ছেলে। এসব বিপত্তি নিয়ে মাথা না ঘামানোয় চরম মূল্য দিতে হয়েছে আজমত উল্লাকে। 

এ প্রসঙ্গে গাজীপুর সিটি নির্বাচন পরিচালনার জন্য গঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় টিমের সমন্বয়ক দলের ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, নির্বাচনে প্রার্থীর পরাজয়ের পেছনে অনেকগুলো কারণ কাজ করে। এই নির্বাচন ঘিরে বিএনপি-জামায়াত খুবই সক্রিয় ছিল। আওয়ামী লীগেরও সাংগঠনিক প্রক্রিয়াগত কিছু ভুল ছিল, দুর্বলতা ছিল। তা না হলে মাত্র ১৬ হাজার ভোটের ব্যবধান ঘোচানো কোনও বিষয় ছিলো না।

ফ্যাক্টর হয়েছেন নারী ও ভাসমান ভোটাররাও 

শিল্প অধ্যুষিত গাজীপুরে কর্মসূত্রে অবস্থান করেন বিপুল সংখ্যক ভাসমান ভোটার। স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণে বড় নিয়ামক হয়ে ওঠেন তারা। কিন্তু তাদের ব্যাপারে আলাদা করে কোনো উদ্যোগ-পদক্ষেপ কাউকে তেমনভাবে নিতে দেখা যায় না। কিন্তু জাহাঙ্গীর আলম বরাবরই এসব ভাসমান ভোটারের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। নিজেও তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ী হওয়ায় শ্রমিকদের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়গুলো সম্পর্কে ভালোভাবে ওয়াকিবহাল থাকার সুবাদে তাদের মধ্যে বিরাট ভোটব্যাংক তৈরি করেছেন জাহাঙ্গীর। এই ভোটের বড় অংশ পেয়েছেন জায়েদা। 

এ ছাড়া নির্বাচনী পরিবেশ শান্তিপূর্ণ থাকায় গাজীপুরের উৎসবমুখর ভোটে নারী ভোটারের উপস্থিতি ছিল ব্যাপক। এই নারী ভোটারদের একটি বড় অংশের ভোট জায়েদা পেয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ নির্বাচনী প্রচারে জাহাঙ্গীর বারবার তার মাকে গাজীপুরের মা এবং একজন নারী হিসেবে সামনে তুলে ধরেছেন। সন্তানের প্রতি অবিচারের শোধ নিতে তিনি প্রার্থী হয়েছেনÑ জাহাঙ্গীরের এমন আবেগী প্রচারে সহজেই নারী ভোটারদের সহমর্মিতা পেয়েছেন জায়েদা খাতুন। 

জাহাঙ্গীরের ব্যক্তি ইমেজ ও নির্বাচনী কৌশল 

২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আগে সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন জাহাঙ্গীর। সেই সময় থেকেই স্থানীয় মানুষের সঙ্গে সব সময় সম্পৃক্ত থেকেছেন তিনি। বিশেষ করে তরুণ সমাজের কাছে নিজেকে ব্যাপক গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পেরেছেন তিনি। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর সিটি করপোরেশশের ভেতরে থাকা নিভৃত অঞ্চলগুলোতে পাকা রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণ করেছেন। ওই এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে নিয়েছেন নানা পদক্ষেপ। এ ছাড়া দলীয় পরিচয়ের বাইরে বেরিয়ে নিজের নামে শিক্ষা ফাউন্ডেশন খুলে জেলার প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কৃতী শিক্ষার্থীদের উচ্চ হারে বৃত্তি দিয়েছেন ব্যাক্তিগত উদ্যোগে। স্থানীয় আলেম-ওলামাদের প্রতিও সব সময় সুনজর রেখেছেন তিনি। তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ভাতা ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে তাদের পাশে থেকেছেন। নগরীর যানজট নিরসনে নিজ অর্থায়নে কর্মীবাহিনী নিয়োগ দিয়েছেন। যেকোনো প্রয়োজনে রাত-বিরাতে কিংবা প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও নগরবাসীর পাশে দাঁড়াতে পিছপা হননি। এসব কারণে নগরে জাহাঙ্গীরের আলাদা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। 

এ ছাড়া নির্বাচন পরিচালনার কৌশল নির্ধারণেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন জাহাঙ্গীর। প্রথমত, নিজের প্রার্থী বাতিলের আশঙ্কা থেকে মা জায়েদা খাতুনকেও প্রার্থিতার দৌড়ে এনেছেন তিনি। ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা এসব বিষয় নিয়ে গভীরভাবে পর্যালোচনা না করে জায়েদাকে প্রার্থী হিসেবে হালকাভাবে নিয়েছিলেন। সেই সুযোগ সুকৌশলে কাজে লাগিয়েছেন জাহাঙ্গীর। আজমতের জন্য যখন বাইরে থেকে কেন্দ্রীয় নেতারা গিয়ে প্রচার চালিয়েছেন। জাহাঙ্গীর তখন অন্য কারও ওপর ভরসা না করে মাকে নিয়ে নিজেই এলাকা চষে বেড়িয়েছেন। নিজের কর্মীদের দিয়ে কৌশলী প্রচার চালিয়েছেন। নৌকার প্রার্থীর কার্ড গলায় ঝুলিয়ে আওয়ামী লীগের লোকজন জায়েদার জন্য ভোট চেয়েছেন এমন খবরও পাওয়া গেছে। এ ছাড়া নির্বাচনী ইশতেহারে ৫ বছরের জন্য ট্যাক্স মওকুফের ঘোষণা দিয়েও নগরবাসীর সমর্থন আদায় করেছেন জাহাঙ্গীর। ছেলের এসব কাজের সুফল পেয়েছেন জায়েদা।

এ বিষয়ে গাজীপুরের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আরেক সদস্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী বলেন, দলের ভেতরের মুনাফেক ও মোশতাকরা নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে বেইমানি করেছেন। গলায় নৌকা কার্ড লাগিয়ে ভোট দিয়েছে ঘড়িতে (জায়েদা খাতুনের প্রতীক)। 

আর মুক্তিযোদ্ধামন্ত্রী মোজাম্মেল হক বলেন, জাহাঙ্গীরের প্রার্থিতা বাতিল হওয়ার পর জায়েদা খাতুনকে গুরুত্বসহকারে নেওয়া হয়নি। এর ফলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অতি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। যেভাবে মাঠে কাজ করার দরকার ছিল, তা করেননি। এসব ভুলত্রুটি বিশ্লেষণ করে পরবর্তীতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। 

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা