ড. আতিউর রহমান
প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৩ ১৯:৩২ পিএম
আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:৩২ পিএম
২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান বাংলাদেশের অন্যতম সফল উদ্যোক্তা স্যামসন এইচ চৌধুরী। একান্ন বছরের বর্তমান বাংলাদেশ আসলে উদ্যোক্তাদের সাফল্যের প্রতীক। বাংলাদেশ যেমন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিধ্বস্ত এক অর্থনীতি নিয়ে যাত্রা শুরু করে আজ সারা বিশ্বের উন্নয়নের বিস্ময়, ঠিক তেমনি স্যামসন চৌধুরীও শূন্য হাতে শুরু করা সফল উদ্যোক্তাদের প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী তিনি দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু যে স্বপ্ন নিয়ে তিনি একাত্তরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দেওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন, সেই স্বপ্নের অনেকটাই লড়াকু বাংলাদেশ অর্জন করেছে।
বাহাত্তরে আট বিলিয়ন ডলারের জিডিপি নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ তার যাত্রা শুরু করেছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে সেই বাংলাদেশের মোট জিডিপি বেড়ে হয়েছে ৪৬৫ বিলিয়ন ডলারের মতো। একান্ন বছরে ৫৮ গুণ বেড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এটি সম্ভব হয়েছে পরিশ্রমী উদ্যমী মানুষের লেগে থাকার জন্য। দারিদ্র্য ও ক্ষুধাক্লিষ্ট সেই বাংলাদেশকে বিপুল সম্ভাবনাময় এই বাংলাদেশে পরিণত করতে যেমন বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুকন্যার সুদূরপ্রসারী নেতৃত্বকে কৃতিত্ব দিতে হয়, তেমনি প্রয়াত স্যামসন এইচ চৌধুরীদের মতো আশাজাগানিয়া উদ্যোক্তাদের অবদানের কথাও স্বীকার করতেই হবে। স্যামসন এইচ চৌধুরীর জন্ম ১৯২৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। কিছুকাল চাকরি করার পর পঞ্চাশের দশকে পাবনার আতাইকুলা বাজারে একটি ছোট ওষুধের দোকান দিয়ে তাঁর উদ্যোক্তা জীবনের শুরু। উদ্দেশ্য নিজে নিজে কিছু করা। বাবা ছিলেন একজন মেডিকেল প্র্যাকটিশনার। তাই ওষুধের জগৎটা ছিল স্যামসন চৌধুরীর চেনা। আর তাই তিনি ওষুধের ব্যবসাতে শুরুতে মনোনিবেশ করেন। এখান থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখতে থাকেন বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার। এই গ্রামেই তিনি প্রথম গড়ে তোলেন ওষুধের ছোট কারখানা। এই কারখানার ওষুধ তিনি নিজের দোকানে বিক্রি করতেন। আশেপাশের দোকানেও বিক্রি করতে দিতেন। স্বপ্নচারী এই মানুষটি আরও তিন বন্ধুকে নিয়ে পাবনা শহরের শালগারিয়া মৌজায় ১৯৫৮ সালে গড়ে তোলেন একটি ওষুধের কারখানা। চার বন্ধুর এই কারখানার নাম দেন ‘স্কয়ার’। শুরু করেছিলেন প্রত্যেকে বিশ হাজার টাকার পুঁজি নিয়ে। পরবর্তী সময়ে বন্ধুদের কাছ থেকে তাদের অংশীদারত্ব কিনে নেন তিনি। আর এভাবেই গড়ে তোলেন বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্কয়ার গ্রুপ। ওষুধ দিয়ে শুরু করলেও তাঁর জীবদ্দশাতেই তিনি তাঁর ব্যবসার বিপুল প্রসার ঘটান। জীবনের প্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি পণ্য উৎপাদনের মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর ব্যবসার প্রসার ঘটান। মানুষের সেবাই যেহেতু ছিল তাঁর আরাধ্য, তাই তিনি তাদের জীবনমান উন্নত করার মতো শিল্পপণ্য উৎপাদনে ছিলেন বেশি তৎপর। তাঁর শিল্প গ্রুপের ব্যবসায় সম্প্রসারিত হয়েছে প্রসাধনীসামগ্রী, টেক্সটাইল, তৈরি পোশাক, কৃষিপণ্য, চা, তথ্যপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা ও মিডিয়ায়।
অসাধারণ এক বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী স্যামসন চৌধুরী। ব্যাপক অধ্যবসায়, পরিশ্রম, মানবপ্রীতি, নিষ্ঠা ও সততার জোরে গড়ে তুলেছেন তাঁর জীবন ও বহুমুখী উদ্যোগ। দেশে এবং বিদেশে তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যের ডালপালা হয়েছে প্রসারিত। মানুষের কল্যাণে নিবেদিত মানুষটি তাঁর প্রতিটি উদ্যোগের পেছনে অসাধারণ মানবপ্রেম এবং উদ্যমের পদচিহ্ন রেখে গেছেন। তাঁর উদ্যমে শ্রমিকরা পেয়েছেন এবং এখনও পান সর্বোচ্চ সম্মান। প্রায় ৩৩ হাজার কর্মচারী তাঁর বিভিন্ন উদ্যোগে কর্মরত রয়েছেন। তারা প্রতিদিন দুপুরের খাবার, ভাতা, আকর্ষণীয় বোনাস পান। এই প্রথা তিনিই চালু করে গেছেন। আজও তাঁর সন্তানেরা এসব সুযোগ-সুবিধা চালু রেখেছেন। তিনি সব সময় তাঁর কর্মীদের কথা শুনতেন। তাদের চাহিদাগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে পূরণের উদ্যোগ নিতেন। তিনি ছিলেন দানবীর। পাবনায় তিনি গড়ে তুলেছেন অনিতা-স্যামসন ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশনের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে দরিদ্র মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বিনামূল্যে তথ্যপ্রযুক্তিসহ উঁচুমানের দক্ষতা অর্জনের শিক্ষা দেওয়া। পাবনায় তিনি গড়ে তুলেছেন ঐতিহাসিক অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি। এই জ্ঞানভান্ডার স্থানীয় জ্ঞানপিপাসুদের জ্ঞানার্জনের তৃষ্ণা মেটাতে এক অনন্যসাধারণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। তাঁর চা-বাগানের মুসলিম কর্মীদের সন্তানদের জন্য গড়ে তুলেছেন আধুনিক মাদ্রাসা। অসাধারণ সৌজন্যবোধ এবং অমায়িক ব্যবহারের জন্য তিনি ছিলেন সব মানুষেরই প্রিয়ভাজন। চলনে-বলনে-কথনে ছিলেন তিনি এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব।
শুধু ব্যক্তিজীবনে নয়, উদ্যোক্তা হিসেবেও তিনি ছিলেন কাচের মতো স্বচ্ছ। একাধিকবার তিনি দেশের অন্যতম সর্বোচ্চ করদাতার গৌরব অর্জন করেছেন। একই সঙ্গে পুরো ব্যবসায়ী সমাজকে তাঁর মতো স্বচ্ছ, সামাজিক দায়বোধসম্পন্ন এবং দেশ গঠনে উদ্যোগী হওয়ার অনুপ্রেরণা দিতেন। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তাদের সুসংগঠিত করায় গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব দিয়েছেন। যেসব প্রতিষ্ঠান তিনি পরিচালনা করেছেন এবং বিকাশে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের সংখ্যা বিপুল। ছিলেন তিনি স্কয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান। তা ছাড়া তিনি ছিলেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান, এস্ট্রাস লিমিটেডের চেয়ারম্যান, কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবের সম্মানিত সদস্য, মাইডাসের চেয়ারম্যান, টিআইবির চেয়ারম্যান, এমসিসিআইয়ের সভাপতি, আইসিসিআই বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সহসভাপতি, এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক, ক্রেডিট এজেন্সি ক্র্যাবের পরিচালক, সেন্ট্রাল ডিপোজিটারি এজেন্সি অব বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান, কমিটি অব বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজের সদস্য ও উপদেষ্টা, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং স্বনামধন্য সিআইপি। নানা পুরস্কারে তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন। দ্য ডেইলি স্টার এবং ডিএইচএল প্রদত্ত বিজনেস ম্যান অব দ্য ইয়ার (২০০০), আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের (অ্যামচেম) বিজনেস এক্সিকিউটিভ অব দ্য ইয়ার (১৯৯৮), মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার, একুশে পদকসহ (২০১৩) অসংখ্য সম্মাননা তিনি পেয়েছেন। আর সবচেয়ে বড় পুরস্কার তিনি পেয়েছেন মানুষের ভালোবাসা।
আমার সঙ্গে তাঁর ছিল এক আত্মিক সম্পর্ক। আমি ব্যাংকিং খাতের দায়িত্ব নেওয়ার বহু আগে থেকেই তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ আমার হয়েছিল। আমি সত্যি সত্যি মানি যে তিনিই ছিলেন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা। দিনে দিনে বেড়ে ওঠা এই কিংবদন্তি উদ্যোক্তার সঙ্গে আমার প্রাতিষ্ঠানিক কাজের সুযোগ যখন আসে, তখন সত্যি নিজেকে ভাগ্যবানই মনে হয়েছে। মনে পড়ে, আমি তখন জনতা ব্যাংকের পর্ষদের চেয়ারম্যান, তিনি জনতা ব্যাংকের লোকাল অফিসের লেনদেন করেন। যেহেতু জনতা ব্যাংক পাবলিক ব্যাংক, তাই তার ঋণ দেওয়ার সক্ষমতাও বেশি। কিন্তু অনেকেই আমলাতান্ত্রিক ও অন্যান্য জটিলতার কারণে পাবলিক ব্যাংকে ব্যবসা করতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। হঠাৎ একদিন তিনি আমাকে টেলিফোন করলেন। বললেন, আপনাদের লোকাল অফিসে একটি বড় এলসি খুলতে চাই। কিন্তু সময় যে কম। বললাম, দেখুন না একবার চেষ্টা করে। বললেন, আপনাদের পর্ষদ সভা তো হবে দুই সপ্তাহ বাদে। তাহলে কীভাবে তা হবে? আমি বললাম, আসুন না। দেখা যাক। সব কাগজ পাঠিয়ে দিন। কবে আসবেন? বললেন, দুই দিন বাদে। আমি সে সময়ের অত্যন্ত চৌকস এমডি এসএ চৌধুরী সাহেবকে বললাম, এই চ্যালেঞ্জটা কি নিতে পারবেন? বললেন, পারব। তাকে তখন বললাম, লোকাল অফিসকে বলে রাখুন। সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখুন। তখন শামসুল ইসলাম ভূঁইয়া ছিলেন ডিএমডি। তাকেও বলে রাখলাম। দুদিন বাদে তিনি এলেন। সব ঠিকঠাকই ছিল। জনতা ব্যাংক লোকাল অফিস ওইদিনই এলসি খুলে সম্মতিপত্র তাঁর হাতে তুলে দেয়। পরে পর্ষদে তুলে তারা তা অনুমোদন করে নেবেন বলে তাঁকে জানালেন। ইতোমধ্যে তিনি তাঁর ব্যবসার কাজ পুরোদমে চালিয়ে যেতে পারবেন। তিনি যেন এই আয়োজনকে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। তাই আমাকে ফের টেলিফোন করে বললেন, ‘এটা কী করে হলো? আপনারা কি প্রাইভেট হয়ে গেছেন?’ আমি হেসে বললাম, ‘আপনি যদি স্বাচ্ছন্দে ব্যবসা করতে পারেন তাহলে বিদেশি ব্যাংকে আপনার যেসব বন্ধু ব্যবসা করছেন তাদেরও জনতা ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত হতে বলবেন।’ যে কথা সেই কাজ। দেখলাম অ্যাপেক্স গ্রুপসহ আরও অনেক বড় বড় উদ্যোক্তা জনতা ব্যাংকের সঙ্গে দ্রুতই যুক্ত হতে শুরু করল। স্যামসন দার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হলো। এরপর আমি যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হলাম তখন তিনি যে কী খুশি হয়েছিলেন, তা বলে শেষ করতে পারব না। তাঁর এবং তাঁর সহযোগীদের পরামর্শ আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। সেইমতো সংস্কারেও উদ্যোগী হতাম। তখন তিনি প্রায় অবসরে দীলিপ দার মাধ্যমে খবর দিলেন তিনি এক সকালে একত্রে নাশতা খাবেন আমার সঙ্গে। বারিধারায় তাঁর বাড়িতে গেলাম। কত কথাই না হলো। তাঁর সন্তানেরাও একই রকম বিনয়ী। তাঁরাও যোগাযোগ রাখেন।
তাই স্যামসন দার চিরবিদায়ে খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম। তাঁর স্মরণে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে যে সভাটি হয়েছিল, তাতে এ দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসায়ী জগতের অনেকেই অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকের কথাতেই ছিল তাঁর প্রজ্ঞা, দেশপ্রেম, নীতি-নৈতিকতার উঁচুমানের কথা। আমার মনে হয় তাঁদের সবার কথার নির্যাস অধ্যাপক রেহমান সোবহানের কথায় প্রকাশ পেয়েছে। তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘নিঃসন্দেহে তিনি বাংলাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী ছিলেন। সামান্য অবস্থান থেকে তিনি সফল উদ্যোক্তা হতে পেরেছিলেন। তাঁর আত্মশক্তি এবং উদ্যমের গুণে দেশের অন্যতম প্রধান শিল্প গ্রুপ গড়ে তুলেছিলেন। তিনি টিআইবির সভাপতি ছিলেন। তিনি যে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন মানুষ ছিলেন এটিই তার প্রমাণ। এ দেশের ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা এবং শিল্পপতিরা তাঁর জীবনের এবং নিয়ম মেনে ব্যবসা করার গুণাবলি থেকে অনেক কিছুই শিখতে পারেন।’
আসলেই তাঁর জীবন ও কর্ম ছিল আমাদের উদ্যোক্তাদের জন্য এক উল্লেখযোগ্য পাঠক্রম। একজন রেগুলেটর হিসেবে বলতে পারি, তাঁর শিল্প গ্রুপ নিয়ে খেলাপি ঋণ বা সামান্য অভিযোগ কোনোদিন শুনিনি। তিনি এবং তাঁর সন্তানেরা যা করতে পেরেছেন বা পারছেন, তা কেন অন্যরা পারবেন না? বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতিও চ্যালেঞ্জের মুখে। এই সময়টায় প্রত্যেক উদ্যোক্তাকে স্যামসন দার চারিত্রিক ন্যায়নিষ্ঠতা ও দৃঢ়তা থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে চলার আহ্বান জানাই। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।