পোশাক খাত
এম আর মাসফি
প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:৩৭ এএম
আপডেট : ০৪ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:০২ পিএম
আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায় ছয় বছর ধরে কাজ করেন রাসেল আহমেদ। বেতন পান মাত্র ১১ হাজার টাকা। তার প্রায় অর্ধেকটাই চলে যায় বাসাভাড়ায়। অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির বাজারে সংসার চালাতে হিমশিম খান তিনি। পুষ্টিকর খাবারের অভাবে মাঝেমধ্যেই হয়ে পড়েন অসুস্থ।
দেবোনিয়ার গ্রুপের একটি কারখানায় কর্মরত রাসেল আরও বলেন, বেতনের সামান্য টাকায় কোনোভাবেই সংসার চালাতে পারছি না। প্রতি মাসেই ধারদেনা করতে হচ্ছে। বাসাভাড়া দেওয়ার পর খাওয়ার টাকা হাতে থাকে না। মাছ-মাংস দূরের কথা, সবজি কেনাও কঠিন হয়ে গেছে। ভালো-মন্দ খেতে না পারায় মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়ি।
বাজারের যে অবস্থা তাতে দুবেলা ভাত খাওয়ার উপায় নেই। আমরা কী খেয়ে বাঁচব? আলুর দামও ৭০ টাকা, পেঁয়াজ ১৩০ টাকা। অথচ গত বছর এই সময় আলুর দাম ছিল ৩০ টাকা, পেঁয়াজ ৫০-৬০ টাকা কেজি। বাড়িভাড়াও বেড়েছে। শুধু একটা জিনিসই বাড়েনি, সেটা হচ্ছে আমাদের বেতন।
রাসেলের মতো দেশের ৪০ লাখ পোশাকশ্রমিকেরই আজ একই অবস্থা। দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক খাত। এ খাতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানিকারক বাংলাদেশ। অথচ শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে এ দেশের শ্রমিকরা পান সবচেয়ে কম মজুরি। সরকারি প্রণোদনায় পুষ্ট পোশাক শিল্প অনেক দূর এগিয়ে গেলেও পিছিয়ে রয়েছে এর মূল চালিকাশক্তি শ্রমিকগোষ্ঠী। কমেছে তাদের জীবনমানও।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডির এক তথ্যে দেখা যায়, চীনে একজন পোশাকশ্রমিকের মাসিক মজুরি ৩০৩ ডলার। ইন্দোনেশিয়ার শ্রমিকরা পান ২৪২ ডলার। ভারতে একজন পোশাকশ্রমিকের সর্বনিম্ন মজুরি ১৭১ ডলার। ভিয়েতনামের একজন শ্রমিক পান ১৭০ ডলার। আর বাংলাদেশের একজন পোশাকশ্রমিক সর্বনিম্ন মজুরি পান মাত্র ৭২ ডলার। অথচ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি লিড সার্টিফাইড পোশাক কারখানা এখন এই দেশে। বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি লিড (এলইইডি) সার্টিফাইড গ্রিন ফ্যাক্টরির অর্ধেকই রয়েছে বাংলাদেশে। প্রতিবছর পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধির হারও যথেষ্ট ভালো। অথচ শিল্প এগিয়ে গেলেও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এই শিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার পেছনের কারিগররা।
খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত দুই বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। ৫ বছরে সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতি ৩৫ শতাংশ। অথচ এখন পোশাক কারখানার মালিকদের পক্ষ থেকে মাত্র ৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। যেখানে ২০১৮ সালে যে মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেটাও আগের সর্বনিম্ন মজুরির তুলনায় ৫১ শতাংশ বেশি ছিল। অর্থাৎ যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে এবার কম মজুরি বৃদ্ধির রেকর্ড হতে যাচ্ছে।
গত ২২ অক্টোবর পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা প্রস্তাব করা হলেও মালিকরা ১০ হাজার ৪০০ টাকা দিতে সম্মত হন। মালিকদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে পোশাকশ্রমিকরা ২৩ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবি জানান। তবে সিপিডি ও বেসরকারি সংস্থা ক্রিশ্চিয়ান এইড এক সংলাপের পর পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১৭ হাজার ৫৬৮ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে। সিপিডি বলছে, ক্রেতারা যদি প্রতি পিস পণ্য মাত্র ৭ সেন্ট (প্রায় ৮ টাকা) বেশিতে নেয়, তাহলে এ মজুরি দিতে কোনো চাপ তৈরি হবে না।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘দুজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে সামনে রেখে একটি পরিবারের ন্যূনতম খরচ হিসাব করে এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। একজন পোশাকশ্রমিকের পরিবারের খাওয়া খরচ ১৬ হাজার ৫২৯ টাকা। অন্যান্য খরচ ১২ হাজার ৮৮১ টাকা। মোট মাসিক খরচ দাঁড়ায় ২৯ হাজার ৪১০ টাকা। এর সঙ্গে মূল্যস্ফীতি যোগ করলে দাঁড়ায় ৩১ হাজার ৯৪২ টাকা।’
জানতে চাইলে মজুরি বোর্ডে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি ও সাবেক বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান গতকাল শুক্রবার প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, পোশাক শিল্প যেভাবে এগিয়েছে, শ্রমিকদের মজুরি সেভাবে বাড়েনি। এর আগে কখনও ৫০ শতাংশের কম মজুরি বাড়েনি।
‘আপনারা ৩০ শতাংশ মজুরি বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। তাহলে কি এবার মজুরি কম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে রেকর্ড হবে?Ñ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০১৮ সালে আমরা মালিকপক্ষের দিক থেকে ১ হাজার টাকা বা ২০ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তবে সেবার বোর্ডের সকলের সিদ্ধান্তক্রমে ২ হাজার ৭০০ টাকা বা ৫১ শতাংশ বেতন বেড়েছিল। এবার মালিকপক্ষ থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকা বেতন বাড়িয়ে ১০ হাজার ৪০০ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা। সামনে মজুরি বোর্ডের আরেকটি বৈঠক আছে। সেখানে সকলের সমন্বয়ে মজুরি কত টাকা বাড়বে, সেই সিদ্ধান্ত হবে। সেখানেও যদি না হয়, তাহলে সরকারপ্রধান তো আছেন। আর বিজিএমইএ সভাপতি তো বলেছেন, সরকার যা নির্ধারণ করে দেবে, তা-ই মেনে নেবেন।
সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, শুধু পোশাক শিল্পে বেতন বাড়ালেই তো হবে না। আরও ৪৪টি সেক্টর আছে। সব দিক বিবেচনা করেই ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হবে। অন্যান্য সেক্টরের চেয়ে পোশাক শিল্পে মজুরি বেশি বলে তিনি দাবি করেন।
এর আগে এক অনুষ্ঠানে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, প্রথম মজুরি বোর্ড গঠনের পর ১৯৯৪ সালে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৯৩০ টাকা করা হয়। তার ১২ বছর পর করা হয় ১ হাজার ৬৬২ টাকা। ২০১০ সালে ৩ হাজার টাকা করা হলো। এর তিন বছর পার হতেই আবার বাড়ানো হলো। তখন আমরা ৫ হাজার ৩০০ টাকা করি। ২০১৮ সালে আবার ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করি। তখন কিন্তু শ্রমিকদের থেকে বা অন্য কেউ আমাদের কিছু বলেনি। আমরা নিজেরাই অনুভব করেছি। তখন ৮ হাজার টাকা করা হলো। এ বছরও বিজিএমইএ থেকে শ্রম মন্ত্রণালয়কে মৌখিকভাবে বলেছিÑ মজুরি বোর্ড গঠন করেন। তখন ওনারা সেটা করলেন। এখন এটা নিয়ে কাজ চলছে।
এদিকে বেতন বৃদ্ধির বিষয়ে শ্রমিক নেতারা বলছেন, গত পাঁচ বছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের বেশি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম দ্বিগুণ-তিনগুণ হারে বেড়েছে। ফলে শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি ৫০ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় কেবল গত ৯ মাসে ২০১৮ সালের তুলনায় গার্মেন্টস মালিকদের বাড়তি আয় হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। একই সময়ে মজুরির সমান আজকের বাজারের ক্রয়ক্ষমতা অর্জন করতে হলে মজুরি হতে হবে ১২ হাজার টাকার বেশি।
রাজধানীর মালিবাগের তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিক শাহেদা খাতুন বলেন, বাজারে ৮০ থেকে ১০০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই। মাংস বলতে কালেভদ্রে পোল্ট্রি মুরগি। একটু বেশি আয়ের জন্য মাসে ২৬ দিন অতিরিক্ত কাজ করেও জীবন চলে না। একটা অমানবিক জীবন কাটাতে হচ্ছে।
সিপিডির সাম্প্রতিক এক গবেষণার তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে শ্রমিকদের পরিবারের জন্য খাদ্যবহির্ভূত খরচ ২৫ শতাংশ বেড়েছে। গড় ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৮৮২ টাকা, যা ২০২২ সালে ছিল ১০ হাজার ৩১৩ টাকা।
ন্যায্য আয়ের অভাবে শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে পুষ্টির সঙ্গে আপস করছেন বলে এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুষ্টি গবেষণা ইনস্টিটিউট। এতে বলা হয়, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য খাদ্য বাবদ খরচ লাগে ৫ হাজার ৩৮৫ টাকা। শিশুর ক্ষেত্রে তা ১ হাজার ৯৩৭ টাকা। সেই হিসাবে মোট খাদ্য খরচ আসে ১৬ হাজার ৫২৯ টাকা। অথচ একজন শ্রমিক খরচ করতে পারেন ৯ হাজার ১৫৮ টাকা। এর ফলে শ্রমিকরা তাদের খাদ্যতালিকায় ডিম, চিনি, ফল কিংবা দুধের মতো প্রয়োজনীয় উপাদান বাদ দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে পোশাকশ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর দাবি জানিয়ে জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, যে শিল্পে কাজ করে একজন শ্রমিক ৩০ দিন খেতে পারেন না, বাচ্চার স্কুলের বেতন দিতে পারেন না, ২০ দিনের মাথায় বেতন শেষ হয়ে যায়, সেই শিল্পের বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, শ্রমিকদের বেতন বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে দরকষাকষি করে পণ্যের মূল্য বাড়াতে হবে। শ্রমিক স্বস্তিতে না থাকলে দেশ স্বস্তিতে থাকবে না। একটা খাতের উন্নয়ন হচ্ছে মানে হলো সে খাতের শ্রমিকদেরও উন্নয়ন হবে। আমরা গার্মেন্টস মালিকদের চকচকে বাড়ি দেখি, কারখানাও চকচকে দেখছি। গার্মেন্টস শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের উন্নতি দেখছি না। সকালে যখন হাঁটি তখন দেখি হাজার হাজার মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সবাই লিকলিকে। কারও স্বাস্থ্য ভালো না। খেতে পারে না ঠিকমতো।
এদিকে মালিকপক্ষের দেওয়া ন্যূনতম মজুরি প্রস্তাবকে ‘অযৌক্তিক’ মনে করেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান। তাই শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে বাজারদরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গ্রহণযোগ্য মজুরি নির্ধারণে মজুরি বোর্ডে একটি সুপারিশ পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
গত ১ নভেম্বর মজুরি বোর্ডের বৈঠকের পর শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, ২০১৮ সালে গঠিত মজুরি বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ৮ হাজার টাকা এবং বার্ষিক ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট (বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি) দেওয়ার বিধান করা হয়। গত ৫ বছরে ইনক্রিমেন্টের কারণে বৃদ্ধি পেয়ে শ্রমিকদের বেতন ১০ হাজার ৪০০ টাকার কাছাকাছি হওয়ার কথা, সে কারণে বর্তমান মজুরি বোর্ডে পোশাক মালিকদের পক্ষ থেকে ন্যূনতম মজুরির যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সেটি অযৌক্তিক বলেই মনে হয়েছে। তিনি বলেন, মজুরি বোর্ড আগামী বৈঠকে উভয়পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারে। তারা ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারলে প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত দেবেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান তৌহিদুর রহমান বলেন, বর্তমান উচ্চমূল্যের বাজারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ মজুরি কাঠামো ঘোষণা না দেওয়া হলে শ্রমিকরা তা মেনে নেবে না। এখন পর্যন্ত শ্রমিকদের বোঝানো হচ্ছে যে, এবার একটা ভালো মজুরি দেওয়া হবে। তারা সে আশায় এখনও শান্ত রয়েছে। শেষ পর্যন্ত যদি চাহিদামাফিক মজুরি দেওয়া না হয়, তাহলে শ্রমিকরা রাস্তায় নামবে। আন্দোলন করবে।
অর্থনীতিবিদ ও জেনেভায় ইন্টারন্যাশনাল লেবার অফিসের কর্মসংস্থান-বিষয়ক সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, প্রায় দেড় বছর ধরে শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কমছে। অথচ একই সময়ে অর্থনীতিতে দেখা গেছে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি। এটি উদ্বেগের বিষয়।