× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

মুক্তিযুদ্ধের প্রকল্পে মেয়াদ বাড়ে, কাজ শেষ হয় না!

সেলিম আহমেদ

প্রকাশ : ২৮ মার্চ ২০২৪ ০৯:১৫ এএম

আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২৪ ১১:১০ এএম

মুক্তিযুদ্ধের প্রকল্পে মেয়াদ বাড়ে, কাজ শেষ হয় না!

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান)। ঐতিহাসিক এই মাঠেই একাত্তরের ৭ মার্চ কালজয়ী ভাষণ দিয়ে দেশের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরাজিত হওয়ার পর এই উদ্যানেই আত্মসমর্পণ দলিল স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ঐতিহাসিক এই স্থানকে সংরক্ষণ করতে ১৯৯৭ সালে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। বর্তমানে চলছে তৃতীয় পর্যায়ের কাজ। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার পাশাপাশি রাজধানীর মানুষের বিনোদনের জন্যও এখানে থাকছে নানা আয়োজন। দুই দফা মেয়াদ বাড়িয়ে চলতি বছরের জুনে তৃতীয় পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অগ্রগতি মাত্র ৭৫ শতাংশ। বাকি সময়ে কোনোভাবেই এই কাজ শেষ হবে না বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র। শুধু এই প্রকল্প নয়, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সব প্রকল্পেই একই অবস্থা। বারবার বাড়ে মেয়াদ, বাড়ে বরাদ্দও, অথচ শেষ হয় না মুক্তিযুদ্ধের প্রকল্পের কাজ। 

সর্বশেষ গত ১২ মার্চ মন্ত্রণালয়টির বাস্তবায়নকৃত প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১২টি প্রকল্পের কাজ চলমান। এর মধ্যে অধিকাংশ প্রকল্পের কাজ চলতি বছরের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও অনেক কাজ এখনও বাকি। আবার কোনো প্রকল্প অনুমোদন হলেও শুরুই হয়নি কাজ। 

সব উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১২ সালে। দুবার মেয়াদ বাড়ানোর পর এই প্রকল্পের সর্বশেষ মেয়াদ শেষ হবে আগামী জুনে। অথচ এখন পর্যন্ত ৪৯৫টি উপজেলার মধ্যে ৪৩৭টিতে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। আর চলমান রয়েছে ৯টির। বাকি উপজেলাগুলোতে জমি না পাওয়ায় কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। জমি নিশ্চিত করতে চিঠিও দেওয়া হয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং মাঠ প্রশাসনকে। 

মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থানগুলো সংরক্ষণ ও স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। দ্বিতীয়বার সংশোধিত প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হবে আগামী জুনে। অথচ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৭৬.০৭ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় ২৫২টি স্মতিসৌধ ও ৫৮টি স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণকাজ শেষ হলেও এখনও কাজ চলমান ২০টি স্মৃতিসৌধ ও ১৪টি স্মৃতি জাদুঘরের। এই প্রকল্পেও জমি-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে কয়েকটি কাজ আটকে আছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর শহীদ সদস্যদের অবদান স্মরণ রাখতে সরকার ২০১৭ সালে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। এই সময়ে মেয়াদ শেষ না হওয়ায় বিশেষ সংশোধনী এনে প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো হয়। বর্ধিত মেয়াদও শেষ হবে আগামী জুনে। অথচ প্রকল্পটির অগ্রগতি ৬৭.১০ শতাংশ। এই প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

২০০১ সালে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গণহত্যার জন্য ব্যবহৃত বধ্যভূমি চিহ্নিতকরণ ও সংরক্ষণে দুটি প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হয় ২০০৪ সালে। ২০০৮ সাল পর্যন্ত পরবর্তী চার বছরে মন্ত্রণালয় সারা দেশে ১৯৩টি বধ্যভূমি খুঁজে বের করে। কিন্তু প্রায় ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে এর মধ্যে মাত্র ৩৫টি বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করতে সক্ষম হয়। এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে দেশব্যাপী ৪০টি জেলার ১১০টি উপজেলায় ২৮০টি বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রাথমিকভাবে প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত থাকলেও, দুই দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে প্রথমে ২০২৩ ও পরে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রকল্প সূত্র জানায়, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পটির ক্রমপুঞ্জিত অগ্রগতি মাত্র ৭.৬০ শতাংশ। এখন পর্যন্ত ৩৫টি বধ্যভূমির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে, আর ৯টির কাজ চলমান। 

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধিস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ দুই দফায় বাড়ানো হলেও গত প্রায় ছয় বছরে মাত্র ৪ হাজার ১৯ সমাধি সংরক্ষণের কাজ শেষ হয়েছে। আরও ৫০৯ সমাধি সংরক্ষণের কাজ চলছে। অথচ এই প্রকল্পের আওতায় প্রথম পর্যায়ে ২০ হাজার সমাধি সংরক্ষণের কাজ ২০২১ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ করতে না পারায় দুই দফায় সময় বাড়ানো হয়েছে। বর্তমান মেয়াদও শেষ হবে আগামী জুনে। অথচ প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ১৮.১৩ শতাংশ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নকশা সংশোধন ও সমাধিস্থল প্রমাণসহ চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে জটিলতার কারণে প্রকল্পের কাজ ধীরগতিতে এগিয়েছে। এই প্রকল্পের মেয়াদও বাড়ানোর প্রস্তুতি চলছে। 

অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ ও প্রয়াত বীরদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ‘বীর নিবাস’ নামের একটি আবাসন প্রকল্প নেয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এই প্রকল্পের আওতায় দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় ৩০ হাজার বাড়ি নির্মাণ করার কথা। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। এর অংশ হিসেবে ২০২১ সালের ১৬ মার্চ ৪ হাজার ১২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয় ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর। এরপর প্রকল্পের সংশোধনী এনে মেয়াদ বাড়ানো হয় চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৪৮.৪৮ শতাংশ। প্রকল্প সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১১ হাজার ৫৭টি বীর নিবাসের কাজ শেষ হয়েছে। আর ১০ হাজার ৮৮৯টির কাজ চলমান এবং ৮ হাজার ৫৪টির নতুন টেন্ডার করা হয়েছে। 

অপারেশন জ্যাকপট বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নৌ-সেক্টর পরিচালিত সফলতম গেরিলা অপারেশন। ১৯৭১-এর ১৫ আগস্ট রাত ১২টার পর অর্থাৎ ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহরে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং দেশের অভ্যন্তরে চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরে একই সময়ে পরিচালিত হয় এই অপারেশন। সেই অভিযানে পাকিস্তান ও অন্য আরও কয়েকটি দেশ থেকে অস্ত্র, খাদ্য ও তেল নিয়ে আসা ২৬টি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। সেই ঘটনা নিয়ে বিশাল বাজেটে চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সিনেমার নাম ‘অপারেশন জ্যাকপট’। সিনেমাটির পরিচালক হিসেবে থাকছেন আলোচিত পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু ও কলকাতার রাজীব কুমার। ২০২২ সালে ১ জানুয়ারি সিনেমার জন্য নেওয়া প্রকল্পটি শেষ হবে আগামী বছরের জুনে। ইতোমধ্যে সিনেমাটির কাজ শুরু হলেও ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অগ্রগতি ৩৬.৯১ শতাংশ। আর এর অগ্রগতি ৬০ শতাংশ। 

মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানাতে ‘বীরের কণ্ঠে বীরগাথা’ নামে একটি প্রকল্প নেয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানানোর জন্য দেশের ৮০ হাজার জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে ১৬টি ডকুমেন্টারি ও আর্কাইভ ‘বীরের কণ্ঠে বীরগাথা’। ২০২২ সালে শুরু হওয়া প্রকল্প শেষ হবে আগামী বছরের ডিসেম্বরে। অথচ প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র শূন্য দশমিক ৭২ শতাংশ। 

এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্যানোরমা নির্মাণ (কারিগরি সহায়তা) প্রকল্পের অগ্রগতি ৭৭.৫৯ শতাংশ ও ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ২৯.২৪ শতাংশ। আগামী বছরে জুনে প্রকল্প দুটির কাজ শেষ হওয়ার কথা। আর ‘খেতাবপ্রাপ্ত বিভিন্ন বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধিস্থল ও দেশের নানা স্থানে বিদ্যমান মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উন্নয়ন এবং মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থানগুলোয় স্মৃতিস্তম্ভ ও জাদুঘর নির্মাণ’ প্রকল্প গত বছরের অক্টোবরে নেওয়া হলেও এখনও কাজ শুরু হয়নি। প্রকল্পের কাজ দ্রুত শুরু করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে সাম্প্রতিক পর্যালোচনা সভায়। 

যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা

এ প্রসঙ্গে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের যেসব প্রকল্প আমলানির্ভর, যেসব প্রকল্পেই ধীরগতি। আমলাদের কাজ হলো প্রশাসনিক কাজ। তাদের কাজ কোথায় কোন বধ্যভূমি কিংবা কে রাজাকার তা খুঁজে বের করা নয়। আবার তারা আজ এই মন্ত্রণালয়ে তো কাল ওই মন্ত্রণালয়ে, কেউ আজ এই জেলায় তো কাল ওই জেলায় যান। আমলানির্ভর এসব প্রকল্পে সাধারণ মানুষ কিংবা মুক্তিযোদ্ধা বা গবেষকদেরও কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তাদের কোনো জবাবদিহিও নেই। এ কারণেই কাজ এগোচ্ছে না। 

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, চলমান প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করার চেষ্টা আমরা অবশ্যই করছি। সংশ্লিষ্ট প্রকল্প কর্মকর্তাদের টাইমফ্রেম বেঁধে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। আশা করছি দ্রুত সব কাজ শেষ হবে।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা