বৈশ্বিক মন্দা
ফারুক আহমাদ আরিফ
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৩ ০৮:৫০ এএম
আপডেট : ২১ আগস্ট ২০২৩ ১৩:৩৪ পিএম
বৈশ্বিক মন্দার ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বজুড়ে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। সাম্প্রতিককালে বিশ্বের ১৮ দেশ তাদের ২৫টি কৃষি ও খাদ্যপণ্য, তিন প্রকারের সার রপ্তানিতে অতিরিক্ত করারোপ ও লাইসেন্সিং (কোটা) এবং নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের খাদ্যশস্যের মজুদ ঠিক রাখতে চায়। ফলে এসব দেশ থেকে ওই ২৫টি পণ্য কেনা অন্যদের জন্য দুরূহ হয়ে উঠবে। এতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও খাদ্য উৎপাদন ও পণ্য আমদানি নিয়ে বিপাকে পড়তে পারে। সারের অভাবে কমতে পারে ধানসহ অন্যান্য ফসলের উৎপাদন। বাড়তে পারে মূল্যস্ফীতি। সব মিলিয়ে এক ধরনের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এই নিষেধাজ্ঞার তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে বলে জানিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আইএফপিআরআই)। গত ৮ আগস্ট ‘ফুড এক্সপোর্ট রেস্ট্রিকশনস ডিউরিং দ্য ইউক্রেন-রাশিয়া ক্রাইসিস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব দাবি করে সংস্থাটি।
তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী দেশ ও নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া পণ্যগুলো হলো- আফগানিস্তানের গম, আলজেরিয়ার পেস্তা, আটা ও ভেজিটেবল অয়েল; আর্জেন্টিনার গরুর মাংস, আজারবাইজানের পেঁয়াজ, বেলারুশের আপেল, বাঁধাকপি ও পেঁয়াজ; বুরকিনা ফাসোর ময়দা, ভুট্টার আটা, যবের আটা; ক্যামেরুনের ভেজিটেবল অয়েল, চীনের ভুট্টার মাড়, ভারতের ভাঙা চাল, সব ধরনের সিদ্ধ চাল, চিনি, গম, গমের আটা, সুজি ও ময়দা; কসোভোর গম, ভুট্টা, ময়দা, ভেজিটেবল অয়েল ও লবণ; লেবাননের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, শাকসবজি ও ময়দা; মরক্কোর টমেটো, পেঁয়াজ ও আলু; পাকিস্তানের চিনি, রাশিয়ার চাল, চালের কুঁড়া; সার্বিয়ার ভুট্টা ও সূর্যমুখী তেল, তিউনিসিয়ার ফল ও শাকসবজি; তুরস্কের গরু, ভেড়া ও ছাগলের মাংস এবং ভোজ্য তেল, মসুর ডাল ও মটরশুঁটি।
বাংলাদেশ ওইসব দেশ থেকে বিভিন্ন কৃষি ও খাদ্যপণ্য আমদানি করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে চীন থেকে ১ লাখ ৬৭ হাজার ১৪৯ দশমিক ৩ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করা হয়। ভারত থেকে ৪ হাজার ৯৩০ দশমিক ৩ কোটি টাকার চিনি ও অন্যান্য পণ্য মিলে ১ লাখ ১৮ হাজার ২৮৭ দশমিক ১ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করা হয়। মরক্কো থেকে ৮ হাজার ১ দশমিক ৯ কোটি টাকার পণ্য, আর্জেন্টিনা থেকে ৬ হাজার ৮৪৩ দশমিক ৭ কোটি টাকার পণ্য এবং পাকিস্তান থেকে ৫ হাজার ৫৮২ দশমিক ৪ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করা হয়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ২০০৭-০৮ অর্থবছরেও অনেক দেশ কৃষি ও খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। তখন আফ্রিকার দেশগুলো খাদ্য সংকটে পড়ে যায়। বর্তমানে দেশে প্রচুর ধান উৎপাদন হচ্ছে। বিশেষ করে বোরো মৌসুমে তা চাহিদার ৫০ শতাংশের বেশি। যদিও এবার আমনে যথাসময়ে বৃষ্টি না হওয়ায় কিছুটা চাপ তৈরি হয়েছে। তবে সামনে যেহেতু বোরো মৌসুম, তাই চালে তেমন সংকট হবে না বলে আশা করা যায়। কিন্তু গমের ক্ষেত্রে অনেক দেশ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় দেশের বেসরকারি সেক্টরে সমস্যা হতে পারে। গম আমদানি করতে না পারলে চালের ওপর চাপ বাড়তে পারে। এতে খাদ্যনিরাপত্তা কিছুটা হুমকিতে পড়তে পারে। তিনি বলেন, সরকার যেহেতু জিটুজি (অন্য দেশের সরকারের সঙ্গে সরকারের সরাসরি চুক্তি) চুক্তি করছে, তার ফলে এ সংকট মোকাবিলা করা যাবে। তবে মূল্যস্ফীতি কমানোর যে চিন্তা ছিল তা থেকে সহজে বের হওয়া যাবে না। মূল্যস্ফীতি বাড়বে।
কৃষি ও খাদ্যপণ্যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে অনেক দেশ থেকেই বাংলাদেশ বিভিন্ন পণ্য আমদানি করে থাকে। ফলে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা খাদ্যনিরাপত্তায় কোনো হুমকি তৈরি করবে কি না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, ‘আমরা অনেকগুলো দেশ থেকে গম আমদানি করে থাকি। কোথাও থেকে আমদানি করি মসুর ডাল। বিশ্ব যেহেতু একে অপরের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত, সে ক্ষেত্রে পণ্য রপ্তানি নিষেধাজ্ঞায় খাদ্যনিরাপত্তায় সমস্যা তৈরি হতে পারে। এমনিতেই আমরা ডলার সংকটের কারণে এলসি খুলতে পারি না। তার ওপর নিষেধাজ্ঞা বা আমদানি পণ্যের ব্যয় বাড়লে তার নেতিবাচক প্রভাব তো পড়বেই।
রপ্তানিতে লাইসেন্সিং
বিশ্বের পাঁচটি দেশ কৃষি ও খাদ্যপণ্যে রপ্তানি লাইসেন্সিং (যে সরকারি নথি নির্দিষ্ট দেশে নির্দিষ্টসংখ্যক পণ্য রপ্তানির অনুমোদন নির্দেশ করে) দিয়েছে বলে আইএফপিআরআইয়ের প্রতিবেদনে জানানো হয়। তার মধ্যে রয়েছে আর্জেন্টিনার গরুর মাংস, আজারবাইজানের ময়দা জাতীয় শিল্পপণ্য ও মাড়, বেলারুশের গম, বার্লি, ওটস, রাই ও ছোলা; ভারতের আটা, রাশিয়ার সয়াবিন, সূর্যমুখী তেল, গম, বার্লি ও ভুট্টা; তুরস্কের তেলবীজ, ভোজ্য তেল, পোল্ট্রির মাংস, ডিম, শাকসবজি ও ফল।
রপ্তানিতে করারোপ
আইএফপিআরআইয়ের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ৪টি দেশ ৮টি পণ্য রপ্তানিতে করারোপ করেছে। তার মধ্যে আর্জেন্টিনা সয়াবিনের তৈরি খাবার ও সয়াবিন তেল; ভারত চাল, রাশিয়া সয়াবিন, সূর্যমুখী তেল, গম, বার্লি ও ভুট্টা; উগান্ডা ভুট্টা, চাল ও সয়াবিন রপ্তানির ওপর অতিরিক্ত হারে করারোপ করেছে।
সার রপ্তানিতে করারোপ ও নিষেধাজ্ঞা
এদিকে ৪টি দেশ সার রপ্তানিতে করারোপ, রপ্তানি লাইসেন্সিং ও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বলেও ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। চীন ফসফেট শিলা ও ইউক্রেন নাইট্রোজেন সারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আবার চীন সব ধরনের সার ও রাশিয়া নাইট্রোজেন সারে রপ্তানি লাইসেন্সিং দিয়েছে। অন্যদিকে ভিয়েতনাম মিনারেল ফার্টিলাইজারে রপ্তানি করারোপ করেছে।
চলতি বছরের এপ্রিলে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছিলেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৭ লাখ টন ইউরিয়া, ১৬ লাখ টন ডায়ামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি), সাড়ে ৭ লাখ টন ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি), ৯ লাখ টন মিউরেট অব পটাশ (এমওপি), ৩০ হাজার টন নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সালফারের সমন্বয় (এনপিকেএস), সাড়ে ৫ লাখ টন জিপসাম, ১ লাখ ৪০ হাজার টন জিঙ্ক সালফেট, ২ হাজার ৫০০ টন অ্যামোনিয়াম সালফেট, ৯০ হাজার টন ম্যাগনেশিয়াম সালফেট ও ৫০ হাজার টন বোরন প্রয়োজন হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে ইউরিয়া সারের উৎপাদন প্রায় ১০ লাখ টন। বাকিটা রাশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও কাতার থেকে আমদানি করা হয়। দেশে টিএসপি সার উৎপাদন হয় ১ লাখ টন। বাকি সাড়ে ৬ লাখ টন আমদানি করতে হয় মরক্কো ও তিউনিসিয়া থেকে। ডিএপি সার দেশে দেড় লাখ টন উৎপাদন হয়। বাকিটা চীন ও জর্ডান থেকে আমদানি করা হয়। এমওপি সারের ৮ লাখ টনের চাহিদার পুরোটাই বেলারুশ, রাশিয়া ও কানাডা থেকে আমদানি করা হয়।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সাজ্জাদ বলেন, রাশিয়া থেকে সার আমদানির ব্যাপারে সাত মাস আগে একটি চুক্তি করা হয়েছে। নানা কারণে এখনও সার আনা সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া সৌদি আরব, মরক্কো, তিউনিসিয়া ও কানাডা থেকে সার আমদানি করা হয়। তবে ইউক্রেন, চীন, ভিয়েতনাম থেকে বেসরকারি পর্যায়ে সার আমদানি করা হয়।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান ফাইজুর রহমান বকুল বলেন, চীন অনেক আগে থেকেই সার রপ্তানি কোটাভিত্তিক করেছে। আর বর্তমানে প্রত্যেক দেশই নিজেদের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও মজুদ ঠিক রাখতে কাজ করছে। সারের আমদানি যথাসময়ে না করতে পারলে কী ধরনের সমস্যায় পড়তে হবে তা অক্টোবরের আগে বলা যাচ্ছে না। সরকার বেসরকারি পর্যায়ে সার বেশি আমদানির সুযোগ রাখছে না। তবে উৎপাদন বাড়াতে হলে সার তো লাগবেই।
খাদ্যপণ্য ও সার আমদানি
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে খাদ্যপণ্য ও সার আমদানি করা হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকার ওপর। তার মধ্যে রয়েছে চাল ৪ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা, গম ১৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, চিনি ১০ হাজার ২৪০ কোটি টাকা, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাতপণ্য ৩ হাজার ২৯২ কোটি টাকা, মসলা ২ হাজার ৯১০ কোটি টাকা এবং সার ২৪ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা।