× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

শাহবাগ থানায় আটকে আছে স্বাধীনতার স্তম্ভ

সেলিম আহমেদ

প্রকাশ : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ১১:০৮ এএম

আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ১১:২৯ এএম

স্বাধীনতা স্তম্ভ। ছবি : উইকিপিডিয়া

স্বাধীনতা স্তম্ভ। ছবি : উইকিপিডিয়া

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান)। ঐতিহাসিক এই ময়দানেই একাত্তরের সাতই মার্চ কালজয়ী ভাষণ দিয়ে দেশের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরাজিত হওয়ার পর এই উদ্যানেই আত্মসমর্পণ দলিল স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে এখানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়।

২০০৯ সাল থেকে চলে এ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়। পরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো সংরক্ষণের জন্য ২০১৭ সালে ‘ঢাকাস্থ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়)’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয় মুক্তিযুদ্ধবিয়ষক মন্ত্রণালয়। এরপর এক দফা মেয়াদ বাড়লেও প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। সর্বশেষ তথ্যমতে, প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি ৫০ শতাংশ। 

এদিকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, শাহবাগ থানা স্থানান্তরিত না হওয়ার কারণে প্রকল্পটির কাজ শেষ হচ্ছে না। থানা কমপ্লেক্স সরানোর জন্য একাধিকবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েও সমস্যা সমাধানের কোনো সুরাহা হয়নি। থানাটি দ্রুত স্থানান্তর না হলে প্রকল্পটি চলতি মেয়াদেও শেষ হবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। 

তবে শাহবাগ থানা হস্তান্তর না হওয়ায় প্রকল্পের কাজ থেমে আছে, এ কথা মানতে নারাজ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। তারা বলছে, থানা সরানোর জন্য আশপাশে বিকল্প স্থান খোঁজা হচ্ছে । এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) রথীন্দ্রনাথ দত্ত বলেন, ‘থানা সরানোর জন্য একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। এটা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী এবং সচিব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও অনেকবার কথা বলেছেন। এ ব্যাপারে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে আশা করছি, বিষয়টির সমাধান হবে।’

যে কারণে আটকে আছে প্রকল্প 

সর্বশেষ গত ৮ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রকল্পের চলমান অগ্রগতি পর্যালোচনাসভা হয়। সভায় প্রকল্পটির পরিচালক জানান, অক্টোবর, ২০২৩ পর্যন্ত প্রকল্পটির ভৌত-অগ্রগতি মূল অনুমোদিত ডিপিপি অনুযায়ী ৭০ শতাংশ। তবে সংশোধিত ডিপিপিতে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এবং নতুন কিছু বিষয় সংযুক্ত হওয়ায় বর্তমানে প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৫০ শতাংশ। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ প্রকল্পে ১৪৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অক্টোবর, ২০২৩ পর্যন্ত প্রকল্পের ব্যয় হয়েছে ৩৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ।

প্রকল্প পরিচালক আরও জানান, প্রকল্প এলাকায় থাকা শাহবাগ থানা দ্রুত স্থানান্তর করা না হলে প্রকল্পের সার্বিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে এবং ফুলের দোকান হস্তান্তর করা সম্ভব হবে না। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, এই প্রকল্পের চলমান মেয়াদ আগামী বছরের জুন মাসে। তাই দ্রুত থানা স্থানান্তর করা না হলে প্রকল্পের কাজ চলতি মেয়াদেও শেষ হবে না। 

প্রকল্পের পরিপ্রেক্ষিত 

২০০৯ সালের ২৫ জুন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কে এম সফিউল্লাহ ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের স্থান ও পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থানটি সংরক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন। ওই বছরের ৮ জুলাই আদালত ভাষণের স্থানসহ মোট ৭টি স্থান সংরক্ষণ ও স্বাধীনতা-পরবর্তী নির্মিত, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে না এমন স্থাপনা সরাতে আদেশ দেন। পাশাপাশি রায়ে উদ্যানের ওই অংশটিকে ‘স্বাধীনতা উদ্যান বা লিবার্টি স্কয়ার’ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। 

রায়ে যে স্থানগুলো চিহ্নিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো- ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর দেওয়া ভাষণের স্থান; ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণের স্থান; একাত্তরের ৩ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের শপথের স্থান; ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের স্থান; পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থান; ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের স্থান এবং ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ দেওয়ার স্থান।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর একনেকের বৈঠকে ২৬৫ কোটি ৪৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা ব্যয়ে ঢাকাস্থ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্প অনুমোদন পায়। প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। কিন্তু ওই মেয়াদে বঙ্গবন্ধু ও আত্মসমর্পণ স্থানের দুই ভাস্কর্যের মডেল চূড়ান্ত ছাড়া আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। 

এরপর ২০২৩ সালের এপ্রিলে প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ায় পরিকল্পনা কমিশন। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো প্রকল্পের মেয়াদের পাশাপাশি ব্যয়ও বেড়েছে ৪৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। যার ফলে বর্তমানে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯৭ কোটি ৩৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। 

সরেজমিনে দেখা যায়, বর্তমানে ৭ মার্চের ভাষণ ও মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থানে ভাস্কর্য স্থাপনের কাজ চলছে অনেকটা জোরেশোরে। সর্বশেষ মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের ওই সভায়, ভাস্কর্য তৈরির কাজ সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করারও নির্দেশ দেওয়া হয়।

প্রকল্প সূত্র আরও জানায়, প্রকল্পের আওতায় থাকা ৫০০ গাড়ি ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ভূগর্ভস্থ কার পার্কিং, আন্ডারপাস, মসজিদ, সাবস্টেশন ও জেনারেটর ভবন, সাতটি ফুড কিওস্ক, ওয়াটার রিজার্ভার এবং ওয়াকওয়ে নির্মাণকাজ শেষের পথে। 

এর আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছিল ১৯৯৮ সালের ২৯ জুন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ঢাকাস্থ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে উদ্যানের উত্তর প্রান্তে তৈরি করা হয় শিখা চিরন্তন। এর সামনে থেকে একটি ‘অ্যাপ্রোচ প্লাজা’ করা হয়, এটি গেছে স্বাধীনতা স্তম্ভ পর্যন্ত। স্তম্ভের পাশের জলাধার, ভূগর্ভস্থ জাদুঘর, জলাধারের দেয়ালে ম্যুরাল স্থাপন এবং বাংলা একাডেমির সামনের অংশে একটি উন্মুক্ত মঞ্চ করা হয় প্রথম পর্যায়ে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্মিত হয়েছে বহুল আলোচিত স্বাধীনতা স্তম্ভ। কাচের তৈরি এই স্তম্ভের স্থাপত্য নকশা করেছিলেন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মেসার্স আরবানার স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী ও মেরিনা তাবাসসুম। ‘এনডিই-নোভাম কনসোর্টিয়াম’ নামের বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের একটি যৌথ প্রতিষ্ঠান স্তম্ভটি নির্মাণ করে। ২০০৯ সালে কাচের এই স্তম্ভটির নির্মাণকাজ শুরু হলেও তা কাজ শেষ হয় ২০১৪ সালে। স্তম্ভ ছাড়াও দ্বিতীয় পর্যায়ে জলাধার সংস্কার, উদ্যানের চারপাশে স্টিলের বেড়া ও ছয়টি নতুন ফটক তৈরি করা হয়।

ক্ষুব্ধ মুক্তিযুদ্ধ গবেষকরা

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘আমাদের রিটের পর উদ্যানের অন্যান্য স্থাপনা অপসারণ করে স্মৃতিচিহ্নগুলো সংরক্ষণ করার জন্য আদালত নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার আদালতের রায় গ্রহণ করেনি। সরকারই যদি তা বাস্তবায়ন না করে তাহলে কী করার আছে।’

সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন

এদিকে শাহবাগ থানা সরিয়ে নেওয়ার জন্য বারবার তাগাদা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম মোজাম্মেল হক। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘শাহবাগ থানা সরানোর জন্য আমরা বারবার বলেছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও আলাপ করেছি। কিন্তু তারা সরাচ্ছেন না। বলছেন, থানার জন্য জায়গা খোঁজা হচ্ছে। এটা সময় সাপেক্ষ বিষয়।’

এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হোক, এটি পুলিশও চায়। তবে শাহবাগ থানা হস্তান্তর না হওয়ায় প্রকল্পের কাজ থেমে আছে, এ কথা ঠিক নয়। আমরা বলেছি, এই স্থানে শাহবাগ থানা দীর্ঘদিন ধরে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছাড়াও রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন কারণে শাহবাগ থানা এই এলাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি প্রকল্পের নিরাপত্তার জন্যও থানাটি এর কাছেই থাকা জরুরি। তাই আমরা বলেছি, থানাটি আশপাশেই রাখা হোক। ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে থানার জন্য দুটি বিকল্প স্থান বিবেচনা করে চিঠি দেওয়া হয়েছে। একটি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের বিপরীতে সাকুরা বারের স্থানে আর অপরটি রমনা কালীমন্দিরের পাশে। সিটি করপোরেশন এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিলেই থানা সরিয়ে নিবে ডিএমপি।’

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা