× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

হাজার কোটি টাকার কাজ ভুয়া সনদে

শহিদুল ইসলাম রাজী

প্রকাশ : ২৩ অক্টোবর ২০২৩ ০১:০২ এএম

আপডেট : ২৩ অক্টোবর ২০২৩ ১১:৩৩ এএম

হাজার কোটি টাকার কাজ ভুয়া সনদে

সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগে ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ দিয়ে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার টেন্ডার বাগিয়ে নিয়েছে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন নামে এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এর নেপথ্যে রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের এক প্রভাবশালী নেতা ও সড়ক বিভাগের উচ্চপদস্থ কয়েক কর্মকর্তা। টেন্ডার ক্যাপাসিটি না থাকলেও গত ছয় বছরে প্রতিষ্ঠানটি ১ হাজার ৪৫৩টি কাজ পেয়েছে। এ টেন্ডারগুলোর অর্থিক মূল্য ৯৮৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরেই রয়েছে ৮৪৯টি প্রকল্প। কাজ না করে ৪৫০-এর অধিক বিল তুলে নিয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। অজ্ঞাত কারণে তাদের বিরুদ্ধে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বারবার কমিটি গঠন করা হলেও অদৃশ্য ইশারায় থমকে যায় তদন্ত।

সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পর্যালোচনা করে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র বলছে, আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন এ পর্যন্ত শতাধিক কাজের ভুয়া কমপ্লিশন সার্টিফিকেট (কাজ সমাপনী সনদ) তৈরি করেছে। এর মধ্যে ৩৩টি সার্টিফিকেট প্রতিদিনের বাংলাদেশের হাতে এসেছে। গত ১২ জানুয়ারি এগুলো ভুয়া বলে প্রত্যয়ন করেছেন নির্বাহী প্রকৌশলী মীর নিজাম উদ্দিন আহমেদ। কুড়িগ্রাম ও কক্সবাজারের বড় বড় প্রকল্প নিতে ব্যবহার করা হয়েছে সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলায় কথিত কাজের ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ। এ বিষয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয় ১০ মাস আগে। কিন্তু এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এর কারণ হিসেবে সূত্র জানিয়েছে, এই চক্রের সঙ্গে একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ওই মন্ত্রী এবং সওজের অন্তত আটজন নির্বাহী প্রকৌশলীর ছত্রছায়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন।

নথি পর্যালোচনায় জানা যায়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মো. দেলোয়ার হোসেন ২০২২ সালের ১৮ অক্টোবর সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলীকে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে অভিযুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্ত করে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর সাত দিন পর সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রকিউরমেন্ট, সার্কেল) মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ দেশের ১১টি সওজ জোন, তিনটি উইং, সড়ক সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলীকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশনা দেন। তবে সেই চিঠিতে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের পুরো নাম না লিখে লেখা হয় ‘মনসুর কনস্ট্রাকশন’। আবার ওই প্রতিবেদনও আলোর মুখ দেখেনি।

এ বিষয়ে সহকারী সচিব মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই আমি অভিযোগ তদন্তের জন্য চিঠি দিয়েছিলাম। আবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই আমি এ কাজ থেকে বিরত থাকি। পরে অন্য শাখা এ নিয়ে তদন্ত করে।’

গত ২১ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের যুগ্ম সচিব এবং তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক মাহবুবের রহমান স্বাক্ষরিত একটি আদেশ জারি করা হয়। এতে বলা হয়, ‘আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন দরপত্র দাখিলের সময় যেসব কমপ্লিশন সন্নিবেশ করেছে সেগুলো ভুয়া বলে অভিযোগকারীরা জানিয়েছেন। প্রমাণক হিসেবে কাগজপত্রও দাখিল করা হয়েছে। এ অবস্থায় বিষয়টি যাচাই করে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন পাঠাতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’ এরপর আর অগ্রগতি জানা যায়নি।

২০২২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাগেরহাট সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকশৌলী ফরিদ উদ্দিন ৫৬টি ভুয়া কমপ্লিশন সার্টিফিকেট যুক্ত করে সড়ক বিভাগে প্রতিবেদন পাঠান। এতে বলা হয়, ‘ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন কর্তৃক দাখিলকৃত কমপ্লিশন সার্টিফিকেটসমূহ সড়ক বিভাগ থেকে ইস্যু করা হয়নি। ভুয়া কমপ্লিশন সার্টিফিকেট দাখিল করে প্রতিষ্ঠানটি ফ্রডুলেন্স প্র্যাকটিসের (প্রতারণামূলক অনুশীলন) সমান শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পিপিআর-২০০৮-এর বিধি ও দরপত্রের শর্তানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।’ কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়নি।

গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর নওগাঁয় মহাদেবপুরের জনৈক নুরুল ইসলাম সিদ্দিক সড়ক পরিবহন সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ জমা দেন। এতে উল্লেখ করা হয়, আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন কয়েক বছর ধরে ভুয়া সনদসহ অসত্য তথ্য দিয়ে সড়ক বিভাগের কাজ হাতিয়ে নিচ্ছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের অসাধু প্রকৌশলীদের যোগসাজশে ভুয়া বিল তৈরি করে সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। জোনের বিশেষ কর্মকর্তার ভয়ে মাঠ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা এ অন্যায় সহ্য করছেন। 

ওই অভিযোগে বলা হয়, চলমান কাজের ভ্যালু বাদ দিলে টেন্ডার পাওয়ার কোনো ক্যাপাসিটি থাকে না আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের। ইতোমধ্যে ভুয়া সনদ দিয়ে ৫৬টি কাজে টেন্ডার দাখিল করেছেন বলে বরগুনা সড়ক বিভাগের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা, নড়াইল, সাতক্ষীরাসহ অনেক বিভাগে শত শত ভুয়া কার্যসনদ দিয়ে টেন্ডার দাখিল করেছে বলে প্রমাণিত হয়েছে। টেন্ডার ক্যাপাসিটি না থাকলেও প্রতিষ্ঠানটিকে অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে কার্যাদেশ দেওয়া হচ্ছে। 

ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর বরিশালের অলেকান্দা বটতলা এলাকার কাশেম আলী হাওলাদার সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়েরর সচিবের কাছে একই ধরনের অভিযোগ করেন। ওই অভিযোগে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের বিরুদ্ধে ৬৮টি ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে টেন্ডারে অংশ নেওয়া ও কাজ পাওয়া সংক্রান্ত তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরা হয়।

সূত্র জানায়, আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন সড়ক ও জনপথ বিভাগে কার্যক্রম শুরু করে ২০১৭-১৮ সালে। শুরুর বছরে এককভাবে ৯২ লাখ টাকার কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। টেন্ডার ক্যাপাসিটি অনুযায়ী, শুরুর প্রথম পাঁচ বছরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টাকার অঙ্কে আগের বছরের দেড় গুণ বড় কাজ পেতে পারে। সেই হিসাবে পরের অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি সর্বোচ্চ ১ কোটি ৩৮ লাখ টাকার কাজ পেতে পারে। কিন্তু অবেদ মনসুর দ্বিতীয় অর্থবছরেই এককভাবে প্রায় ২১ কোটি টাকার কাজ করে। অদৃশ্য ক্ষমতাবলে পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠানটি সড়ক বিভাগের অন্তত ৪৭১ কোটি টাকার কাজে অংশ নিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, ৫০ লাখের নিচের টেন্ডারের ক্ষেত্রে লিমিটেড টেন্ডার মেথড (এলটিএম) অনুসরণ করার কথা। কিন্তু তা না করে ওপেন টেন্ডার মেথডের (ওটিএম) মাধ্যমে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের নামে ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হয়। 

আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের সার্টিফিকেট জালিয়াতির বিষয়টি গত ফেব্রুয়ারিতে কুড়িগ্রাম সওজ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে জানান সাতক্ষীরা সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মীর নিজাম উদ্দিন আহমেদ। এ সংক্রান্ত চিঠিতে তিনি আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের ৩৯টি ভুয়া কমপ্লিশন সার্টিফিকেট যুক্ত করে দেন। এ ছাড়া পৃথক চিঠিতে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের ১০টি ভুয়া কমপ্লিশন সার্টিফিকেট যুক্ত করে কক্সবাজার সওজ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকেও বিষয়টি জানান নির্বাহী প্রকৌশলী। 

এ বিষয়ে বারবার চেষ্টা করেও আবেদ মনসুরের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সড়ক বিভাগ ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নূরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন এবং সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে একটি কমিটি তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। অধিকতর নিশ্চিত হতে আরও একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। দ্বিতীয় কমিটির তদন্তকাজ শেষের দিকে। তবে আমরা আরও যাচাই-বাছাই করছি। এটা সারা দেশের অনেক বড় কাজ। তাই একটু সময় লাগবে। কমিটি অভিযোগের সত্যতা পেলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা