অনিয়ম
এম আর মাসফি
প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৩ ১০:৫৫ এএম
আপডেট : ০৫ আগস্ট ২০২৩ ১৫:০০ পিএম
গ্রামীণ রাস্তায় সর্বোচ্চ ১৫ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতু বা কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্প গতিহীন হয়ে পড়েছে। প্রকল্প শেষ হয়নি, অথচ এরই মধ্যে নির্মিত ২৩টি সেতুর অ্যাপ্রোচ রোড দেবে গেছে। ভাঙন ধরেছে সেতুগুলোয় নির্মিত রেলিংয়ে। মাত্র দুটি নির্দিষ্ট আকৃতির নকশা দিয়ে সেতুর কাজ সম্পন্ন করা বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলেও মনে করছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। সাড়ে তিন বছরের এই প্রকল্পে সোয়া চার বছরে কাজ হয়েছে মাত্র সাড়ে ৪৯ শতাংশ। তবে বর্ধিত মেয়াদে প্রকল্পের সময় আছে আর ১৪ মাস মাত্র। ওই সময়ের মধ্যে ৫০.৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। আইএমইডির নিযুক্ত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এমএস ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড প্রকল্পটি পরিবীক্ষণ করেছে।
প্রকল্পটির বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রকল্পটিতে সমস্যাগুলোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। তারা এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’
প্রকল্পের সেতুর সংযোগ সড়ক দেবে যাওয়ার বিষয়ে প্রকল্পটির পরিচালক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সেতু নির্মাণের পর সংযোগ সড়ক করার কথা টিআর/কাবিখা প্রকল্পের আওতায়। তারাই এই কাজ করেছে। এরপর থেকে বিষয়টি আমরা আরও গুরুত্বের সঙ্গে মনিটরিং করব।’ চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ না পাওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি ধীর বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এমএস ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড বলছে, প্রকল্পটি বাংলাদেশের আটটি বিভাগের ৬৪ জেলার সব উপজেলায় বিস্তৃত থাকায় মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ ও সরেজমিন পরিদর্শনের ক্ষেত্রে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে ৩২টি জেলার ৯৮টি উপজেলা নির্বাচন করে ১৯৬০ সুবিধাভোগীর সঙ্গে কথা বলা হয়। সরেজমিন পরিদর্শনে এই সমীক্ষার অধীন ৯৮টি উপজেলায় মোট ১৯৬টি সেতু পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাজের মান ভালো পাওয়া গেছে। তবে ২৩টি সেতুর ক্ষেত্রে ব্রিজের অ্যাপ্রোচ রোড দেবে গেছে। ৭টি সেতুর উচ্চতা খুব বেশি হয়েছে। ১২টি সেতুর ক্ষেত্রে খাল কিছুটা সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। অন্তত ১০টি ক্ষেত্রে কাজের মানে সমস্যা রয়েছে। দুটি সেতুর স্থান নির্বাচনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আর দুটি সেতুর রেলিংয়ে ইতোমধ্যে ভাঙন দেখা দিয়েছে। সেতুর ডিজাইনের ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতাও রয়েছে।
মাত্র দুটি নির্দিষ্ট আকৃতির নকশা
সেতুগুলোর নকশা পর্যালোচনায় দেখা যায়, মাত্র দুটি নির্দিষ্ট আকৃতির নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে, যা বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কেননা একেক অঞ্চলের একেকটি খালের আকার ও গভীরতা ভিন্ন হওয়া স্বাভাবিক। ফলে অবকাঠামোগুলোর ব্যবহারোপযোগিতা অনেক ক্ষেত্রে কমতে পারে। একইভাবে, উয়িং ওয়ালের আকার বাস্তবতার তুলনায় অনেক ছোট। এক্ষেত্রে উঁচু সেতুগুলোর অ্যাপ্রোচ রোডের সংযোগস্থল দেবে গিয়ে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা ইতোমধ্যে সমীক্ষাভুক্ত এলাকার ২৩টি সেতুতে দৃশ্যমান। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার ওপর চাপ তথা এর প্রস্থ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা মাথায় রেখে সেতুগুলো শুরু থেকেই আরও প্রশস্ত করতে হতো। অনেক ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত তদারকির অভাবে মান নিয়ন্ত্রণ যথোপযুক্ত ছিল না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, খাগড়াছড়ির বাটনাতলী ইউনিয়নের সেতুর অ্যাপ্রোচ রোডে বর্তমানে যানবাহন চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। দ্রুত এ রোডের সংস্কার প্রয়োজন। রসুলপুর ইউনিয়নের ব্রিজের কাজে অত্যন্ত নিম্নমানের কাঠের সাটারিং করা হয়েছে। মান সন্তোষজনক নয়। রংপুর পীরগাছার নির্মাণাধীন ব্রিজের উইং ওয়াল ছোট এবং উচ্চতা বেশি। এতে যানবাহন চলাচলে সমস্যা হবে। একই অবস্থা খুলনার দেলুটি ইউনিয়নে।
প্রকল্পের পরিপ্রেক্ষিত
প্রকল্পটির বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর বলছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্যোগ মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে সর্বাধিক ঝুঁকিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিশেষ করে বাংলাদেশের মোট আয়তনের প্রায় ৭০ শতাংশ বন্যাপ্রবণ এলাকা। দুর্যোগকালীন প্রস্তুতি, পুনরুদ্ধার, পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কার্যক্রমের সক্ষমতা বৃদ্ধির অন্যতম শর্ত হচ্ছে গ্রামীণ রাস্তার গ্যাপে সেতু বা কালভার্ট নির্মাণের মাধ্যমে যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করা। ইতঃপূর্বে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় যেসব রাস্তা নির্মিত হয়েছে, সেসব রাস্তা নির্মাণের সময় পানি নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত সেতু বা কালভার্ট নির্মাণ না করার ফলে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি হয়। জলাবদ্ধতা সৃষ্টিসহ প্রতি বছর বন্যার প্রকোপ বাড়িয়ে কৃষি ফসলের ক্ষতিসাধন করে। ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্য গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারের লক্ষ্যে ২০১৮ সালের নভেম্বরে ৬ হাজার ৫৭৮ কোটি ২০ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ‘গ্রামীণ রাস্তায় ১৫ মিটার দৈর্ঘ্য পর্যন্ত সেতু/কালভার্ট নির্মাণ’ প্রকল্পটি গ্রহণ একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। জানুয়ারি ২০১৯ থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত বাস্তবায়নে এই প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়।
কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রগতি না হওয়ায় ব্যয় কিছুটা কমিয়ে মেয়াদ দু’বছর বাড়ানো হয়। ৬ হাজার ৫৪৫ কোটি ২৬ লাখ ৫৯ হাজার টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জানুয়ারি ২০১৯ থেকে জুন ২০২৪ পর্যন্ত বাস্তবায়নকাল নির্ধারণ করা হয়। এতে প্রকল্পের মূল পর্যায়ের তুলনায় সময় বাড়ে ৫৭ শতাংশ এবং ব্যয় কমে আসে দশমিক ৫০ শতাংশ। ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সোয়া চার বছরে ১ হাজার ৯৯০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বা ৩০.৪২ শতাংশ খরচের বিপরীতে বাস্তব অগ্রগতি ঘটেছে ৪৯.৫ শতাংশ। সময় অতিক্রান্ত বিবেচনায় প্রকল্পটির অগ্রগতি অনেকাংশে পিছিয়ে আছে বলে আইএমইডির পরামর্শক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
চার বছরে মাত্র একটি অডিট, তাতেও ১৪ আপত্তি
প্রকল্পের আরডিপিপি অনুযায়ী পণ্য, পূর্ত ও সেবা ক্রয় সংক্রান্ত মোট ২০টি প্যাকেজ রয়েছে। তার মধ্যে পণ্য ১২টি, পূর্ত ছয়টি প্যাকেজে এবং সেবা প্যাকেজ দুটি। এপ্রিল ২০২৩ পর্যন্ত পণ্য ক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে ১০টি এবং পূর্তকাজের চার অর্থবছরে চারটি প্যাকেজের অধীন দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে ৭ হাজার ৫৭৫টি। এর মধ্যে নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে ৬ হাজার ৮৯১টি ও নির্মাণকাজ চলমান ৬৮৪টি সেতুর। সেবা প্যাকেজ দুটির মধ্যে বাস্তবে দুটি প্যাকেজেরই দরপত্র আহ্বান ও চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পে এ পর্যন্ত ৪ বছরের মধ্যে শুধু ২০১৯-২০ অর্থবছরে একটি অডিট কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। অডিটে উত্থাপিত আপত্তির সংখ্যা ১৪টি। আপত্তিগুলো নিষ্পত্তির জন্য প্রকল্প অফিস কর্তৃক জবাব প্রদান করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো আপত্তি নিষ্পন্ন হয়নি।
দেশব্যাপী বিস্তৃত প্রকল্পটির তদারকির জন্য প্রকৌশল শাখার লোকবলের অভাব লক্ষণীয়। উপজেলা পর্যায়ে শুধুমাত্র একজন ডিপ্লোমা প্রকৌশলী ছাড়া আর কোনো কারিগরি লোকবল নেই। তৃণমূল পর্যায়ে দেশব্যাপী পরিচালিত প্রকল্পটি ঢাকায় অবস্থিত মূল প্রকল্প অফিস থেকে তদারকি করা হচ্ছে। তবে বিভাগীয় পর্যায়ে অফিস ও আউটসোর্সিংসহ ডিগ্রিধারী প্রকৌশলী নিয়োগের মাধ্যমে তদারকি আরও নিবিড় করা সম্ভব।
পরিকল্পনা কমিশনের পরিপত্র ও ডিপিপি অনুযায়ী, প্রকল্প পরিচালনার জন্য প্রতি তিন মাস অন্তর পিআইসি ও পিএসসি সভা আয়োজনের বিধান রয়েছে। সে অনুযায়ী ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৫২ মাসে ১৭টি পিআইসি ও পিএসসি সভা হওয়ার কথা। কিন্তু হয়েছে ১৪টি পিআইসি ও ৮টি পিএসসি সভা। অবশ্য কোভিড-১৯-এর বাস্তবতায় এ সংখ্যা সন্তোষজনক। তবে প্রকল্পের ৫২ মাসে ৫ জন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে প্রকল্পের গতিকে ব্যাহত করেছে। এদের মধ্যে চারজনই প্রকল্প পরিচালক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলেন। প্রকল্পের দুর্বল দিকগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ অর্থ প্রাপ্তিতে দেরি ও ডিজাইনে সীমাবদ্ধতা, কাজের মান নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা এবং সম্ভাব্যতা যাচাই যথাযথভাবে না করা। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অগ্রগতি কম হওয়ার মূল কারণ যথাসময়ে অর্থ বরাদ্দ না পাওয়া, কোভিড-১৯ জনিত পরিস্থিতি, স্থান নির্বাচনে দেরি ইত্যাদি।
প্রকল্পের আওতায় দেশব্যাপী ১৫৬ কিলোমিটার বা ১৩ হাজার বক্স কালভার্ট বা গার্ডার নির্মাণ হওয়ার কথা। এগুলোর মধ্যে বক্স কালভার্ট ১২ মিটার পর্যন্ত ৭ হাজার ৮শটি এবং গার্ডার সেতু ১২ মিটারের অধিক থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত ৫ হাজার ২শটি। নির্মাণকাজের ক্ষেত্রে প্রতি অর্থবছরের জন্য একটি করে প্যাকেজ তৈরি করা হয়েছে। আর এ প্যাকেজের অধীনে একাধিক ব্রিজ বা বক্স কালভার্ট রয়েছে। প্রকল্প অফিস কর্তৃক অর্থবছরভিত্তিক বরাদ্দের বিপরীতে উপজেলাভিত্তিক চাহিদার আনুপাতিক হারে যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে এককালীন ওই অর্থবছরের জন্য জিও জারি করা হয়। পরে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন ইউনিটের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে দরপত্র আহ্বান করে নির্মাণ কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সুপারিশ
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এমএস ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েটস বলছে, প্রকল্পটি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য কিছু সুপারিশ হলো সেতুর ডিজাইনে বাস্তব পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ প্রক্ষেপণকে বিবেচনায় আনা, সংযোগ সড়ক উন্নয়নে আরও গুরুত্ব দেওয়া। এ ছাড়া উইং ওয়ালের ডিজাইন সংশোধন, স্থান নির্বাচনে আরও নৈর্ব্যক্তিক হওয়া এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে পিআইও অফিসের লোকবলের অভাব কাটিয়ে উঠতে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বিশেষত টেকনিক্যাল লোকবল নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।