নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন
প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০২৪ ২১:১৯ পিএম
আপডেট : ০২ মার্চ ২০২৪ ২২:২৩ পিএম
রাজধানীর বেইলি রোডে এই ভবনে আগুন লেগে প্রাণ গেছে ৪৬ জনের। প্রবা ফটো
বেইলি রোডের ঘটনাকে আসলে হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা দরকার বলে মনে করে নগর পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)।
সংগঠনটি বলছে, প্রায় প্রতিবছরই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন ভবনে আগুন লাগে। এতে প্রাণ যাচ্ছে অসংখ্য মানুষের। এত বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন গেলেও সমস্যা সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা ও শাস্তির মুখোমুখি করা হচ্ছে না। বরং যেখানে সেখানে হোটেল, রেস্তোরাঁ, শপিং মল ও কারখানার অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের চিন্তায় থাকছে শুধু মুনাফা আর অধিক মুনাফা অর্জন।
বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ড এবং ভবনে জীবনের নিরাপত্তা : বিআইপির পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাবনা শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এমন অভিমত দিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। শনিবার (২ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর বাংলামোটরে সংগঠনের কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। বিআইপির সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসানের সঞ্চালনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। বক্তব্য দেন সহসভাপতি সৈয়দ শাহরিয়ার আমিন, যুগ্ম সম্পাদক তামজিদুল ইসলাম প্রমুখ।
ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটির প্রথম থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক (শুধুমাত্র অফিস কক্ষ হিসেবে) এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম তলা আবাসিক ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। ভবনটিতে রেস্তোরাঁ, শোরুম (বিক্রয়কেন্দ্র) বা অন্য কিছু করার জন্য অনুমোদন নেওয়া হয়নি। কিন্তু ভবনের মালিকরা পুরো ভবনটি বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহার করছিলেন, যেখানে অনুমোদনহীনভাবে বেশিরভাগই ছিল রেস্তোরাঁ; যা সুস্পষ্টভাবে ইমারত আইন ও নগর পরিকল্পনার ব্যত্যয়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কঠোর সমালোচনা করে বিআইপির সভাপতি বলেন, বেইলি রোডের ভবনটিতে কার্যকর কোনো অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ও অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা ছিল না। এ দুর্ঘটনার আগে ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে ভবনের কর্তৃপক্ষকে তিনবার চিঠি দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেননি ভবনমালিক ও ভবনের ব্যবহারকারীরা। বিপরীতে বারবার নোটিস দিয়েই দায় সেরেছে ফায়ার সার্ভিস।
গত বৃহস্পতিবার রাতে গ্রিন কোজি কটেজে আগুন লাগে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ১১ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৭৫ জনকে। নিহতদের মধ্যে ২০ জন পুরুষ, ১৮ জন নারী ও ৮ জন শিশু।
ড. আদিল বলেন, অতীতের অগ্নিদুর্যোগের ঘটনার মতোই রাজধানীর বেইলি রোডে সংঘটিত আগুনের ঘটনাটিকে আসলে হত্যাকাণ্ড হিসেবেই বিবেচনা করা দরকার। এ ধরনের দুর্ঘটনা আসলে সেবা সংস্থাগুলোর গাফিলতিজনিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবেচনা না করলে এবং সংশ্লিষ্ট যেসব ব্যক্তি ও সংস্থা দায়িত্ব পালনে গাফিলতি, উদাসীনতা ও অন্যায় আচরণ করেছে তাদের যথাযথ আইনের আওতায় না আনলে এর পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে।
তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত বহুতল ভবনের সঠিক সংজ্ঞায়ন ও সঠিক উচ্চতা ঠিক করতে ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে মানুষের জীবনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। ফলে ফায়ার সার্ভিসের আইনে ৬ তলার ওপরে বহুতল ভবন বিবেচিত হলেও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী তা সাধারণত ১০ তলার ওপরে বহুতল। ফলে অনেক উঁচু উঁচু ভবন নির্মিত হচ্ছে অতি দুর্বল অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে।
কোনো ভবনে প্রবেশের পর বোঝার উপায় থাকে না যে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ কি না। তাই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সামনে অন্তত লাল রঙের নোটিস টানিয়ে দেওয়ার আহ্বানও জানান তিনি।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করতে সরকারের এক সপ্তাহের একটি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা দরকার। এই সময়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে সমস্ত ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে ঢাকার ভূমি উন্নয়ন পরিকল্পনা ও নকশা প্রণয়নের সময় দুর্যোগ-পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী কার্যক্রমের বিস্তারিত বিধিমালা প্রণয়ন ও সংরক্ষণ করতে হবে।
কোষাধ্যক্ষ ড. মু. মোসলেহ উদ্দীন হাসান বলেন, নিমতলী, চক বাজারের চুড়িহাট্টাসহ গত কয়েক বছরে যেসব আগুনের ঘটনা ঘটেছে এসব থেকে আমরা শিক্ষা নিইনি। এত মানুষের মৃত্যুর পরও তা বন্ধ করতে পারছি না। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সাধারণ জনগণের উচিত রেস্তোরাঁগুলোতে খাবারের পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তাব্যবস্থারও রেটিং দেওয়া। সরকারের উচিত নিরাপদ নগর মেগাপ্রকল্প হাতে নেওয়া। জননিরাপত্তা ও জনস্বার্থ রক্ষার স্বার্থে সরকারকে জিরো টলারেন্স নীতিকে সামনে রাখতে হবে। নগরীকে সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতো ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে।
সহসভাপতি সৈয়দ শাহরিয়ার আমিন বলেন, নকশাগত ত্রুটি ভবনগুলোতে অগ্নিকাণ্ড হওয়ার অন্যতম কারণ। নান্দিকতার জন্য কাচ দিয়ে অথবা গ্লাস ব্যবহার করে যেই ভবনগুলো বানানো হচ্ছে তাতে বায়ু প্রবাহের পথ বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলেই আমরা নিজেরাই ভবনগুলোকে মারণফাঁদ বানিয়ে ফেলছি।
তিনি বলেন, ২০১০ সালের নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, ২০১৯ সালের চকবাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নিইনি। নিমতলীর ঘটনায় তদন্ত কমিটির ১৭ দফা সুপারিশের বাস্তবায়ন হলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়তো আর দেখতে হতো না।
যুগ্ম সম্পাদক তামজিদুল ইসলাম বলেন, মানুষের জীবনের মূল্য থেকে অর্থনীতি বা মুনাফাকে প্রাধান্য দেওয়ার যে প্রবণতা তা বন্ধ করতে হবে। তা ছাড়া রাজউক, সিটি করপোরেশন এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসা। ঢাকার এলাকাভিত্তিক নগর পরিকল্পনা, ভূমির পুনঃউন্নয়ন, বিদ্যমান আইন ও নীতিমালার সঠিক প্রয়োগ এবং সেবা সংস্থাগুলোর সঠিক নজরদারির মাধ্যমে ঢাকাকে দুর্যোগ ঝুঁকিমুক্ত ও বসবাস উপযোগী করা সম্ভব।
সংবাদ সম্মেলনে কয়েকটি প্রস্তাবও তুলে ধরেছে বিআইপি। এর মধ্যে রয়েছে নগর পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী ঢাকা শহরের ভবনের সেটব্যাকের (এক ভবন থেকে অন্য ভবনের দূরত্ব) পরিমাণ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে এবং নির্মাণ বিধিমালার প্রয়োজনীয় সংশোধন আনতে হবে। ভবন রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবহারের জন্য পরিকল্পনার অনুমোদন নিতে প্ল্যানিং অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন।