ফারুক আহমাদ আরিফ
প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২৩ ১৩:১৮ পিএম
ফাইল ছবি
কচুশাক থেকে ডাঁটাশাক সবই যাচ্ছে বিদেশে। কৃষকও দাম পাচ্ছেন আশানুরূপ। এতে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের শাকসবজির বাজার বাড়ছে। ইউরোপের মূল বাজারে প্রবেশ করতে না পারলেও সেখানকার বাংলাদেশি প্রবাসী ও নিম্ন আয়ের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে এসব শাকসবজি। এর মধ্যে কচুশাকের বিশেষ কদর রয়েছে বলে কৃষক ও রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজের অতিরিক্ত উপপরিচালক কৃষিবিদ শোয়েব আহমেদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, গত বছর জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ১ হাজার ৬৫৯ মেট্রিক টন শাকসবজি রপ্তানি হয়েছে। প্রতিবছরই রপ্তানি বাড়ছে। লাউ, চালকুমড়া, কচু, মুখিকচু, কচুর ডগা, কচুশাক, কলার থোড়, কলার মোচা, কাঁচা কলা, পেঁপে, মিষ্টিকুমড়া, নাগামরিচ, পেঁয়াজপাতা, ধনিয়া, মুলা, শসা, রজতপাতা, পটোল, চিচিঙ্গা, কাকরোল, করলা, ধুন্দুল, ডাঁটা, লাউশাক, ঝিঙা, পাতাকপি, কাঁচা হলুদ, বেগুন, আখ প্রভৃতি দেশি সবজি রপ্তানি হচ্ছে।
শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নোমান ফারুক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, ইউরোপের দেশগুলো কৃষিপণ্য আমদানির ব্যাপারে শুদ্ধ কৃষিচর্চাকে প্রাধান্য দেয়। সেসব দেশে পণ্য পাঠাতে হলে চাষাবাদ থেকেই পূর্বপরিকল্পনামতো কাজ করলে বাজার আরও সম্প্রসারিত হবে। আগে পণ্য উৎপাদিত হওয়ার পর যেগুলো ভালো হতো তা থেকে বেছে বেছে রপ্তানি করা হতো। এখন রপ্তানির উদ্দেশ্যেই উৎপাদন করতে হয়। উৎপাদন থেকে রপ্তানির পুরো প্রক্রিয়ার তথ্য থাকতে হয়।
স্পর্শ বিডি ট্রেডের কর্ণধার সুরুজিত সাহা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, তারা কৃষকদের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন করে থাকেন। সেসব পণ্যে যাতে যথাযথ মান বজায় থাকে সে বিষয়ে সার্বিক তদারক করা হয়ে থাকে।
পণ্যগুলো কৃষকের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। এসব পণ্যে কৃষক থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্বে কাগজপত্র প্রয়োজন হয়। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার সার্টিফিকেটও লাগে।
সুরুজিত সাহা প্রধানত যুক্তরাজ্যে কৃষিপণ্য রপ্তানি করে থাকেন। তিনি জানান, শুক্র, শনি, রবি ও মঙ্গলবার এই চার দিন তিনি পণ্য পাঠিয়ে থাকেন। পণ্য প্যাকিংয়ের কাজে যুক্ত সারুক নামের একজন শ্রমিক জানান, তিনি ২৭ বছর ধরে প্যাকিংয়ের কাজ করছেন। প্যাকিংয়ে তিনি নিজে যা শিখেছেন তা-ই পুঁজি। নেই কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ। যদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে তারা আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারবেন।
বাংলাদেশ ফ্রুট, ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালায়েড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ফিল্ড অফিসার মো. মোশাররফ হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, তারা কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন কীভাবে চাষবাস করতে হয়। তার অধীনে নরসিংদী জেলার কয়েকটি উপজেলাকে ৪৫ অঞ্চলে ভাগ করে কৃষকদের মধ্যে রপ্তানি উপযোগী পণ্য উৎপাদনে সহায়তা করে থাকেন।
নরসিংদী জেলার বেলাব থানার নারায়ণপুর ইউনিয়নে রহিমের কান্দি গ্রামের শাহাবুদ্দীন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, তিনি শসা, শিম, বেগুন, আলুসহ অন্যান্য শস্য চাষ করেন। কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে চাষ করা এসব ফসল যায় ইউরোপে। একই থানার উজিলাব গ্রামের সেলিম আহমেদ কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে কৃষিপণ্য চাষ করেন। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, তার মতো ৮০ জন কৃষক এই অঞ্চলে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের সঙ্গে যুক্ত। এবার এক বিঘা জমিতে শিম চাষ করেছেন। তাতে ব্যয় হয়েছে ৭০ হাজার টাকা। ভাগ্য ভালো হলে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা বিক্রি করতে পারবেন। আধা বিঘা জমিতে বেগুন চাষ করেছেন ৪০ হাজার টাকা ব্যয়ে। এসব বেগুন ৭০-৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারবেন বলে তার আশা।
সেলিম আহমেদ জানান, স্থানীয় কৃষি অফিস ও বাংলাদেশ ফ্রুট, ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালায়েড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় চাষবাসে। এসব প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি করলে অন্যান্য কৃষকও চাষাবাদে এগিয়ে আসবেন। নরসিংদীর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আজিজুর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, শুদ্ধ কৃষিচর্চা অনুসরণের ব্যাপারে কৃষকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। কোন কোন ফসল চাষ করবেন কৃষক সে বিষয়েও কথা বলা হয়ে থাকে, যাতে কৃষক ন্যায্য দাম পান। চাষবাসে যত ধরনের সমস্যা হয় সে সম্পর্কে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনা দেন। তিনি জানান, উৎপাদিত পণ্যগুলোর মান নির্ণয় করে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। সেটি দেখে কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজ পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়।
নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার কৃষক ও ব্যবসায়ী ইমরান সরকার ও রিয়াজুল সরকার জানান, তারা কয়েক বছর ধরে উত্তম কৃষিচর্চা করে লাভবান হচ্ছেন। তারা নিজেরা কৃষিপণ্য চাষের পাশাপাশি অন্যদের কাছ থেকে পণ্য কিনে ইউরোপের বাজারে রপ্তানি করেন। রিয়াজুল সরকার জানান, প্রতিদিন সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে কৃষিপণ্য কেনার জন্য নির্ধারিত স্থানে আসেন। সেখানে কৃষকদের কাছ থেকে পণ্যসামগ্রী কিনে রাজধানীর শ্যামপুরে নিয়ে যান। নরসিংদী জেলার শিবপুর, রায়পুর ও বেলাব উপজেলার কৃষকরা বেশি দাম পেয়ে উত্তম কৃষিচর্চায় আগ্রহী হয়ে উঠছেন বলে রপ্তানিকারকরা জানান।
রাস্তার পাশে বা খাল-বিল, নদীপাড়ের ঝোপ থেকে কচুশাক কেটেও রপ্তানি করা হয়। আনোয়ার হোসেন নামে এক ব্যক্তি এমন কাজই করেন। তিনি বলেন, তার পাঁচ সদস্যের পরিবার চলে কচুশাক বিক্রি করে। তার মতোই আব্দুস সাত্তার, আবুল কাশেম, আব্দুল বাতেন, তসলিম হোসেনসহ অনেকেই এ কাজের সঙ্গে যুক্ত। তারা প্রতিদিন ভোরে বাড়ি থেকে বের হন কচুশাক সংগ্রহের জন্য। বিভিন্ন স্থান থেকে পাতা সংগ্রহ করে বিকাল ৪টার মধ্যে কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে সরবরাহ করেন, আগে থেকেই যার অর্ডার দেওয়া থাকে। দিন দিন ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের কচুশাকের কদর বাড়ছে বলে তিনি জানান।